এই আমি তোরা চেয়ে দেখ!
এই যে আমি তোরা দেখ,চেয়ে দেখ একবার,
আমার ডান রান শুধু পড়েছিল চাপা
দশতলা দালানের একটা পিলারে।
শুধু একটা পিলার, এর কিছু বেশি নয়,
শুধু একটা পিলার সে তো সত্যিই বেশী কিছু নয়। আহা রে!


ইস্‌ আমার বাম পিজরে কিভাবে যে ঢুকে গেল,
বছর দশেক আগে কেনা সিঙ্গার সেলাই মেশিনের ভাঙ্গা প্যাডেল,
আমি বুঝতেই পারিনি।
তা না হলে শালা এ যাত্রায় বেঁচে যেতামই যেতাম।
শালা ওই সিঙ্গারের পুরানো সেলাই মেশিন।
তার আগে, বহুদিন আগে কোন একদিন ঐ মেশিনের প্যাডেলে পা
রেখেছিল ওপাশে যে বসত বগুড়ার নাসরীন।
ওই যে চিকন মত, ওই যে শ্যামলা বর্ন, আর ওই যে নাদুস নুদুস বুক যার...
বসত সে আমার মুখোমুখি, আমি ও সে একই টেবিলে।
ইচ্ছে অনিচ্ছার দোলনে ছুঁইয়েছিলাম তার পা, আমার পায়ে, অতি গোপনে!
বিদ্যুতের স্ফুলিঙ্গের মত সে অনুভূতি!


আর আজ আমার থেতলে যাওয়া লাশ, কি বরফশীতল এ ঘর।
কত আহাজারি কত আবেগের মাতম উঠবে কাল আমার গাঁয়ে,
কত উত্তাল অতলান্তিক ঝড় যেন ফের নাঁড়ি ছেড়া, বয়ে যাবে আমার মায়ের বুকে,
কত ক্ষোভের বহ্নিশিখা জ্বলবে হন্যে হয়ে আঞ্জুমানী লাশ খোঁজা আমারই ভায়ের অন্তরে,
আর কত ঝড়ের রাতের যতনা আশা মিইয়ে গেল
আমার আর নাসরীনের শক্ত নরম অদেখা গোপন অভিসারে!
আর তোরা শালা রাজনীতিবিদ, আর তোরা শালা সাংবাদিক,
আর তোরা শালা যারা সব বিদ্বেষের কথামালা মাকড়সার জালে জালে
ছড়াস আকাশে বাতাসে আর ইথারে
আমি তোদের সবাইকে নিকুচি করি,
আজ আমার 'নিরব যন্ত্রনা সাংগে আচমকা'...
আজ আমার সব 'নিরব যন্ত্রনা সাংগল আচমকা'
দশতলা দালানের ভাঙ্গা সে যে এক পিলারে...
এ যে কি অদ্ভুত শীতল অনুভূতি ছুঁয়ে গেল সপাৎ, নিথর শরীর আজ আমারে ।


আজ, আর আজ আমি একা নই, পয়ত্রিশ লাশের সাথে সাথে
গাদাগাদি করে রাখা আমি এই সাভারে, এখানে কোন এক হাসপাতাল মর্গের ভিতরে!
আমি দেখিনি যে, তাও ভাল, কত জনের হাড়, পাঁজরের হাড়, জঙ্ঘার হাড়,
ভেঙ্গে একাকার, কতজনের থেঁতলেই গেছে হাড়সর্বস্ব চোখ-মুখ,
কত জনের মগজ বের হয়ে বুঝি শুকিয়েই গেল নিচ-উপরের ফোলোরে !


তাও ভাল লোহার পাদানি ছুরি হয়ে ঢুকেছিল আমার বুকে,
তাও ভাল যায় চেনা তবুও আমার এ মুখ, গোরের নাম তবু হবে আমার গাঁয়ের কবরে!
তাও ভাল আমি দেখিনি, কত কসাই ডাক্তার ফ্লোরেই
অপারেশন থিয়েটর বানিয়ে বিনয়ের ভাঙ্গা পা কেটে ফেলে দিল!
কত লাল রক্ত তার! আমারি মত লাল। ঠিক আমারি মত!
কত অমানবিক ছিল তার চিৎকার। কত পাশবিক!
তাও ভাল শুধু শুনেছি আমরা!
আমরা শুনেছি পয়ত্রিশ লাশ হয়ে যারা শুয়ে আছি এই মর্গের মেঝেতে-
গেল যারা আমাদের ফেলে!
কি ক্ষতিটাই বা হতো ওর পুঙ্গতে নিয়ে গেলে?


তাও ভাল আমাকে নিয়ে তোরা যাস নাই ঢাকার শহরে, ঐ ঢাকা মেডিক্যালে!
তাও ভাল নাসরীনকে তোরা নিয়ে যেতে চাস নাই চার রাস্তার মোড়ে,
যেখানে ফ্রি ফ্রি রক্তের ব্যাগ জমাচ্ছে লোকে হাজারে হাজারে!
তাও ভাল আজ আমি গতকাল ইস্ত্রিরি করা সাদা পাঞ্জাবীটা পড়তে গিয়েও পড়েনি!
তাও ভাল গেল সপ্তায় আমি নাপিতের দোকানে গিয়ে দশ টাকায়
কামিয়েছিলাম ছ'মাসে একবার কামানো বগল, দাঁড়ি আর চুল!
তাও ভাল আমি করি কাজ শুধু, রাজনীতি নাম গন্ধ লাগাইনি গায়ে কিম্বা আমার চেয়ারে।
তাও ভাল আমি সাইপ্পা বাড়ি খেয়ে থেতলে যাই নাই আহা রে!
আমার ভয় হয়, আমার হিমশীতল প্রচণ্ড ভয় হয়,
মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হয় যখন ওমনে!
তাও ভাল ভোরে আমি মারা গেলাম আজ শুধু চাপা পড়ে আমাদেরই ঘামে গড়া দালানে!


