কবি শেখ ফজলল করিম এঁর জীবন ও সাহিত্য নিয়ে কিছু কথা
-মাজহারুল মোর্শেদ

স্কুল পালানো ছেলের গল্প আমরা অনেক শুনেছি কিন্তু স্কুলে যাওয়ার জন্য পাগল ছেলে এমন ক’জনের গল্প আছে? ঠিক তেমনই এক স্কুল পাগল ছেলের জন্ম হয়েছিল আজ থেকে একশ’ তেতাল্লিশ বছর আগে লালমনিরহাট জেলার কাকিনা গ্রামে। সেই স্কুল পাগল ছেলেটির নাম ছিলো ‘শেখ ফজলল করিম’, আদরের ডাক নাম ‘মোনা’।
বৃহত্তর রংপুর জেলার কাকিনা গ্রামে, ১৪ এপ্রিল ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন সেই ছেলেটি। তিনি স্কুলে যাতায়াত শুরু করেছিলেন মাত্র চার-পাঁচ বছর বয়সেই। সেই থেকে শুরু স্কুলের প্রতি গভীর আকর্ষণ। মাঝে মধ্যে কাউকে না বলেই তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে যেতেন স্কুলে। এই স্কুল-আসক্তির কারণে কবিকে বড়দের হাতে মারও খেয়েছে বহুবার। সেই ছোটবেলা থেকেই বই আর জ্ঞান অণে¦ষণের সাধনা তাঁকে ডুবিয়ে রাখতো এক অন্য জগতে। তাই একদিন সেই স্কুল পাগল ছেলেটির নাম হয়ে যায় ‘সাহিত্যবিশারদ’।
শেখ ফজলল করিমের পিতার নাম আমিরউল্লাহ সরদা এবং মাতার নাম কোকিলা বিবি। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর দাদা জশমতউল্লা সরদার ছিলেন কাকিনা রাজবংশের একজন প্রসিদ্ধ কর্মচারী। একান্নবর্তী পরিবারে আত্মীয়-পরিজন মিলে এক বিশাল জমজমাট আসর। বনেদি পরিবারের বাড়ির আদল যেমন হয়, তেমনি ছিল ফজলল করিমের পৈত্রিক বাড়ি। সেই বাড়ির প্রশস্ত কাছারি ঘরের মাঝামাঝি ছিল একটি বিরাট সেক্রেটারিয়েট টেবিল। তাতে থাকত সৌখিন দোয়াতদান ও পাখার নানারকম কলম। এই টেবিলে লণ্ঠনের আলোয় মধ্যরাত পর্যন্ত চলতো তার বিরামহীন সাধনা।
গৃহশিক্ষকের কাছে তাঁর বাল্যশিক্ষা শুরু হয়। ‘রঙ্গপুর দিকপ্রকাশ পত্রিকা’র সম্পাদক হরশঙ্কর মৈত্রেয় তাঁর শিক্ষক ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই কবির লেখা-পড়ার প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ দেখে তাঁর বাবা মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তাঁকে কাকিনা স্কুলে ভর্তি করে দেন। প্রায়  প্রতি বছরেই বার্ষিক পরীক্ষায় ভাল ফলাফলের জন্য তিনি পুরস্কৃত হতেন।
ফলে তাঁর সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে পিতা আমিরউল্লাহ সরদার ষষ্ঠ শ্রেণীতে তাঁকে রংপুর জেলা স্কুলে ভর্তি করে দেন। কিন্তু সেখানে তাঁর মন টিকেনি তাঁই রংপুর জেলা স্কুলে ছেড়ে তিনি আবারও কাকিনা স্কুলে ফিরে আসেন এবং সেখান থেকেই ১৮৯৯ সালে মাইনর পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেন। এরপর তাকে আবারও রংপুর জেলা স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হলে স্কুলের বাধাধরা পড়াশোনায় মন বসাতে না পেরে তিনি সেখান থেকে আবারও ফিরে আসেন এবং জ্ঞানার্জনে উৎসাহী হয়ে নানা ধরণের বই পডতে শুরু করেন।
