প্রতিদিন এমন একটাি করে কবিতা ব্যাখ্যা করতে চাই আপনাদের! আপনারা কমেন্টে সাড়া দিলে, আপনার সেরা লেখাটি  নিয়ে করব আলোচনা।  


কবি জুপিটার পঞ্চমী  রচিত  "কাগজের বই"  কবিতা এবং কবিতাটির বিশ্লেষণ। সময় থাকলে পড়তে পারেন,অনেক কিছু শেখার আছে এই কবিতায়।


শিরোনামঃ কাগজের বই
কলমেঃ    জুপিটার পঞ্চমী
***********
কাগজের বই
সাদাকালো
পেন্সিলে আঁকা সরলরেখার মার্জিনস।
পাতার ভাঁজে শুকনো ফুল।
আর অন্ধকার রাত্রিতে অনিষ্টকারী জাদুকরী চুল।
আর ভুলে যাওয়া ট্রেনের টিকিট।
আর সিলমোহর লেখা ভিসা।
আর চোখের জলে ভেজা বর্ণমালা।
তারা চিরন্তন ...
অবিচ্ছেদ্য প্রেমিক হিসেবে...
তাদের সরিয়ে নিলে কাগজ গুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় ।
কাগজের বই
দূরবর্তী উজ্জ্বল আলোর সময়
আর কাগজের গন্ধ।
আর ঐ পুরু লাইনগুলো কাছ থেকে দেখার সময় নির্দিষ্ট শব্দের নিচে থাকে...
শুধু লাইন নয়,আমাদের আত্মার আঁচড় ।
আর কাগজের বই থেকে আমাদের আত্মা ই-বুকে
যেতে নাহি চায়।


বিশ্লেষণঃ (মৃত আত্মা)  


জীবনের প্রবাহকে সামনে রেখে দূরন্ত শব্দের প্রয়োগ এবং বিলীন হতে থাকা ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরার শক্ত মানসিকতা নিয়ে  কবি  "জুপিটার পঞ্চমী'র"  রচিত  "কাগজের বই" কবিতা।কাগজ থেকে আমাদের চেতনা হারিয়ে যেভাবে প্রযুক্তির দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তাতে আমাদের ঐতিহ্য ধরে রাখা দূষ্কর।


ছোট ছোট নিঃশব্দ ফাঁপা আবেগ নিয়ে শব্দটা মগজ গলে বেরিয়ে আসে,


" কাগজের বই
সাদাকালো "


দুটা অস্ফুট শব্দের ঝনঝনানি। আমরা প্রযুক্তির দিকে যতই এগিয়ে যাচ্ছি, ততই,আমাদের মনে সরলরৈখিক রেখা টেনে ধরে সাদাকালো সেই আবহমান জীবন। শত দূর্দশা সাদাকালো পৃষ্ঠার মোড়কে থাকলেও, সেই জীবনটাই ছিলো আনন্দের।


আসলে, "কাগজের বই
সাদাকালো"
শব্দটি যদিও আমাদের একপাক্ষিক দৃষ্টিকোণ থেকে ঐতিহ্যই চোখে পড়ে,কিন্তু, সামগ্রিক দিকে আমাদের প্রবাহমান জীবনকেই ধারণ করেছে।


তৃতীয় লাইনের বাক্যটি দার্শনিক চিন্তাধারায় এক গভীর ছাপ ফেলে।


"পেন্সিলে আঁকা সরলরেখার মার্জিনস!"


যদিও,বাক্যটি সরল বাক্য মনে হয়।কিন্তু, তাৎপর্য বিশ্লেষণে ফুটে উঠে এক চিন্তাধারার বিপ্রকর্ষ। আমাদের, জীবন দুই ভাগে বিভক্ত। মার্জিন টানার মাঝে দুই অংশ বিভক্ত হয়।উপরের টা হলো দুঃখ, আর বামপাশের টা হলো সুখ;মধ্যবর্তী অংশ হলো আমাদের জীবনের ফাঁকাস্থান,আর,পেন্সিল হলো গতিধারা।আমাদের গতিধারা দিয়ে জীবনের ফাঁকা স্থান লিখে যেতে হয়,তার ফল কেমন হবে তা আমাদের উপস্থাপন অনুযায়ী বিশ্লেষিত।


গতিপ্রবাহের মাঝেও ছোট ছোট খুনসুটি দিয়ে তৈরী হয় আমাদের জীবনের ভাবধারা।ক্ষানিকটা স্মৃতি অনুযোগে চতুর্থ লাইন ফুটে উঠে।


"পাতার ভাঁজে শুকনো ফুল"


আমাদের জীবনের গদ্যধারা সামনে রেখে স্মৃতির আবির্ভাব ঘটতে পারে।তা,যুগের তালে মিশে পদ্যের ছন্দে রুপান্তরিত হয়।শৈশবের স্মৃতি যোগ করতেই তাই, কবি, এই বাক্যটি ব্যবহার করেছেন।


"আর,অন্ধকার রাত্রিতে অনিষ্টকারী
জাদুকরী চুল"