আমি ঘুমাতে পারি না আমার মেসে, আমি সত্যিই ঘুমাতে পারি নাই গেল মাসে!
মাস দুই ধরে মালিকের আশা, আশাঃ আজ নয়, ঠিক কালই দিয়ে দেব বেতন!
গেলো ঈদের বোনাস সহ, সাথে ছয় মাসের এক্সটা টাইমের বেতন, এক্কেবারে!, সুদে-আসলে মাশুলে!
শুধু আজকে থেকে যা তোরা, যাস্‌ ফের বাড়ি তোরা রাতটাই আজ পোহালে!
এই আসছে শুক্কুরবার-ই - দিতে হবে যে ডেলিভারী!


ও আমার ভাই ছোট, ও আমার দুঃখী মা, আর ও আমার অবিয়াতী বোন,
আমার মুখের মত দেখতে ওই যে মুখ, সে আমারই মুখ!
আমার কাটা হাতটা যে বুকের উপর নিথর সে যে নাসরীনেরই বুক!
শুধু বলে দিস তোরা ওর বাবা মাকে, চিনিয়ে দিস শুধু ওর লাশ!
আহা! ওকে আজ যাচ্ছেই না যে চেনা!


ও আমার ভাই ছোট, ও আমার দুঃখী মা, আর ও আমার অবিয়াতী বোন,
জানিস্‌, আমি আমাদের গার্মেন্টসের তিন তলা ফোলোরে,
কঠিন-তরল বাতাসে গ্রীষ্মের তপ্ত রোদেলা দুপুরে
ছিলেম বেশুমার কর্মী এক!
শীতের সকালে এক কাপড়ে দুই মাইল দূর মেসে
কাকের আগে ঘুম ভেঙ্গে, না গোছল, না সাবান, না রেশনে,
ঐ কেন্টোরমেন্টের সৈনিকদের মতই মার্চ করে যেতাম মালিকের মৃত্যু দালানে!


বেঁচে থাকতে আমি সত্যিই বুঝিনি, আমি সত্যিই জানিনি ,
আমার ঘামের বিনিময়ে আজ রাষ্ট্র বাঁচে, মন্ত্রীর গাড়িতে ওই নিশানি!
কোরামহীন সংসদে বড় বড় শোরগোল আর থাবড়ানি -
আর ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় লাল-নীল বাত্তির ঝলকানি!
আমি সত্যিই বুঝিনি,
আমাদের ঘামের দামে তাহাদের এত ফুটানি!


পাঁচটাকা বাস ভাড়া দিন প্রতি বাঁচিয়ে
আর ভাত-ডাল আর আলুভর্তা
কিম্বা অসিদ্ধ ডিমের ঝোল মাসের পর মাস খেয়ে গোগ্রাসে,
চেয়েছিলাম আমার বোনের যৌতুকের সাইকেলটা কিনবোই কিনবো এবার!
গেলবছর বিয়ে তো ভেংগেই গেল সাইকেলটা দামে পাইনি বলে!


ও আমার বিদ্বান বিদুষী বাঙ্গাল, ভাই বোন যত দিশেহারা,
ও আমার মালিক মালেকান দশ, তোরা গুলশানে আর বিদেশে থাকস্‌ যারা!
আমি ভ্যাপসা শ্বাসের বদ্ধ ঘরে সুতার নিপুণ বুননে,
ঘাম টুকু শুধু মুছে ফেলেই কাজ, চুপিসারে আশা আমাদেরই দুখ-হাসি লগনে
চল্লিশ কর্মচারী শকুন চোখ দেখেছিল - সত্যিই সে চুপিসারে -
যদিও তাদের সে বিদ্রুপ হাসির অগোচরে-
আমি হাজার টাকার আশার দোলনে রেখেছিলাম মায়ের-বোনের অতৃপ্ত কোমল স্বপন
আমি বিচার চাই না আমার লাশের, রাজের বিচারে ফের যদি হয় বিয়াল্লিশা চন্দ্রগ্রহণ।


আরে ও নচ্ছার ঐ ভাঙ্গা পিলার- স্বপন আমারি ফেলনা তোমারি-
দিলি ভেংগে আজ সুখের-দালান
সাধের স্বপন তুই ভেঙ্গে দুইখান
পরিনামে আমি শুয়ে আছি আজ সাভারের এই ভাগাড়ে
পয়ত্রিশ কিম্বা আশিরও বেশি আঞ্জুমানী লাশের কাতারে!


--মুস্তাফা গোলাম , ২৪/০৪/২০১৩ ইং


মূল লেখা পাবেন এই লিঙ্কেঃ
https://www.facebook.com/mustafa.golam/posts/10200649576975752