প্রথমে তার ইচ্ছে ছিল ডাক্তারি পড়ার। সে জন্য তিনি কাকিনা গভর্নমেন্ট ডিসপেনসারির ডাক্তার সরদাচরণ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের অধীনে পড়তেও শুরু করেন এবং ডাক্তারখানায় অনুশীলনও করতেন। কলকাতার ক্যাম্বেল স্কুলেও পড়তে চেয়েছিলেন তিনি কিন্তু তখন কলকাতায় মহামারী রোগ ছড়িয়ে পড়লে, বাবা তাঁকে আর কলকাতায় যাওয়ার অনুমতি দেননি। তিনি বিলাতে ব্যারিস্টারি পড়তেও যেতে চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত সে আশাও পূর্ণ হয়নি তাঁর। শেখ ফজলল করিমের ইংরেজি ও বাংলা হাতের লেখা খুব সুন্দর ছিল। এ জন্য তিনি কাকিনার রাজবাহাদুরের কাছ থেকে একবার শীতবস্ত্র পারিতোষিক হিসেবে লাভ করেছিলেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১১ বছর।
ছাত্রাবস্থায় কাকিনা স্কুলে ৭ম শ্রেণীতে পড়ার সময় তাঁর বিয়ে হয় কালীগঞ্জ উপজেলার বিনবিনিয়া গ্রামের গণি মোহাম্মদ সর্দারের মেয়ে বসিরণ নেসা খাতুনের সঙ্গে। অতঃপর নানা কারণে তার স্কুল জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। দাম্পত্য জীবনে দু’পুত্রের জনক ছিলেন কবি। তাঁর প্রথম পুত্র মাত্র ৩ দিন জীবিত ছিল। দ্বিতীয় পুত্রের নাম মতিয়ার রহমান।
কর্মজীবন-
কবি শেখ ফজলল করিম ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে পাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মেসার্স এমভি কোম্পানীতে চাকুরি নেন। স্বাধীনচেতা ফজলল করিম কোম্পানীর মন যুগিয়ে কাজ করতে না পারায় স্বীয় চাকুরি থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। ত্রিশের দশকে শেখ ফজলল করিম ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। কর্মজীবনে তিনি মুন্সি মেহের উল্লাহর অনুপ্রেরণা ও পরামর্শ পেয়েছিলেন। সাহিত্য সৃষ্টি, প্রকাশনা ও সাধনার পথে ধাবমান শেখ ফজলল করিম কাকিনায় নিজ বাড়িতে তাঁর পীর সাহেব হযরত মাওলানা মুহম্মদ শাহ সাহাব উদ্দিনের নামানুসারে তৎকালীন প্রায় দেড় হাজার টাকা ব্যয়ে “সাহাবিয়া প্রিন্টিং ওয়ার্কস” প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি শেষ জীবন পর্যন্ত লেখার জগত নিয়ে জীবন অতিবাহিত করেন। সাহিত্যের প্রতি শেখ ফজলল করিমের প্রবল আগ্রহের কারণে কর্মজীবন তাঁকে তেমন ভাবে আকর্ষণ করতে পারেনি। ছোটবেলাতেই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা আয়ত্ত করেছিলেন যা তিনি কাজে লাগাতেন গ্রামের দরিদ্র মানুষের সেবায়। তিনি বাড়িতে বসেই দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা করতেন।
সাহিত্য চর্চা-
