পঞ্চাশ বছর আগে এক তরুণী
ভিন গাঁ হতে পালকি চড়ে
এসেছিলে এই গাঁয়
হয়ে এক তরুণের ঘরণী ।


তার সাজানো রঙ্গিন পালকি
ওহৈ!ওহৈ!গানরত বেহারা বাদকের দল
নাচতে নাচতে এসে
থেমেছিল এ আঙিনা কাঁঠালতলায়।
এ গাঁয়ের লোক তারে ভালোবেসে
ফুল-চব্দন দুগ্ধ-ক্ষীর গীত-গানে
করেছিলে বরন কতনা উৎসবে।
তার বধূবরণ শাড়ীর আঁচল
পায়ের আলতা হাতের মেহেদী চুলের সুগন্ধি
বদলে দিয়েছিলো এই বাড়ীর সমস্ত চৌহদ্দি।


প্রশংসা-অনুষ্ঠান-ব্যস্ততায় দুপুর গড়িয়ে বিকেল
হলুদ হলুদ রোদ হলুদ দিগন্ত মায়া
দেবদারু ঝাউ হরিতকী জামের নিথর ছায়া
অচেনা অচেনা কিশোর কিশরীর হৈ চৈ
সারা বাড়ী সারা উঠোন সারা মন
কেমন আনমনা আনচান করে তাঁরে!


নিসাড় বেদনায় একে একে মনে পড়ে
সেই ফেলে আসা আপন গ্রাম সাথীদের নাম
হাটখোলা মঠখোলা বটতলীর পথ
দাড়িয়াবাধা বউচি খেলার দুরন্ত ক্ষণ
মেলায় ফেরা ভেলায় চড়া শাপলা শালুক চেঁচুড়ীর বন।
ভাবতে ভাবতে আহারে
কাজল টানা আঁখি স্বজলে ঝাপসা হয়ে আসে।
তবুও সাথীর নতুন সোহাগ নতুন বাণী
নতুন গৃহ নতুন আঁচলচাবি নতুন দিনের হাতছানি
মুছে চোখের পানি নতুন মায়ায় বাঁধে।


তারপর দিন যায় উঠোন কুড়ায় ধান ছড়ায়
শ্বাশুড়ির সাথে এটা সেটা কত কী রাঁধে
তরুণের গামছা গোছায় আলনা আলমারি সাঁজায়
দেবরের বায়না পোশায় ননদিনীর চুল বাঁধে
মাঝে মাঝে তরুণকে খোঁপা বেধে দ্যাখায়।
এমনি করে সেই পঞ্চাশ বছর আগে
পুঁইয়ের মাচা মুরগীর খাঁচা হাঁসের ছানার আহার
যোগাতে যোগাতে রঙিন স্বপ্ন তাঁর
আবদ্ধ হয় এ সংসারের মায়া্র আশায়।


তারপর দিন-মাস-বছর
সুখ দুঃখের কত স্মৃতি কালের পঞ্জিকায়
একে একে জমা হয় এ উঠোনে
তাঁর তিন প্রজন্মের হামাগুড়ি
সকাল দূপুর বিকেলের ছায়া
চোখের সামনেই কেমন রং বদলায়
ভাবতেই নিজেরে নিজে
কেমন অচেনা অচেনা মনে হয়?


পঞ্চাশ বছর পর আজ
এ উঠোন থেকেই তাঁকে দেয়া হবে বিদায়
এ উঠোন থেকেই উঠে যাবে তাঁর শেষ বিদায়ের পালকি
এ উঠোনে ভেঙে পড়া মানুষ করবে তাঁর শেষকৃত্য-গুনকীর্তন।


বড় আশ্চর্য এ সংসার!
মানুষের নিজের ছায়াও একদিন
নিজের সাথেই চলে যায়
শুধু ছায়ার মত পড়ে থাকে তার সকল কৃতি।