কুমিল্লার দৌলতপুরে কবি নজরুল ও নার্গিস সম্পর্কে-(৩য় পর্ব )
মাজহারুল মোর্শেদ
গ্রাম্য সে কিশোরী নার্গিস এই দুর্বহ প্রতীক্ষার মধ্যেই দীর্ঘকাল কাটিয়ে পরিণত নারী হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই আকাঙ্খা পূর্ণতা পায়নি। নজরুলের বিরহীমনে বেজে ওঠে নার্গিসের হাহাকারের ধ্বনি। শ্রাবণ মাসে (১৯২১ খ্রিস্টাব্দে) ফিরে আসবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে নার্গিসের প্রাণপ্রিয় নজরুল সেই যে গিয়েছিলেন, জীবনে কত শাওন মাস ফিরে আসাল, বরষা ফুরিয়ে গেল তবুও প্রাণপ্রিয় নজরুল ফিরে আসেনি, বিরহিণী তারই প্রতীক্ষায় প্রহর গুণছে।
তার প্রিয়তম পছন্দ করতো ধান-সবুজ রঙের শাড়ি কিম্বা বর্ষার মেঘবর্ণের ওড়না। স্নেহময়ী মা, তাঁর কন্যাকে ওই সাজে শ্রীময়ীরূপে দেখতে চান। কিন্তু সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে। প্রিয়জন ছাড়া ওই সাজ নিরর্থক বলেই তার এই প্রত্যাখ্যান। অভিমান ভরে সে বলে বৎসরান্তে কাজরির (বর্ষার লোকজ উৎসব) কাজল বর্ণের মেঘ বর্ষায় ফিরে আসার পথ পায়, তার প্রিয়জন কি ফিরে আসার উপায় খুঁজে পায় না।
বিরহিণী নার্গিস ঘরে বন্দিনী। যেমন ওড়বার নেশায় বুনো হাঁসের পাখা উন্মুখ, চঞ্চল- তেমনি তার মনও প্রিয়জনের সাথে মিলনের আকাঙক্ষায় উদ্বেলিত। নার্গিস প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে দেখে, শ্রাবণের প্রবল বন্যায় শুষ্ক প্রকৃতির তৃষ্ণার আগুন নিভে গেছে, পরক্ষণে ভাবে তার মনের বিরহী-আগুন তেমন করে নেভেনি। বর্ষার প্রস্ফুটিত কদম তাকে যেন ব্যঙ্গ করে বলে, কোথায় তোর কিশোর শ্যামরূপী দয়িত। চম্পা ডালে বাতাসের আন্দোলনে আজ কাজরির শূন্য দোলনা দোলে। নার্গিস যেন কৃষ্ণবিহীন রাধার মতো শুধুই মিলনের দোলনায় শূন্যতা অনুভব করে। তবু আশায় আশায় তার প্রতীক্ষার ক্ষণ অতিবাহিত হয়। গানের প্রতিটি কথার মাঝে নজরুল তার প্রিয়তমা নার্গিসের ছবি বুকের মধ্যে ধারণ করে ডুকরে কেঁদেছেন।
শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এলো না।
বরষা ফুরায়ে গেল আশা তবু গেল না
ধানি রঙ ঘাগরি, মেঘ-রঙ ওড়না
পরিতে আমারে মাগো, অনুরোধ ক'রো না
কাজরির কাজল মেঘ পথ পেল খুঁজিয়া
সে কি ফেরার পথ পেল না মা, পেল না।
আমার বিদেশিরে খুঁজিতে অনুক্ষণ
বুনো হাঁসের পাখার মত উড়ু উড়ু করে মন।
অথৈ জলে মাগো, মাঠ-ঘাট থৈ থৈ
আমার হিয়ার আগুন নিভিল কই?
কদম-কেশর বলে, 'কোথা তোর কিশোর',
চম্পা ডালে দোলে শূন্য দোলনা।
এরপর সুদীর্ঘ ১৬ বছর নজরুলের সাথে নার্গিসের আর কোন যোগাযোগও হয়নি।
নজরুল দৌলতপুর ছেড়ে চলে গেলেও নার্গিসকে কোন ভাবেই ভুলতে পারেননি। তিনি লিখেছেন তার মনের কথা। তিনি লিখেছেন, আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা, কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি। তা দিয়ে তোমায় কোনদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশ মানিক না দিলে আমি অগ্নিবীণা বাজাতে পারতাম না। ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না। নজরুল বা নার্গিস কি পরস্পর পরস্পরকে কোনোদিন ভুলতে পেরেছিলেন? নিশ্চয় নয়। নার্গিস পরবর্তীতে লেখালেখি করে তাঁর জীবনের দু:খময় অজানা বেদনা ও কষ্টের কথা বলে গেছেন। আর নজরুল একটি চিঠির উত্তরে হৃদয় নিঙড়ানো হাহাকার ধ্বনি উচ্চারণ করে গেছেন কখনো গানে-গানে আবার কবিতায়।
আজি এ বাদল দিনে কত কথা মনে পড়ে।
হারাইয়া গেছে পিয়া এমনি বাদল-ঝড়ে।
আমারি এ বুকে থাকি’
ঘুমাত সে ভীরু পাখি,
জলদ উঠিলে ডাকি’ লুকাত বুকের ’পরে।
মোর বুকে মুখ রাখি নিবিড় তিমির কাঁদে,
আমার প্রিয়ার মত বাঁধিয়া বাহুর বাঁধে।
কোথায় কাহার বুকে
আজি সে ঘুমায় সুখে,
প্রদীপ নিভায়ে কাঁদি একা ঘরে তারি তরে।