পল্লী বাংলার নিভৃত কোণে বসে দীর্ঘ রাত পর্যন্ত জেগে থেকে নিরলস ভাবে সাহিত্য সাধনা ও জ্ঞানচর্চা করে গেছেন কবি শেখ ফজলল করিম। কখনো হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে ওঠে পেন্সিল দিয়ে হাতের কাছে পাওয়া যেকোন কাগজে লিখে রাখতেন মনের মধ্যে উত্থিত ভাবের কথা। আশেপাশের জ্ঞান পিপাসু মানুষেরা প্রায়ই তাঁর সাথে আলোচনায় প্রবৃত্ত হতেন। এদিক থেকে তাঁর ছিল জ্ঞান আদান প্রদানের মহৎ ভাবনা। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি গজলের ভক্ত ছিলেন। নিজেও বেশ কিছু বাংলা গজল লিখেছেন। কবির প্রথম বই “সরল পদ্য বিকাশ” মাত্র ১২ বছর বয়সেই তিনি হাতে লিখে প্রকাশ করেছিলেন। এ সময় আধ্যাতিক ও সাহিত্যচিন্তা তাঁকে গভীরভাবে দোলা দিতে থাকে। সাহিত্য চর্চার সুবিধার্থে তিনি নানা পত্রপত্রিকা ও পুস্তক সংগ্রহ করতেন। সে সমস্ত সংগ্রহ নিয়ে তিন ১৮৯৬ সালে নিজ বাড়িতেই করিম আহামদিয়াা লাইব্রেরি নামে একটি ব্যক্তিগত পাঠাগার তৈরি করেন। এভাবে সাহিত্য চর্চা করতে গিয়ে তিনি অনেক ঠাট্টা উপহাসের শিকার হন কিন্তু প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তির কারণে দূর্বার গতিতে চলতে থাকে তার সাহিত্য চর্চা।
কবি শেখ ফজলল করিমের সাহিত্যিক জীবনের উন্মেষ ছোট বেলা থেকেই। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় তিনি “সরল পদ্য বিকাশ” কবিতা গুচ্ছ প্রকাশ করেন। এরপর থেকে তিনি আজীবন সাহিত্য সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর সাহিত্যকর্মে ধর্ম ও নীতি শাস্ত্র বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে। নৈতিক আদর্শে সমৃদ্ধ কবিতা ও গদ্য লিখে তিনি প্রভুত সুনাম অর্জন করেন। মুসলিম ইতিহাস, মুসলিম উপাখ্যান, মুসলিম জীবন ইত্যাদি ছিল তাঁর সাহিত্যের মূল উপজীব্য বিষয়। প্রচুর জ্ঞান পিপাসা ও অনুশীলন তাঁর লেখার জগতকে সমৃদ্ধি করেছে। তাঁর সাহিত্যের উপজীব্য বিষয় ধর্মীয় হলেও দৃষ্টিভঙ্গির উদারতা ও সাহিত্যিক প্রসাদ গুনে তাঁর সৃষ্টি সার্বজনীন হয়ে উঠেছে।
শেখ ফজলল করিমের পরিচিত মূলত: একজন কবি হিসেবে কিন্তু আমরা দেখি তিনি কবিতা ও কাব্য ছাড়াও লিখেছেন অসংখ্য প্রবন্ধ, নাট্যকাব্য, জীবনী গ্রন্থ, ইতিহাস গনেষণামূলক নিবন্ধ, সমাজ গঠন মূলক তত্বকথা, গল্প, শিশুতোষ সাহিত্য, নীতি কথা, চরিত গ্রন্থ এবং বিবিধ সমালোচনামূলক রচনা, সাহিত্যের সকল শাখায় ছিল তাঁর পদচারণা। পুঁথি সম্পাদনার ক্ষেত্রেও তার পরিচিতি পাওয়া যায়। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের মে’ মাসে তিনি কাকিনা থেকে “বাসনা” নামে একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। “বাসনা” পত্রিকাটি দু’বছর চালু ছিল। সাহিত্যের মাধ্যমে হিন্দু মুসলমান মিলন সম্ভব এটি ছিল তাঁর অভিমত। এই পত্রিকায় হামেদ আলী, শেখ রেয়াজ উদ্দীন আহমদ, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, তসলিম উদ্দীন আহমদ (রংপুর এর প্রথম মুসলিম গ্রাজুয়েট) এবং আরো অনেক স্বনামখ্যাত ব্যক্তির লেখা প্রকাশিত হতো। ঐ সময় “বাসনা” পত্রিকাটি ছিল পূর্ববঙ্গের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাসিক পত্রিকা।