এই বাক্য শিল্পগুণে সমৃদ্ধ। উচ্চ মাত্রার কবিতার জন্য বিশেষ কয়েকটি গুণ থাকতে হয়।আর এই বাক্যগুলো কবিতার ক্ষেপণাস্ত্র হিসেবে চিহ্নিত। এতে, পড়ার প্রতি পাঠকের মনোযোগ উপলব্ধি করা হয়।বিশেষত্ব অনুযায়ী, এই দুই লাইন কবিতার তেমনি একটা সংস্কার।শৈল্পিক গুণধারা চিহ্নিত করে বাক্য দুটি।


তারপর, কবিতার লাইনগুলো চোখে জল আনার মতো করে উপস্থাপিত হতে থাকে।গতিপথে ঝনঝনানি স্মৃতির দুটানা অশ্রুসিক্ত করা আবেগে দিগন্ত উন্মোচিত করতে লিপ্ত হয়।যার,প্রতিটি শব্দই কালের পিঠে হারিয়ে যাবার মতো।বিচক্ষণ আলোকপাতে কবিতায় ব্যবহৃত শব্দের প্রয়োগ শিখায় কবিতাটি।


"আর ভুলে যাওয়া ট্রেনের টিকিট
.........…..…….…
………………………
কাগজ গুলো ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায়"


বই পড়তে-পড়তে নানা খুনসুটি আমাদের নজর এড়ায় না।কখনো,বইয়ের মাঝে হারিয়ে যাই, "অপু-দূর্গার " স্মৃতিতে,আবার,কখনো,অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ি, "দেবদাস" উপন্যাস পড়ে।আবার কখনো,"বিদ্রোহী " পড়ে চেতনায় জেগে উঠি।বইয়ের পৃষ্ঠায় আঁকা-বাঁকা ছাপ ফেলি কলমের নিবে।আবার,কখনো,প্রেমের অভিসম্পাত নিয়ে অযথাই,বইয়ের ভিতর নামের অক্ষর লিখি।যা, পরবর্তীতে আমাদের স্মৃতির আ্যালকোহল হয়ে ধরা দেয়।


এরপর, পর-পর তিনটি লাইন আমাদের মস্তিষ্কে চিন্তাধারা আনার মতো করে উপস্থাপিত হয়েছে।


"কাগজের বই
.....
.....
... কাগজের গন্ধ!


বইয়ের ভিতর যে সুমিষ্ট স্বাদ পাওয়া যায়, তা কৃত্রিম ভাবে কখনো পাওয়া সম্ভব নয়।বই পড়ে যে আনন্দ তৃপ্তি পাওয়া যায়,তা আমাদের গভীর ভাবে ভাবতে শেখায়।কিন্তু, বর্তমানে প্রযুক্তির কালগ্রাসে তা প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে।


তারপরের তিনটি লাইন,


" আর ঐ পুরু লাইনগুলো....
...
...
..আমাদের আত্নার আঁচড় "


হ্যা,এটা আমাদের পর্যবেক্ষণতাকে প্রাধান্য দেয়।পড়ার সময় কোনো লাইন খুব ভালো লাগলে,অথবা,জীবনের সাথে মিলে গেলে আমরা যেমন, লাইনটি চিহ্নিত করার জন্য নীচে দাগ দিয়ে রাখি,সেরকমটাই বোঝানো হয়েছে। কিন্তু, কৃত্রিম ভাবধারা আমাদের এ আহ্লাদটিকে গলা টিপে হত্যা করছে।


শেষ লাইনগুলো,


"আর, কাগজের বই থেকে আমাদের আত্না ই-বুকে
যেতে নাহি চায়"


রহস্যের গাম্ভীর্যতার সর্বশেষ পরিণতি টানা হয়েছে। উপরোক্ত, কবিতা পড়ে সবার মনেই রহস্য জাগবার কথা।আর,এই রহস্যময় কবিতার যথার্থ কতটুকু তা কবি নিজেই শেষে বলে দিয়েছেন।এক অতৃপ্ত চাওয়া-পাওয়া!বই থেকে হারিয়ে যাবার যে অনুশোচনা তা আমাদের উপলব্ধি করাতে চাচ্ছেন।


আলোচনাঃ  বর্তমান পাঠক সমাজের বই পড়ার প্রতি অনীহা থেকে যদিও কাল্পনিক শিল্পগত ভাবে কবিতাটি সৃষ্টি, সর্বোপরি, আমাদের জীবনের গতিধারা বিচক্ষণ করার জন্য কবিতাটি উপযুক্ত। প্রযুক্তির কাছে হেরে যাচ্ছে আমাদের ঐতিহ্য, যার, একটা অন্যতম উদাহারন মাত্র "কাগজের বই"। পাঠক তেমন নেই আগের মতো বই পড়ার।যা আছে, তা প্রযুক্তির কাছে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। আর,এই বিষয়টি কবির মনে ভীষণ ভাবে দাগ ফেলেছে। বই পড়ার মাঝে যে আনন্দ আছে, তা কখনো ই-বুক থেকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।বইয়ের ভিতর যে আবেগ টানা হয়,তা ই-বুকে পড়লে, যন্ত্রচালিত আবেগের মতো মনে হয়।সুতরাং, এক অতৃপ্ত আহ্বান এই ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য। এর জন্য একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে,


" নদীর অভাব কখনো সুইমিং পুল দূর করতে পারে না!"