কবি মনের সৃজনশীলতা, বীরত্ব, শৌর্য-বীর্য এ সবই নার্গিসের বিরহে সিক্ত। নজরুলের জীবনে যেসব গৌরবময় সৌন্দর্যমÐিত সৃষ্টি রয়েছে তাতে বেদনা, দুঃখ, কষ্টের যে স্রোত বহমান। নার্গিসের চোখের জলে সিক্ত। এমন মনোভাবকে দলিত করে তাঁর কবিতায় তুলে এনেছেন অমোঘ সত্য। প্রণয়িনীর সঙ্গে নজরুলের সম্পর্কটি এ রকমই এক অপূর্ণতার হাহাকারে ভরা। দ্বিধাহীন কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন-
এ ঘোর শ্রাবণ-নিশি কাটে কেমনে।
রহি’ রহি’ সেই মুখ পড়িছে মনে।।
বিজলিতে সেই আঁখি
চমকিছে থাকি’ থাকি’
শিহরিত এমনি সে বাহু-বাঁধনে।।
শন শন বহে বায় সে কোথায় সে কোথায়
নাহি নাহি ধ্বনি শুনি উতল পবনে হায়
চরাচর দুলিছে অসীম রোদনে।
নার্গিস তার প্রাণপ্রিয় মানুষটিকে ভুলে যাওয়া তো দূরের কথা, কখনো মনের আড়ালও করতে পারেন নি। খাঁ বাড়ির আনাচে-কানাচে, পুকুর পাড়ে আমগাছের নিচে আঁধারের কল্পরূপে নজরুলের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেত। নিজেকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে প্রতিটি মুহূর্ত কেবল নজরুলের জন্য উৎস্বর্গ করেছিল। নার্গিস খুব বেশি লেখাপড়া জানতেন না। তৎকালীন সময়ে মেয়েরা বাড়ির বাইরে গিয়ে লেখাপড়া করতো না। মেয়েদের জন্য আলাদা বিদ্যালয় করার কথা চিন্তাও করা যেত না। তারপরও নিজেকে নজরুলের জন্য উপযোগী করে তুলতে নিয়োমিত পড়াশোনা করতেন।
নার্গিস যেমন নজরুলকে ভুলে যেতে পারেননি, নজরুলও ঠিক তেমনি নার্গিসকে ভ’লতে পাননি। তাই তাঁর শতশত কবিতায়, গানে নানা অনুষঙ্গে নার্গিস তাঁর সৃষ্টিশীলতায় সবসময় জাগ্রত ছিল। নজরুলের সৃষ্টিশীল রচনায় পূর্ণতার ক্ষেত্রে নার্গিস যেন জীবন্ত প্রতিক। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে নার্গিস তার বুকের ভেতর যতœ করে রাখা প্রিয়তম নজরুলকে একটা চিঠি লেখেন। চিঠি প্রাপ্তির সময় সেখানে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন। নজরুল তাকেই চিঠি পড়তে বলেন। চিঠি পড়া শেষে শৈলজানন্দ নজরুলকে উত্তর লিখতে বলেন। নজরুল সে চিঠির উত্তরে একটি গান লিখে দেন-
যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই
কেন মনে রাখ তারে,
ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে।
আমি গান গাহি আপনার দুখে,
তুমি কেন আসি দাঁড়াও সুমুখে,
আলেয়ার মত ডাকিও না আর
নিশীথ অন্ধকারে।
দয়া কর, মোরে দয়া কর, আর
আমারে লইয়া খেল না নিঠুর খেলা;
শত কাঁদিলেও ফিরিবে না সেই
শুভ লগনের বেলা।
আমি ফিরি পথে, তাহে কর ক্ষতি,
তব চোখে কেন সজল মিনতি,
আমি কি ভুলেও কোন দিন এসে দাঁড়ায়েছি তব দ্বারে।
ভুলে যাও মোরে ভুলে যাও একেবারে।
এরপর আস্তে আস্তে দিন চলে যায়, মাসের পর ঘুরে আসে বছর, বছরের পর যুগ। আলী আকবর খান কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় পুস্তক ব্যবসায়ে মন দেন। ঢাকার বাংলাবাজারে বাড়ি বানান। এরপর নার্গিসকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। নার্গিস আবার পড়াশোনা শুরু করেন। চৌদ্দ বছর পর উনিশ শ’ পঁয়ত্রিশ সালে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে ম্যাট্রিক পাস করেন। উনিশ শ’ সাঁয়ত্রিশ সালে (বত্রিশ বছর বয়সে) ইডেন গার্লস কলেজ থেকে আই এ পাস করলেন। নজরুলের ইপযুক্ত প্রণয়িনী হিসেবে নিজেকে তৈরি করার জন্য নার্গিস সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন। তার কবিতায় নজরুলকে না পাবার ব্যথা, বিরহ, একাকিনী থাকার কষ্ট মূর্ত হয়ে ওঠে। নার্গিস একাধিক উপন্যাসও লিখেছিলেন। উপন্যাসগুলোতে স্বামী কর্তৃক অবহেলিতা স্ত্রীর আক্ষেপ ভরপুর। তার এমনি একটি উপন্যাস ‘তাহমিনা’। পারস্য-বীর রুস্তম কর্তৃক ফেলে যাওয়া স্ত্রী তাহমিনার বিলাপ নার্গিস সবিস্তারে লিখেছেন, লিখেছেন পুরুষ জাতির নির্দয়তা, পাষাণচিত্ততা। ‘তাহমিনা’ পড়ে নজরুল তার উত্তরে লেখেন কবিতা ‘হিংসাতুর’-
হিংসাই শুধু দেখেছ এ চোখে? দেখ নাই আর কিছু?