মাত্র ৫৪ বছরের জীবনকালে তার রচনার সংখ্যা নেহাত কম না। বিভিন্ন সুত্র থেকে শেখ ফজলল করিমের প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত গ্রন্থের তালিকা অনুযায়ী আমরা তার ৫৮ টি রচনার সন্ধান পাই। নীচে শেখ ফজলল করিমের রচনাবলী ও গ্রন্থের নাম পাঠকদের কাছে তুলে ধরা হল-
১) সরল পদ্য বিকাশ (বাল্য রচনা) ২) মদন ভস্ম (বাল্য রচনা) ৩) মানসিংহ (১৯০৩ খ্রি.) ৪) তৃষ্ণা (কাব্য) ১৯০০ খ্রি.  ৫) ছামীতত্ব বা ধর্মসঙ্গীত (১৯০৩ খ্রি.) ৬) পরিত্রাণ (কাব্য) ১৯০৪ খ্রি ৭) ভগ্নবীণা বা ইসলাম চিত্র (১৯০৪ খ্রি.) ৮) লাইলি মজনু (১৯০৪ খ্রি.)  ৯) মহর্ষি খাজা মইন উদ্দীন চিশতি (রা.) জীবণী ১০) মহর্ষি ইমাম রব্বানী মোজাদ্দাদে-আল ফসানী (১৯০৫ খ্রি.),  ১১) আফগানিস্তানের ইতিহাস (১৯০৯ খ্রি.১২) ভক্তি পুষ্পাঞ্জলী (১৯১১ খ্রি. ১৩) গাঁথা (১৯১৩ খ্রি.)  ১৪) চিন্তার চাষ (১৯১৬ খ্রি.) ১৫) হারুন-অর-রশিদের গল্প (১৯১৬ খ্রি.) ১৬) সোনার বাতি (১৯১৮ খ্রি.) ১৭) বিবি রহিমা (১৯১৮ খ্রি.) ১৮) পথ ও পাথেয় (১৯১৮ খ্রি.) ১৯) জোয়ার ভাটা (১৯১৮ খ্রি. ২০) রাজর্ষি এবরাহিম (১৯২৫ খ্রি.) ২১) বিবি খাদিজা (১৯২৭ খ্রি.) ২২) বিবি ফাতেমা (১৯২৭ খ্রি.)        ২৩) মাথার মনি(১৯২৮খ্রি.)২৪) প্রেমে স্মৃতি (কোহিনূর পত্রিকায় প্রকাশিত)  ২৫) উচ্ছাস, ২৬) রাজর্ষি মহিমা রঞ্জন
২৭) মহর্ষি হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রা.)  ২৮) পয়গাম্বরগণের কাহিনী  ২৯) কমলা দেবী ৩০) হারানো ধন                                     ৩১) গোলেস্তা ৩২) মানিক জোড় ৩৩) একেশ্বরবাদ (বাসনা পত্রিকায় প্রকাশিত) ৩৪) ছেলেদের সেক্সপিয়র,              ৩৫) বাগ ও বাহার ৩৬) ত্রিস্রোতা ৩৭) মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ সাহেবের স্বর্গারোহনে মর্মগাঁথা ৩৮) প্রতিদান (উপন্যাস-সওগাত ১৩২৫ প্রকাশিত) ৩৯) বিবি আয়েশা ৪০) মোহাম্মদ চরিত ৪১) বেহেস্তের ফুল ৪২) চাঁদ বিবি (সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত)  ৪৩) পথের আলো ৪৪) প্রতিশোধ (সামাজিক উপন্যাস) ৪৫) পান্থশালা, ৪৬) পরশমনি ৪৭) ওমর খৈয়ামের অনুবাদ (সওগাতে প্রকাশিত) ৪৮) যীশু খ্রিষ্টের জীবনী সমালোচনা ৪৯) আল হারুন ৫০) পৌত্তলিকতার পরিমান ও একেশ্বরবাদ, ৫১) কাস্তনামা (সম্পাদিত পুথি) ৫২) রাজা মহিমারঞ্জনের পশ্চিম ভ্রমণ ৫৩) চমচম (ছোটদের কবিতা) ৫৪) হাতেম তাই এর গল্প ৫৫) আমার জীবন চরিত ৫৬) রাজা মহিমারঞ্জন শোকগাঁথা, ৫৭) সরদার বংশ চরিত ৫৮) মুন্সী মেহেরুল্লাহ শোকগাঁথা।
