মেলা থেকে কেনা বারো টাকার টিনের স্টিমার
শৈশবে আমার চোখের ঘুম কেড়ে নেয়।
চাদরি টিনে বানানো স্টিমারের গঠনশৈলী
এবং এর অদ্ভুত কর্মমূখরতা
আমাকে বাণীচিত্রের মতো আবেশিত করে রাখতো।
স্টিমারে কেরোসিন ঢেলে নির্ধারিত সলতেতে আগুন দিয়ে
পুকুরে ছাড়লে রূপসি জলকন্যার মতো জলে ঢেউ তুলে
সে পটপট শব্দে চলে যেতো সাঁতার দূরত্বে
আমার নাগালের বাইরে।


নবিউদ্দিন ছিল আমার বয়সে ছোট।
বলা চলে সে আমার অনির্ধারিত বিশেষ খাসনবিশ।
আমি জলে নামতে ভয় পেলেও
সে খুব ভালো সাঁতার পারতো।
আমার চোখের ইশারা পেলে সে বাজপাখির মতো
মাঝ পুকুর থেকে ছোঁ মেরে তুলে আনতো ওটাকে।


আমি খুব ভালো উপলব্ধি করতাম নবিউদ্দিনের
একটা স্টিমারের খুব শখ ছিল।
স্টিমার কেনার সামর্থ ছিল না বলে ভেতরে ভেতরে তার
অব্যক্ত আফসোস ছিল।
তবে উচ্ছ্বাস তার সুপ্ত দুঃখকে সবসময়ই ছাপিয়ে যেত।
আমি আমার সামর্থের অহমিকা দিয়ে যত না স্টিমার
নিয়ে খেলতাম,
তার চেয়ে তার কষ্টটাকে নিয়ে বেশি নির্দয়ভাবে খেলতাম।


আমি বহুভাগ্য যুবরাজের মতো আমার মর্জি মাফিক স্টিমার
জলে ভাসাতাম আবার সহসা তুলে এনে বাক্সবন্দি করতাম।
নবিউদ্দিন প্রায়শ আরও কিছুক্ষণ জলে স্টিমার চালানো খেলার
আকাঙ্খা নিয়ে আমার পিছু পিছু আমার ঘর পর্যন্ত আসতো।
আমি স্টিমারকে তাকে রেখে দেয়া পর্যন্ত
মলিন বদনে সে তা অনুসরণ করত।
এছাড়া নবিউদ্দিনের কিছু বলার বা প্রকাশের সাহস ছিল না।
আমি আরও জানতাম নবিউদ্দিনের একটা স্টিমার
কেনার সামর্থ নেই।
কারণ তার বাবা ছিল আমাদের সবচেয়ে কম মজুরির ভৃত্য।
পুরো পরিবারকে উপবাসে রেখে নবিউদ্দিনের উটকো শখ
পূরণ করতে সে কখনোই ব্রত হবে না।


ঠিক এক বছর পরের কথা।
এক সকালে স্টিমারের শব্দে আমার ঘুম ভাঙে।
শুনতে পাই আমার শোবার ঘর ঘেঁষা পুকুরের দিক থেকে
আসছে পটপট শব্দ।
আমি আমার স্টিমার খুঁজে দেখি
সেটা যথাস্থানেই আছে।
তাহলে?
একদৌড়ে পুকুরে যাই
দেখি সত্যিই স্টিমার চলছে।
নবিউদ্দিন পুকুর জলে পায়ের গোড়ালি ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে।
আমি সবিষ্ময়ে জিজ্ঞেস করি, নবিউদ্দিন?
নবিউদ্দিন মিন মিন করে বলে- দাদা, বাবা কিনে এনেছে।
অনেক বায়না করেছিলাম।
কাল চাল না কিনে বাবা আমার জন্য স্টিমার কিনে এনেছে।


নবিউদ্দিনের শখের বাস্তবায়ন দেখে আমি প্রচন্ড দুলনি খাই।
সে দুলনিতে আমার অহমিকারা এক মস্ত পেন্ডুলামে আছড়ে
পড়ে কাচের পানপাত্রের মতো বিচূর্ণ হতে থাকে।
লঙ্কাদাহনের কষ্ট বিস্তার লাভ করে আমার মধ্যে।
আমি বুঝে পাই না কোথায় মুখ লুকাই।


কিন্তু তুই তেল পেলি কই?
চাল নেই তো দাদা আজ রাতে তাই ভাত হবে না।
আমি কুপির তেলটুকু নিতে কান্না করছি অনেক।
অবশেষে
কুপিতে যা ছিল মা ঢেলে দিয়েছে।


সেরাতে
কানে লেগে থাকা নবিউদ্দিনের স্টিমারের শব্দে
আমার ঘুম আসেনি।
আর নবিউদ্দিন, ব্যাটা অনাহারে থেকেও দিব্যি ঘুমিয়ে পড়েছিল।