সম্মুখে শুধু রহিলে তাকায়ে, চেয়ে দেখিলে না পিছু!
সম্মুখ হতে আঘাত হানিয়া চলে গেল যে-পথিক
তার আঘাতেরই ব্যথা বুকে ধরে জাগ আজও অনিমিখ?
তুমি বুঝিলে না, হায়!
কত অভিমানে বুকের বন্ধু ব্যথা হেনে চলে যায়!
আঘাত তাহার মনে আছে শুধু, মনে নাই অভিমান?
তোমারে চাহিয়া কত নিশি জাগি গাহিয়াছে কত গান,
সে জেগেছে একা -তুমি ঘুমায়েছ বেভুল আপন সুখে,
কাঁটার কুঞ্জে কাঁদিয়াছে বসি সে আপন মনোদুখে,
কুসুম-শয়নে শুইয়া আজিকে পড়ে না সেসব মনে,
তুমি তো জান না, কত বিষজ্বালা কণ্ঠক-দংশনে!
নার্গিস তাঁর জীবদ্দশায় একটি মুহুর্তের জন্যও নজরুলকে ভুলে থাকতে পারেনি। তাই ঢাকায় এসে পড়াশোনা শুরু করেন। চৌদ্দ বছর পর ম্যাট্রিক ও আই এ পাস করলেন। নজরুলের ইপযুক্ত প্রণয়িনী হিসেবে নিজেকে তৈরি করার জন্য নার্গিস সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন। তাঁর কবিতায়, গানে, কেবল নজরুলকে না পাবার ব্যথা, বিরহ, একাকিনী থাকার কষ্ট মূর্ত হয়ে ওঠে। এমনি তাঁর ‘তাহমিনা’ উপন্যাসে পুরুষ জাতির নির্দয়তা, পাষাণচিত্তের কথাও নার্গিস লিখেছেন । নার্গিস তার প্রিয়তম নজরুলকে নিয়ে যে গানগুলো লিখেছিলেন তা হয়তো কোনদিনই আলোর মুখ দেখতে পায় নি। এমন একটি গান তুলে ধরা গলো-
তুমি তো বলেছিলে, চিরদিন সাথী হয়ে থাকবে,
কুড়িয়ে পাওয়া এই বনফুলমালা করে রাখবে।
হে পথিক তুমি ভালোবেসে
এই তো সেদিন জড়ালে এসে
আজ তুমি হায়! ছিড়লে বাঁধন
আর কি গো কাছে এসে নাম ধরে ডাকবে?
আমি সূর্যমুখি জাগি তোমার ধ্যানে
ফুটিয়েছিলে তুমি আমায় গানে গানে
সব কিছু আজ ভুলে গেছো জানি
ভুল কওে সুরভি কি আর তুমি মাখবে।
(কুমিল্লায় নজরুল স্মৃতি প্রেম ও পরিণয়-তিতাশ চৌধুরী-পৃ-৯৯)
নজরুল নার্গিসের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছে সম্পূর্ণ কাঙ্গাল হ’য়ে। কিন্তু নিজের আত্মমর্যাদা ও আভিজাত্যকে বিলিয়ে দিতে পারেন নি। নার্গিসও তার ভালোবাসার অধিকার নিয়ে সকরুণ মিনতি করে লিখেছেন যে, তিনি (নার্গিস) তার পথ চেয়ে আছেন, তাকে না পেলে বেঁচে থাকার অর্থ নেই, আত্মহত্যার পথ বেছে নেবেন। প্রমীলাকে বিয়ে ক’রেছেন তাতে কিছু আসে যায় না, একবারটি বার যেন দেখা করেন। নজরুল নার্গিসের করুণ মিনতিকে উপেক্ষা করতে পারেন নি। তাকে একটি চিঠি লিছিলেন (১.৭.৩৭ তারিখ) এটি নার্গিসকে লেখা কবির সেই প্রথম ও শেষ চিঠি-
১০৬ আপার চিৎপুর রোড
“গ্রামোফোন রিহার্সাল রুম”
কলকাতা, ০১/০৭/১৯৩৭
কল্যাণীয়াসু,
তোমার পত্র পেয়েছি সেদিন নব বর্ষার নবঘন-সিক্ত প্রভাতে। মেঘ মেদুর গগনে সেদিন অশান্ত ধারায় বারি ঝরছিল। পনের বছর আগে এমনি এক আষাঢ়ে এমনি এক বারিধারায় প্লাবন নেমেছিল, তা তুমিও হয়তো স্মরণ করতে পারো। আষাঢ়ের নব মেঘপুঞ্জকে আমার নমস্কার। এই মেঘদূত বিরহী যক্ষের বাণী বহন করে নিয়ে গিয়েছিল কালিদাসের যুগে, রেবা নদীর তীরে, মালবিকার দেশে, তার প্রিয়ার কাছে। এই মেঘপুঞ্জের আশীর্বাণী আমার জীবনে এনে দেয় চরম বেদনার সঞ্চার। এই আষাঢ় আমায় কল্পনার স্বর্গলোক থেকে টেনে ভাসিয়ে দিয়েছে বেদনার অনন্ত স্রোতে। যাক, তোমার অনুযোগের অভিযোগের উত্তর দেই। তুমি বিশ্বাস করো, আমি যা লিখছি তা সত্য। লোকের মুখে শোনা কথা দিয়ে যদি আমার মূর্তির কল্পনা করে থাকো,তাহলে আমায় ভুল বুঝবে- আর তা মিথ্যা।