এছাড়াও প্রচারক, নবনূর, কোহিনূর, বাসনা, মিহির ও সুধাকর, ভারতবর্ষ, সওগাত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, আরতি, কম্পতরু শিশু সাথী, মোসলেম ভারত, মাসিক মোহাম্মদি, বসুমতী ইত্যাদি পত্র-পত্রিকায় শেখ ফজললকরিমের অসংখ্য কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, উপন্যাস, অনুবাদ প্রকাশিত হয়। সমকালীন মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে তার অবস্থান ছিল প্রথম সারিতে।
সাহিত্যসাধনা ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। তাঁর কাব্য ভাবনা ও সাহিত্যসাধনা প্রধানত ধর্মীয় বোধ ও নীতি-চিন্তা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তিনি ইসলাম ধর্মের আলোকে মুসলমানদের মধ্যে আদর্শ জীবনযাত্রা এবং নীতি-উপদেশ শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। তিনি চিশতীয়া সুফিমতের সমর্থক ছিলেন। তাঁর রচনায় ওই মতের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তবে তিনি সমকালের জীবন-যন্ত্রণা ও সমাজ-সমস্যার কথা উপেক্ষা করেননি। বিশেষত মুসলিম সমাজের নানা দুঃখ-দুর্দশা তাঁর মনকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। এ সমাজের জাগরণ তিনি কামনা করতেন। বাঙালি মুসলমানের ভাষা নিয়ে সঙ্কটের সময় বাসনা পত্রিকা বাংলা ভাষার স্বপক্ষে দাঁড়িয়েছিল। হিন্দু-মুসলমান মিলনাকাঙ্খা ছিল এ পত্রিকার প্রধান লক্ষ্য। হিন্দু-মুসলমান সঙ্কটের সময় শেখ ফজলল করিম রচনা করেন-
“কোথায় স্বর্গ? কোথায় নরক? কে বলে তা বহু দূর,
মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেতে সুরা-সুর।
রিপুর তাড়নে যখনই মোদের বিবেক পায় গো লয়,
আত্মগø¬ানির নরক অনলে তখনি পুড়িতে হয়।
প্রীতি ও প্রেমের পুণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরস্পরে,
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরই কুঁড়ে ঘরে।”
কবির “স্বর্গ ও নরক” নামের কালজয়ী কবিতাটি ১৩২১ বঙ্গাব্দের আষাঢ় সংখ্যা ভারতবর্ষে প্রকাশিত হয়েছিল। কবির এই কবিতাটি “বঙ্গবানী” ও কবি “মালঞ্চ” নামক দুটি স্কুল পাঠ্যপুস্তকেও গৃহীত হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সিলেবাসে তাঁর কবিতা পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। “কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক?” বিখ্যাত কবিতার কবি হিসেবে সমগ্র বিশ্বে তিনি আজও সুপরিচিত।
কবি শেখ ফজলল করিমের নাম এখন অনেকেই ভুলে গেছে। কিন্তু তাঁর লেখার প্রতিটি শব্দ তাঁকে এখনও মনে করিয়ে দেয়।
গায়ের ডাক (শিশুসাথী, বৈশাখ ১৩৩৮)
ধানের ক্ষেতে বাতাস নেচে যায়
দামাল ছেলের মতো,
ডাক দে’ বলে আয়রে তোরা আয়
ডাকব তোদের কত!
