জীবন ধারনের জন্য অন্ন অপরিহার্য। তার পরেই যে সকল নাম আসে তা হলো বস্ত্র ও বাসস্থান। কিন্তু এককালে বস্ত্র ও বাসস্থান অপরিহার্য ছিল না। তবে দ্বিতীয় অপরিহার্য বিষয় ছিল আনন্দ উৎসব। মানুষের সবচেয়ে উল্লখযোগ্য অবদান হলো কৃষিকার্যের আবিস্কার। আর তাতে যখন মানুষ সফল হলো তখন মানুষের আনন্দের সীমা রইল না। তার বহিপ্রকাশ ঘটলো নাচ, গান ও নানান উৎসবের মাধ্যমে। ০৭/০৯/১৯ তারিখের আনন্দ বাজার পত্রিকায় একটা বিতর্কিত বিষয় ছাপা হয়েছিল "আর্যরা বিদেশ থেকে এসেছিল না কি ভারতীয়?" সে বিতর্ক ঐতিহাসিকদের জন্য ন্যস্ত থাকুক।তবে ভারতের আদিবাসীগণই যে কৃষিকার্যের সূচনা করেছিলেন তাতে কোন দ্বিমত  নেই।আর সেই সঙ্গে বিভিন্ন আচার, অনুষ্ঠান, উৎসব, নাচগান ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি।
     ভারতের মূল নিবাসীদের মধ্যে সাঁওতাল,মাঝি, মুন্ডা,ওরাও, বিরহোড়, কুড়মি, মাহালী  আদিবাসীরা হাজার হাজার বছর ধরে তাদের সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রেখেছে এবং আজও সেই পরম্পরা সমান ধারায় প্রবাহিত হয়ে চলেছে। আদিবাসীদের বারো মাসে তেরো পার্বণের অন্যতম পরব হলো "করম পরব"। বিস্তৃর্ণ ছোটো নাগপুর মালভূমি, উড়িষ্যা, ছত্তিসগড়,, আসাম ও বাংলাদেশের অনেকাংশে করম পরব সাদরে পালিত হয়।
    প্রতি বছর ভাদ্র মাসের একাদশী তিথিতে করম পরব অনুষ্ঠিত হয়। তার তিনদিন, পাঁচদিন বা সাতদিন আগে "জাওয়া" তোলা হয়। তাই কোথাও কোথাও জাওয়া পরবও বলা হয়ে থাকে। গ্রামেরই আশেপাসের যে কোন জলের স্রোত থেকে বালি তুলে একটা ডালিতে (ছোটো বাঁশের তৈরী ঝুড়ি) পূর্ণ করে এবং সেটাতে আট ধরনের বীজ ফেলা হয়। হলুদ জলে শোধন করে ঘরে নিয়ে আসা হয়। এই বালি তোলা নিয়ে সুখদুঃখ সংমিশ্রণে কি সুন্দর একটা করম গীত আছে।


     "সরু সরু বালি কে জাউআ উঠাওঅলি
ওরে...  হিনদে গো দেলে
হিনদে দেলে হুনদে ঢহি জায়,
পেইন ডহরেক বালি, মহলি ঘারেক ডালি
ওরে... হিনদে গো দেলে
হিনদে দেলে হুনদে ঢহি জায়।"


এই গীতটার আক্ষরিক অর্থ যদি ধরি তাতে পায় ছোটো ডালিতে যখন বালি তুলছি এদিকে দিলে ওদিকে ধসে যাচ্ছে।
কিন্তু এর অন্তর্নিহিত গভীর তাৎপর্য রয়েছে। গায়িকা শুধু জাওয়া তুলার কথাই নয় সঙ্গে তার সংসারিক জীবন যাত্রার সুখদুঃখের কথা তুলে ধরেছেন। তার সংসারে একটার পর আরেকটা দুঃখ চলে আসছে। একটা বেদনা কাটিয়ে উঠতে না উঠতে অন্য কোন নতুন ঝমেলার সৃষ্টি হচ্ছে।
এরপর জাওয়া নিয়ে বাড়িতে গেলে দেখা গেল জাওয়া ঝিমিয়ে পড়েছে। তাই আবার আক্ষেপের সুরে গীত গাইলেন...


"আষাঢ়েকর ধোপা ধোপা ভাদরেকর রোদবা,
ওরে... সেহে রোদবে
সেহে রোদে জাউআ ঝুরুআইল।
সরু সরু বালিকে চুবা খনা পানি
ওরে... সে হো রে পানি
সে হো পানিঞ জাউআরে জাগায়।"
আবার কোন স্রোত স্থানের বালি কুড়ে জল বের করে সেই জলে জীবানু মুক্ত জলে শোধন করতে বলা হয়েছে।
এরপর প্রতিদিন পাড়া প্রতিবেশী মেয়েরা একত্রিত হয়ে যারা জাওয়া তুলেছে তাদের বাড়ি গিয়ে জাওয়া নাচ গানের মাধ্যমে জাওয়া জাগানো হয়। সে সম্পর্কেও সুন্দর গীত আছে।


"ইতি উতি জাউআ কিয়া কিয়া জাউআ
জাউলোও মাঞ জাউলোও মাঞ
দানা বহুরা...।"
ছোটো ছোটো চারা উঁকি মারছে, জাওয়াতে কি কি আছে গো? নাও জাগিয়ে দিলাম। অনেক প্রকার দানা দেখা গেল। এই ভাবেই নানান গীতের মাধ্যমে গ্রামীন বালিকা মহিলারা প্রতিটি বিকেলকে মুখরিত করে তোলে। এই গীতের মাধ্যমেই ভাই বোনের মধুর সম্পর্ক ফুটে উঠে যখন কোন বোন গেয়ে উঠে...
"তোরে খাতির ভাই হামি সাতদিন সহেলি রে
সাতদিন সহেলি...
তোরে খাতির ভাই হামি গরবঅ কেরলি রে
গরবঅ কেরলি।"


অর্থাৎ জাওয়া তোলের পর থেকে ভায়ের জন্য সাতদিন নিরামিষ অন্ন ভক্ষনে মানত করে। আর করম দেওতাকে পূজো দিয়ে ভায়ের জন্য লক্ষ বছরের আয়ুর বর চেয়ে গীত গায়...


"দেহু দেহু করম রাজা দেহু আসিস রে
দেহু আসিস...
ভাই হামর বাঢ়েই যেসন লাখ বারিস রে
লাখ বারিস।"


তখন সেই ভায়ের হৃদয়ে বোনের প্রতি কতটা স্নেহ উৎপন্ন হয় তা উপস্তিত ভাইই একমাত্র অনুভব করতে পারে।
                        (অসম্পূর্ণ)