তোমার উপর আমি কোনো ‘জিঘাংসা’ পোষণ করিনা এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি। আমার অন্তর্যামী জানেন তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি আসীম বেদনা! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি, তা দিয়ে তোমায় কোনোদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না। আমি ধুমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না। তোমার যে কল্যাণ রূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথম দেখেছিলাম, যে রূপকে আমার জীবনের সর্বপ্রথম ভালবাসার আঞ্জলি দিয়েছিলাম, সে রূপ আজো স্বর্গের পারিজাত-মান্দারের মতো চির অ¤øান হয়েই আছে আমার বক্ষে। অন্তরের সে আগুন-বাইরের সে ফুলহারকে স্পর্শ করতে পারেনি।
তুমি ভুলে যেওনা আমি কবি, আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি। অসুন্দর কুৎসিতের সাধনা আমার নয়। আমার আঘাত বর্বরের কাপুরুষের আঘাতের মতো নিষ্ঠুর নয়। আমার অন্তর্যামী জানেন (তুমি কি জানো বা শুনেছ জানিনা) তোমার বিরুদ্ধে আজ আমার কোন অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই, দাবীও নেই।
আমি কখনো কোন দূত প্রেরণ করিনি তোমার কাছে। আমাদেও মাঝে যে অসীম ব্যবধানের সৃষ্টি হয়েছে তার সেতু কোন লোক ত নয়ই স্বয়ং বিধাতাও হতে পারেন কিনা সন্দেহ। আমায় বিশ্বাস করো, আমি সেই ক্ষুদ্রদের কথা বিশ্বাস করিনি। করলে পত্রোত্তর দিতাম না। তোমার উপর আমার কোন অশ্রদ্ধাও নেই, কোন অধিকারও নেই। আবার বলছি। আমি যদিও গ্রামোফোনের ট্রেড মার্ক ‘কুকুরের’ সেবা করছি, তবুও কোন কুকুর লেলিয়ে দিই নাই। তোমার ঢাকার কুকুর একবার আমায় কামড়েছিল আমার অসাবধানতায়, কিন্তু শক্তি থাকলেও আমি তার প্রতিশোধ গ্রহণ করি নি-তাদেও প্রতি আঘাতও করিনি। সেই কুকুরের ভয়ে ঢাকা যেতে আমার সাহসের অভাবের উল্লেখ করেছ, এতে হাসি পেল। তুমি জান ছেলেরা আমায় কতো ভালবাসে। আমারই অনুরোধে আমার ভক্তরা তাদের ক্ষমা করেছিল। নৈলে তাদের চিহ্ন থাকত না এ পৃথিবীতে। তুমি আমায় জানবার যথেষ্ট সুযোগ পাওনি, তাই এ কথা লিখেছ। যাক তুমি লূপবতী বিত্তশালিনী, গুণবতী তাই তোমার উমেদার অনেক জুটবে, তুমি যদি স্বেচ্ছায় স্বয়ম্বরা হও আমার তাতে কোন আপত্তি নেই। আমি কোন অধিকারে তোমায় বারণ কবর বা আদেশ দিব? নিষ্ঠুর নিয়তি সমস্ত অধিকার থেকে আমায় মুক্তি দিয়েছেন।
তোমার আজিকার রূপ কি জানিনা। আমি জানি তোমার সেই কিশোরি মুর্তিকে, যাকে দেবীমূর্তির মতো আমার হৃদয় বেদীতে অনন্ত প্রেম, অনন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। সেদিনের তুমি সে বেদী গ্রহণ করলেনা। পাষাণ দেবীর মতই তুমি বেছে নিলে বেদনার বেদিপীঠ।... জীবন ভ’রে সেখানেই চলেছে আমার পূজা আরতি। আজকার তুমি আমার কাছে মিথ্যা, ব্যর্থ, তাই তাকে পেতে চাইনে। জানিনে হয়ত সে রূপ দেখে বঞ্চিত হব, অধিকতর বেদনা পাব, তাই তাকে অস্বীকার করেই চলেছি।
দেখা? না-ই হ’ল এ ধূলির ধরায়। প্রেমের ফুল এ ধূলিতলে হয়ে যায় ¤øান, দগ্ধ, হতশ্রী। তুমি যদি সত্যিই আমায় ভালবাস আমাকে চাও ওখান থেকেই আমাকে পাবে। লাইলি মজনুকে পায়নি, শিরি ফরহাদকে পায়নি, তবু তাদের মত করে কেউ কারো প্রিয়তমাকে পায়নি। আত্মহত্যা মহাপাপ, এ অতি পুরাতন কথা হলেও প্রেম সত্য। আত্মা অবিনশ্বর, আত্মাকে কেউ হত্যা করতে পারেনা। প্রেমের সোনার কাঠির স্পর্শ যদি পেয়ে থাকো, তাহলে তোমার মতো ভাগ্যবতী আর কে আছে? তারি মায়া স্পর্শে তোমার সকল কিছু আলোয় আলোময় হয়ে উঠবে।