মুক্তমাঠের মিষ্টি হাওয়া
জোটে না যা ভাগ্যে পাওয়া,
হারাস্ নে ভাই অবহেলায় রে
দিন যে হল গত।
১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দের ১লা এপ্রিল (১৩০৫ বঙ্গাব্দের ২০ চৈত্র) কাকিনার রাজা মহিমা রঞ্জনের মৃত্যু হয়। তিনি ছিলেন রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষদের আজীবন সভাপতি। তার মৃত্যুর পর ১৩১৬ বঙ্গাব্দের ১৭ আষাঢ় তারিখে রংপুর জেলা স্কুলে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মি, জে. ভাসের সভাপতিত্বে রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে একটি স্মৃতি সংরক্ষণ সভার বিশেষ অধিবেশন হয়। ঐ অধিবেশনে শেখ ফজলল করিম পাঠ করেছিলেন তাঁর লেখা “রাজর্ষি মহিমা রঞ্জন” নামক এক দীর্ঘ প্রবন্ধ। এটি পরবর্তীতে ঐ বছর (১৯০৯ খ্রি.) কলকাতা মেটকাফ প্রেস থেকে ছাপিয়ে প্রকাশ করেছিল “রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষৎ”। সে প্রবন্ধে শেখ ফজলল করিমের ভাষা ছিল----
“লোকে বলে রাজা মহিমা রঞ্জনের মৃত্যু হইয়াছে। সত্যিই কি তাই? আমি বলি ইহা সম্পূর্ণ সত্য কথা নহে। মহিমা রঞ্জনের নশ্বর অংশটুকু লোক লোচনের বহির্ভূত হইয়াছে সত্য কিন্তু প্রকৃত মহিমা রঞ্জন কি বিলয় হইতে পারেন? দেশের অস্থি-মজ্জায়, যাহার দয়া-দান ও উপচিকীর্ষা জড়িত হইয়া আছে, জনসাধারণের হৃদয় সিংহাসনে যাহার অমর স্মৃতি চির জাগ্রত রহিয়াছে, তাহার কি মৃত্যু সম্ভব। আমরা তাঁহার স্মৃতি রক্ষার জন্য যতই যাহা করিনা কেন, আমাদের হৃদয় রাজ্যে তাঁহার যে সুউচ্চ স্মৃতি স্তম্ভ উত্থিত রহিয়াছে, তাহার নিকট সকল স্মৃতি ক্ষণভঙ্গুর।
শিশুসাথী, ফাল্গুন ১৩৩৮ বঙ্গাব্দ
চাঁদের বুড়ি
থুড়ি থুড়ি
ঘুম দিয়ে যা।
বনবাদাড়ে হুতুম ডাকে
হুম্, হুম্, হুম্
আকাশ ছেপে শব্দ ওঠে
গুম্, গুম্, গুম্
খোকা ভয়ে ডাকে-- মা।
তুই পা টিপে আয় চুপি চুপি
ঘুম দিয়ে যা।
মৃত্যুর পূর্বে শেখ ফজলল করিম তাঁর নিজের জন্য কবিতা লিখে রেখে গেছেন-
আর্দ্র মহীতলে হেথা চির-নিদ্রাগত
ব্যাথাতুর দীন কবি, অফুরন্ত সাধ,
ভূলে যাও ত্রুটি তার জনমের মত,
হয়তো সে করিয়াছে শত অপরাধ।
পান্থ পদরেণু পুত্র এ শেষ ভবন,
হতে পারে তার ভাগ্যে সুখের নন্দন।
কবি মনে করেছিলেন মধুসূদনের সমাধি ফলকের উৎকীর্ণ কবিতার মতো উক্ত কবিতাটির হয়তো বা লেখা থাকবে তাঁরও সমাধিতে। মৃত্যুর ১৮৩ বৎসর পরও কি আমরা তাঁর শেষ ইচ্ছেটুকু পূরণ করতে পেরেছি? মাত্র ৫৪ বছরের জীবনকালে তার রচনার সংখ্যা অনেক। এসকল সাহিত্যকর্মের জন্য স্বীকৃতিও তিনি কম পাননি।
‘পথ ও পাথেয়’(১৯১৮ খ্রি.) গ্রন্থের জন্য তিনি রৌপ্য পদক পান।
১৩২৩ সালে নদীয়া সাহিত্য পরিষদ তাকে ‘সাহিত্যবিশারদ’ উপাধিতে ভ‚ষিত করে।
‘চিন্তার চাষ’ গ্রন্থের জন্য তিনি লাভ করেন ‘নীতিভূষণ’ উপাধি।
১৩৩১ সালে খিদিরপুর মাইকেল লাইব্রেরি থেকে মধুস্মৃতি কবিতার জন্য তিনি রৌপ্য পদক পান।