দুঃখ নিয়ে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে গেলেই সেই দুঃখের অবসান হয়না। মানুষ ইচ্ছা করলে সাধনা দিয়ে, তপস্যা দিয়ে ভুলকে ফুল রূপে ফুটিয়ে তুলতে পারে। যদি কোনো ভুল করে থাক জীবনে, এই জীবনেই তাকে সংশোধন করে যেতে হবে; তবেই পাবে আনন্দ মুক্তি; তবেই হবে সর্ব দুঃখের অবসান। নিজেকে উন্নত করতে চেষ্টা করো, স্বয়ংবিধাতা তোমার সহায় হবেন। আমি সংসার করছি, তবু চলে গেছি এই সংসারের বাধাকে অতক্রম করে উর্ধ্ব লোকে। সেখানে গেলে পৃিথবীর সকল অপূর্ণতা, সকল অপরাধ ক্ষমা সুন্দর চোখে পরম মনোহর মূর্তিতে দেখা যায়।
হঠাৎ মনে পড়ে গেল পনের বছর আগের কথা। তোমার জ্বর হয়েছিল, বহু সাধনার পর আমার তৃষিত দুটি কর তোমার শুভ্র ললাট স্পর্শ করতে পেরেছিল; তোমার তপ্ত ললাটের স্পর্শ যেন আজো অনুভব করতে পারি। তুমি কি চেয়ে দেখেছিলে? আমার চোখে ছিলো জল, হাতে সেবা করার আকুল স্পৃহা, অন্তরে শ্রীবিধাতার চরণে তোমার আরোগ্য লাভের জন্য করুন মিনতি। মনে হয় যেন কালকের কথা। মহাকাল যে স্মৃতি মুছে ফেলতে পারলেননা। কী উদগ্র অতৃপ্তি, কী দুর্দমনীয় প্রেমের জোয়ারই সেদিন এসেছিল। সারা দিন রাত আমার চোখে ঘুম ছিল না।
যাক আজ চলেছি জীবনের অন্তমান দিনের শেষে রশ্মি ধরে ভাটার ¯্রােতে, তোমার ক্ষমতা নেই সে পথ থেকে ফেরানোর। আর তার চেষ্টা করোনা। তোমাকে লেখা এই আমার প্রথম ও শেষ চিঠি হোক। যেখানেই থাকি বিশ্বাস করো আমার অক্ষয় আশির্বাদ কবচ তোমায় ঘিরে থাকবে। তুমি সুখি হও, শান্তি পার, এই প্রার্থনা। আমায় যত মন্দ বলে বিশ্বাস করো, আমি তত মন্দ নই, এই আমার শেষ কৈফিয়ৎ।
ইতি
নিত্য শুভার্থী
নজরুল ইসলাম
পি.এস.- আমার ‘চক্রবাক’ নামক পুস্তকের কবিতাগুলো পড়েছ? তেমার বহু অভিযোগের উত্তর পাবে তাতে। তোমার কোন পুস্তকে আমার সম্পর্কে কটুক্তি ছিল। ইতি-
বিবাহ বিপর্যয়ের সকল দায়ভার এ চিঠিতে নজরুল নার্গিসের উপর চাপিয়েছেন, নার্গিসকেই দোষারোপ করেছেন। “আমি জানি তোমার সেই কিশোরি মুর্তিকে, যাকে দেবীমূর্তির মতো আমার হৃদয় বেদীতে অনন্ত প্রেম, অনন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। সেদিনের তুমি সে বেদী গ্রহণ করলেনা। পাষাণ দেবীর মতই তুমি বেছে নিলে বেদনার বেদিপাঠ। জীবন ভ’রে সেখানেই চলেছে আমার পূজা আরতি। আজকার তুমি আমার কাছে মিথ্যা, ব্যর্থ, তাই তাকে পেতে চাইনে। জানিনে হয়ত সে রূপ দেখে বঞ্চিত হব, অধিকতর বেদনা পাব, তাই তাকে অস্বীকার করেই চলেছি”।
শ্লেষাত্মক মন্তব্যও করে গেছেন নিজের অজান্তে- ‘তুমি রূপবতী, বিত্তশালিনী, গুনবতী কাজেই তোমার উমেদার অনেক জুটবে।’ এই উমেদার কারা? নার্গিসের শুভ্যানুধায়ীরা? যারা নজরুলের দারিদ্র্য নিয়ে নার্গিসের মন বিষিয়ে দিয়েছিলেন, বিপর্যয় ঘটিয়েছিলেন, দুটি জীবন বেদনায় বিদীর্ণ করেছিলেন? নার্গিসের ক্ষণিকের ভুল নজরুল ক্ষমা করতে পারেননি, কিন্তু চিরকাল তার স্মৃতি, তার জন্য মর্মবেদনা হৃদয়ে বয়ে বেরিয়েছেন। এ বেদনা থেকে সৃষ্টি হয়েছে অসাধারণ কবিতা, গান, সাহিত্য। ‘বিদ্রোহী, ‘ধূমকেতু’ ‘চক্রবাক’ ‘পূবের হাওয়া’ আরো কত গ্রন্থ কবিতা; কতো গান-
মোর প্রথম মনের মুকুল
ঝরে গেল হায় মনে মিলনের ক্ষণে।
কপোতীর মিনতি কপোত শুনিল না,
উড়ে গেল গহন-বনে।।
দক্ষিণ সমীরণ কুসুম ফোটায় গো
আমারি কাননে ফুল কেন ঝরে যায় গো
জ্বলিল প্রদীপ সকলেরি ঘরে হায়
নিভে গেল মোর দীপ গোধূলি লগনে।।
বিফল অভিমানে কাঁদে ফুলমালা কণ্ঠ জড়ায়ে
কাঁদি ধূলি-পথে একা ছিন্ন-লতার প্রায় লুটায়ে লুটায়ে।
দারুণ তিয়াসে এসে সাগর-মুখে
ঢলিয়া পড়িনু হায় বালুকারি বুকে
ধোঁয়ারে মেঘ ভাবি’ ভুলিনু চাতকী
জ্বলিয়া মরি গো বিরহ-দহনে।
২৫ এপ্রিল ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ (১২ বৈশাখ ১৩৩১ বঙ্গাব্দ) তাদের কুমিল্লায় নজরুলের বিয়ে করে সংসারি হয়, নার্গিস কোন ভাবেই নিজেকে বিশ^াসই করাতে পারেননি, ভাবতে পারেননি যে তাকে পথে ফেলে নজরুল প্রমীলাকে নিয়ে ঘর বাধবেন। এদিকে মামা আলী আকবর খান দীর্ঘদিন ধরে তার বিয়ের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। নজরুলের পথ চেয়ে সুদীর্ঘ সতেরো বছর প্রতীক্ষা করেছেন নার্গিস, এতো কিছুর পরেও নার্গিস নজরুলকে আশ্রয় করে বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু তাতেও ব্যর্থ হয়। নার্গিসের নিজের কথায়- “১৯৩৭ এর ৪ঠা নভেম্বর, মামার এক বন্ধু মোমেনশাহীর অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন সাহেবের সাহায্যে আমার মামাতো ভাই নওয়াজেস মোহাম্মদ খান ও ওয়াজেদ আলী খানকে নিয়ে কোলকাতার শিয়ালদহ হোটেল এ নজরুলের সঙ্গে জীবনের শেষবারের মতো স্বাক্ষাৎ করি। নজরুল আমাকে দেখে অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। প্রথমে আমরা কেউ কথা বলতে পারিনি। জড়তা কাটিয়ে উঠলে নজরুল বললো, তুমি যাও, আমি ইমিডিয়েটলি ঢাকা আসছি, একটা সুরাহা করবো। নজরুল তাঁর পারিবারিক বিপর্যয়ের কথা বারবার বললো। এও বললো, প্রমিলা কিংবা তার মা তোমাকে কিছুতেই সহ্য করবে না। সুতরাং ঢাকাতেই তুমি থাকবে। এমনি করে ও’ সেদিন আমাদের বিদায় করলো। সে ইমিডিয়েটলি আর এলো না।”
(কুমিল্লায় নজরুল স্মৃতি প্রেম ও পরিণয়-তিতাশ চৌধুরী-পৃ-৮১)
জীবনের সব আশা-আকাঙ্খ্যা ব্যর্থ হলে নার্গিস নজরুলকে হৃদয়ের এককোণে বসিয়ে রেখে তার মামার দেয়া সিদ্ধান্তকে মেনে নেয়। অতঃপর ১২ ডিসেম্বর, ১৯৩৮ খ্রিস্টব্দে নার্গিস, তার মামার পুস্তক ব্যবসায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, নজরুলের স্নেহধন্য কবি আজীজুল হাকিমকে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নেয়।
এ প্রসঙ্গে নার্গিস বলেন- “আমার বিয়ে উপলক্ষে নজরুল ‘পথ চলিতে যদি চকিতে’ গানখানি পাঠিয়েছিল তার সাথে একখানা চিরক’টও লিখেছিল” “জীবনে তোমাকে পেয়েও হারালাম। তাই মরণে পাব- সেই বিশ্বাস ও সান্তনা নিয়ে বেঁচে থাকব। প্রেমের ভ’বনে তুমি বিজয়িনী, আর আমি পরাজিত। আমি আজ অসহায়। বিশ্বাস কর আমি প্রতারণা করিনি। আমাদের মাঝে যারা এ দূরত্বের সৃষ্টি ক’রেছে, পরলোকেও তারা মুক্তি পাবে না”।
তোমার নব অভিযাত্রা শুভ হোক।
নিত্য শুভার্থী
নজরুল
১লা ডিসেম্বর, ১৯৩৮
নার্গিসকে উদ্দেশ্য করে লেখা সে গানটি তুলে ধরা হলো-
পথ চলিতে যদি চকিতে
কভু দেখা হয়, পরান-প্রিয়!