একই কবিতার জন্য শ্রীভারত ধর্ম্মমহামÐল থেকেও রৌপ্য পদক পান তিনি।
১৯৩৪-৩৫ খ্রিস্টাব্দের বাংলা সরকারের জুট রেসট্রিকশন রৌপ্য পদকও পান তিনি।
এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি পেয়েছিলেন ‘কাব্যভ‚ষণ’, ‘সাহিত্যরতœ’, ‘বিদ্যাবিনোদ’, ‘কাব্য রতœাকর’ প্রভৃতি উপাধি ও সম্মান।
‘বাসনা’ পত্রিকা সম্পাদনাকালে, ‘রোমিও জুলিয়েট’ সম্পর্কিত তার একটি কবিতা পাঠ করে কলকাতার কিছু বিশিষ্ট সাহিত্যিক তাকে ‘বাংলার শেক্সপিয়র’ উপাধি পর্যন্ত দিয়ে দেন।
উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে অবিভক্ত বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বাঙ্গালী মুসলমানদের অবস্থান মোটেও সুদৃঢ় ছিলনা। ব্রিটিশ ভারতে তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা ছিল সুস্থ মননশীল সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। কবি শেখ ফজলল করিম সে সময়ে কবি বা গদ্য লেখক হিসেবে তিনি তাঁর সাহিত্যের মাধ্যমে সুপরিচিত হয়েছিলেন। এটা তাঁর অসীম কৃতিত্বের পরিচয়।
অবিভক্ত বাংলায় রংপুরের গৌরবোজ্জল কবি শেখ ফজলল করিমের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। বৃহত্তর রংপুর তথা নিজ জন্মভূমি লালমনিরহাটের কাকিনায় কবি শেখ ফজলল করিমের নামকরণে তেমন কিছুই নেই। চির অবহেলিত লালমনিরহাট জেলার  উর্ধগগণের এক অ¤øান নক্ষত্র কবি শেখ ফজলল করিমের নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় হোক এটা আমাদের প্রাণের দাবী।
কবি শেখ ফজলল করিমের কবর ও সাহাবিয়া প্রিন্টিং প্রেসে ব্যবহৃত জিনিসপত্রাদি এবং নানা স্মৃতিচিহ্ন আমরা দেখতে পাই কবি বাড়িতে। সংরক্ষনের অভাবে এগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নানা আশ্বাস, নানা প্রতিশ্রæতি এবং নানা উদ্যোগ সত্বেও কবি বাড়িতে কিংবা কাকিনায় তাঁর সম্পর্কে গবেষণা করার ক্ষেত্র কিংবা স্মৃতি রক্ষার সমন্বিত আয়োজন আমরা লক্ষ্য করিনা। যেটুকু হয়েছে তা উল্লেখযোগ্য নয়।
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয় হয়ে রয়েছেন তাঁদের মধ্যে শেখ ফজলল করিম হলেন অন্যতম। বরেন্য কবি ও সাহিত্যিক শেখ ফজলল করিম ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে আকস্মিকভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন ( ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইলাইহে রাজিউন) কবি তাঁর নিজ ভবনের পাশেই চিরশায়িত আছেন।
বাংলার নিভৃত পল্লির এই লেখক, আমাদের প্রিয় কবি আজ আমাদের মাঝে নেই। তবে তার রচিত রচনাগুলো আজও বাংলা সাহিত্যের আকাশে উজ্জল নক্ষত্রের মতো জ্বল জ্বল করে জ্বলছে।
তথ্য সহায়তা-
বহিঃসংযোগ বাংলাপিডিয়া- শেখ ফজলল করিম, ৩ আগাস্ট, ২০১৪।
দৈনিক ইনকিলাব, ৩মার্চ, ২০২৩
দৈনিক প্রথম আলো, ১৩ই এপ্রিল, ২০০৮।
কবি শেখ ফজলল করিমের গ্রন্থাবলী