চাহিতে যেমন আগের দিনে
তেমনই মদির-চোখে চাহিয়ো।
যদি গো সেদিন চোখে আসে জল,
লুকাতে সে-জল করিয়ো না ছল,
যে প্রিয়-নামে ডাকিতে মোরে
সে-নাম ধরে বারেক ডাকিয়ো।
তোমার বঁধু পাশে যদি রয়,
মোর-ও প্রিয় সে, করিয়ো না ভয়,
কহিব তারে, ‘আমার প্রিয়ারে
আমারও অধিক ভালোবাসিয়ো’।
বিরহ-বিধুর মোরে হেরিয়া
ব্যথা যদি পাও, যাব সরিয়া,
রব না হয়ে পথের কাঁটা,
মাগিব এ বর মোরে ভুলিয়ো।
মহীয়সী নার্গিস সম্পর্কে জনাব মোশাররফ উদ্দিন ভূঁইয়া তার স্মৃতি কথা “কবি প্রিয়া নার্গিস তাঁকে যেমন দেখেছি” নিবন্ধে লিখেছেন-“ছাত্র জীবন থেকেই তার নার্গিস পরিবারের সাথে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা ছিল। কবি প্রিয়ার এক ভাই মুন্সি আব্দুল জব্বারের তৃতীয় পুত্র অধ্যাপক মনিরুল হক তার সতীর্থ বন্ধু। বাঙ্গরা হাইস্কুলে তারা এক সাথে পড়া লেখা করেছেন। খাঁ বাড়ি ও মুন্সি বাড়িতে তিনি প্রায়ই যেতেন। নজরুল সুহৃদ আলী আকবর খান ও কবি প্রিয়া নার্গিসের সাথে তার দেখা হয়েছে অনেকবার।
মনিরুল হকের সঙ্গে তিনি নার্গিসের বাসায় গেলে তাঁর সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রথম দিন নার্গিসের বাসার গেলে দরোজায় আঘাত করতে কবি আজিজুল হাকিম এসে দরোজা খুলে দেন। তিনি ব্যক্তিগত ভাবে তাকে চিনতেন। নার্গিসের সাথে তার দীর্ঘ আলাপ হয়। নাগিসের সাথে দেখা হলেই তার মনে হত কোন এক যন্ত্রণাদগ্ধ মহীয়সী নারী এবং ইতিহাসের কিংবদন্তি নায়িকার মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। নার্গিস যেভাবে এবং যে সব বিষয়ে আলোচনা করতেন তার মনে বিশ্বাস, সমকালের কোন মুসলিম নারীর সাথে তাঁর তুলনা হয় না। রূপের রাণী নার্গিস অত্যন্ত অতিথি পরায়ন, রুচিশীল, পরিচ্ছন্নতা প্রিয়, স্বল্প ভাষিনী ছিলেন। তাঁর হাসি ছিলো মধুর, যে কেউ মুগ্ধ না হয়ে পারতেন না।
নার্গিস বলেন-“জন্মভ’মি দৌলতপুরে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাবার খুব ইচ্ছে ছিলো তাঁর। একবার তো তারিখও ঠিক হয়েছিলো। দুর্ভাগ্য আমারই তাই সে ইচ্ছে পূরণ হয়নি”।
মহীয়সী নার্গিসের সাথে তার দেখা হয় দোকানে অর্থাৎ আজকের ‘চলন্তিকা বইঘরে’। ১৯৪৭ সালের আগে তার বর্তমান দোকান ঘরটিই ছিলো কবি প্রিয়ার বেডরুম। আর এ ভবনটির নিচ তলায়ই ছিলো আলী আকবর খানের “ভারতী লাইব্রেরি”। নার্গিস নিজেই আসলেন কিন্তু ঘরে ঢুকলেন না। বাইরে একটা চৌকিতে বসে বললেন- এই ঘর আমার অনেক স্মৃতিবিজরিত। তাই দেশ ত্যাগের আগে আর এ ঘরে নাই বা ঢুকলাম। তিনি এর অর্থ জানতে চাইলে নার্গিস সে তথ্য জানালেন, ১৯৪০ সালে নজরুল এ ঘরেই তাঁর সাথে জীবনের শেষবারের মতো দেখা করতে এসেছিলেন। এটুকু বলার পরই তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, দু’চোখ তাঁর অশ্রæসজল হয়ে উঠলো”।
কবি নজরুলের সাথে আপনার যে ছাড়াছাড়ি হলো তা কি কবির দোষে না আপনার? আবেগজরিত কণ্ঠে নার্গিস বললেন-“জীবনে কোনটা সত্য তা আজও আমি বিচার করে উঠতে পারিনি। ভাগ্যের উপর কি কারো হাত আছে?” বলেই তিনি হাসির আড়ালে কান্নাকে লাকোতে চাইলেন। তারপর একটু স্বাভাবিক হয়ে বললেন, “তোমাকে নিয়ে তো আর পারা গেলো না, এসব পুরোনো কথা না বললেই নয়?”
নজরুল সম্পর্কে তাঁর সাথে কথা বললে কখনো তিনি উওর দেন তবে বেশিভাগ সময়ই নিরব থাকেন। কথায় কথায় তিনি তাঁদের যুগল ছবির কথাও বলেন। (অভিনন্দন নজরুল’ স্মারক সংখ্যা, ঢাকা, ৫ই এপ্রিল ১৯৯৬)-
নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের বিয়ে নিয়ে নজরুলের জীবনীকারেরা এখনো দ্বিধাবিভক্ত। তথ্যপ্রমাণ দিয়ে কেউ বলতে চান বিয়ের আসরে নানা রকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেও শেষ পর্যন্ত বিয়েটা হয়েছিল। জীবনীকারদের অন্য অংশ বলতে চান, বিয়েটা আদৌ হয়নি, নজরুলকে ঘরজামাই হিসেবে কুমিল্লায় থেকে যেতে হবে ইত্যাদি কাবিননামার শর্তে প্রচÐ ক্ষুব্ধ হয়ে বিয়ের আসর থেকে উঠে সেই রাতেই দৌলতপুর থেকে প্রায় এগারো মাইল কাঁদা-বিছানো পথে হেঁটে ১৮ই জুন (শনিবার, ৪ঠা আষাঢ়) সকাল বেলায় কুমিল্লার কান্দিরপাড়ের ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় উঠেছিলেন।
নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের বিয়ে যে হয়নি তার আরেক অকাট্য প্রমান রয়েছে নজরুলের মাতৃসম কুমিল্লার বিরজা সুন্দরী দেবীর প্রবন্ধে। যার সম্পাদনা কবি নিজে করেছেন। তিনি তার ‘নৌকা ভ্রমন’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন-“বিয়ে তো ত্রিশঙ্কুর মতন ঝুলতে লাগলো মধ্যপথেই, এখন আমাদের বিদায়ের পালা। ’সুতারাং নার্গিস নজরুলের প্রথম স্ত্রী নন। তিনি নজরুলের বাগদত্তা। প্রমীলাই নজরুলের প্রথম ও একমাত্র স্ত্রী। প্রসঙ্গত প্রমীলাও কুমিল্লার মেয়ে”।
প্রায় ১০-১২ বছরের বড় মুজফর আহমদকে (ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রধানতম ব্যক্তি) নজরুল পিতার মত শ্রদ্ধা করতেন। মুজফর আহমেদ ছিলেন নজরুল ইসলামের একান্ত সুহৃদ ও পৃষ্ঠপোষক। তাই মুজফর আহমেদের কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কিত কোন তথ্যই ভুল হতে পারেনা। কারন মুজফর আহমেদ রচিত ‘‘কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা’’ কে নজরুল বিষয়ক তাত্তি¡করা নজরুলের জীবন সম্পর্কিত যে কোন তথ্যের মূল আকর গ্রন্থ হিসেবে গন্য করে। কাজেই নজরুল-নার্গিসের বিয়ের প্রচলিত উপাখ্যানটি সঠিক নয়।
এমন অকাট্য সাক্ষ্য থাকা সত্বেও দু' বাংলার কিছু মুসলমান লেখক (ইন্টারনেট মেডিয়াতে ভরপুর) আদাজল খেয়ে লড়ে গেলেন এই বলে যে নার্গিসের সঙ্গে বিয়ে সুসম্পন্ন হয়েছিল। তাঁদের লেখায় বিয়ের চুক্তিপত্র বা অন্য কোনও সাক্ষ-প্রমান তাঁরা দাখিল করতে পারেননি। নার্গিস ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। এর মধ্যে ১৯৩৮ সালে নার্গিস বিয়ে করেন আজিজুল হাকিম নামে তখনকার পুর্ব বাংলার এক নজরুল ভক্তকে। এতগুলো বছরের মধ্যে নার্গিসকে দিয়ে কোনও লেখক বলাতে পারেননি যে ১৯২১ সালে নজরুলের সঙ্গে তাঁর বিয়ে সুসম্পন্ন হয়েছিল।
১৯৪২ সালে কবি নজরুল চৈতন্য হারিয়ে ফেলেন। তবু সেই চৈতন্যহারা কবি অবচেতন মনে একদিন কাগজে লেখেন ‘দৌলত- নার্গিসত’ বেঁচেই আছে। ওর ছেলে বুলবুল ত’ বেঁচেই আছে।’ আশ্চর্য বটে- শরীর অসুস্থ, চৈতন্য বিলুপ্ত তবু প্রাণের গহীনে হারানো প্রিয়ার স্মৃতি জাগ্রত।
প্রায় চব্বিশ বছর সংসার অতিবাহিত হওয়ার পর ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে নার্গিসের স্বামী আজীজুল হাকিম মৃত্যুবরণ করেন। একাত্তরের প্রারম্ভে নার্গিস বিলেতে ছেলের কাছে চলে যান। নজরুলের মৃত্যুর পর একবার দেশে এসে নজরুল সমাধিতে গিয়েছিলেন অনেকটা নিভৃতে। ১৯৮৫ সালে ম্যানচেস্টারে একমাত্র সন্তান ডাঃ ফিরোজের বাসভবনে ৮১ বছর বয়সে নার্গিসের মৃত্যু হয়। নজরুল-নার্গিস প্রণয়, না পাওয়া বেদনার হাহাকারে চির প্রজ্জ্বলিত প্রেমের অমর কাহিনী হয়ে আমাদের মাঝে অমলিন হয়ে আছেন।
তথ্যঋণ-
‘নজরুল প্রতিভা’ - মোবাশ্বের আলী
‘নজরুল প্রসঙ্গে’ - রফিকুল ইসলাম
‘নজরুল কাব্যসমীক্ষা’ –আতাউর রহমান
‘কেউ ভোলে না কেউ ভোলে’- শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
কাজী নজরুল ইসলাম “স্মৃতি কথা” কমরেড মুজাফফর আহম্মদ
‘কুমিল্লায় নজরুল স্মৃতি প্রেম ও পরিণয়’- তিতাশ চৌধুরী
“শৈশবের বন্ধু নজরুল” শৈলজানন্দ মুখোপ্যাধ্যায়ের (হরফ প্রকাশনী, কলকাতা ১৩৭৫)