বাংলার অন্যতম জনপদ হল রাঢ়। এই জনপদকে বাংলার রাঢ়বঙ্গ বলা হয় | রাঢ় বাংলা পশ্চিমবঙ্গের  বর্ধমান-বীরভূম, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলার বিস্তীণ অঞ্চল নিয়ে গঠিত ।  এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ক্ষেত্রগুলি পর্যালোচনা করলে সংগীত তথা লোকসংগীতের প্রসঙ্গ সর্বাগ্রে চলে আসে।


লেটো ঃ
কবি কাজী নজরুল ইসলাম  পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সেই অঞ্চল রাঢ় বাংলা হিসেবে পরিচিত নয়। কিন্তু কাজী সাহেবের কবিতার রাঢ় বাংলার  কথিত ভাষার উপস্থিতি বিদ্যমান। কবি নজরুল গ্রামের স্কুলে শিক্ষা লাভের পর  রাঢ় বাংলার কবিতা, গান আর নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক  লোকনাট্য লেটোদলে যোগদান করেন। তৎকালীন যুগে রাঢ় বাংলার লেটো এক বিখ্যাত লোকনাট্যযায়।  ঐসব লোকনাট্যের দলে বালক নজরুল ছিলেন একাধারে  পালাগান রচয়িতা ও অভিনেতা। নজরুলের কবি ও শিল্পী জীবনের শুরু এ লেটোদল থেকেই। হিন্দু পুরাণের সঙ্গে নজরুলের পরিচয়ও লেটোদল থেকেই শুরু হয়েছিল। তাৎক্ষণিকভাবে কবিতা ও গান রচনার কৌশল নজরুল  লেটো বা কবিগানের দলেই রপ্ত করেন। এ সময় লেটোদলের জন্য কিশোর কবি নজরুলের সৃষ্টি চাষার সঙ, শকুনিবধ, রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ, দাতা কর্ণ, আকবর বাদশাহ, কবি কালিদাস, বিদ্যাভূতুম, রাজপুত্রের সঙ, বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ, মেঘনাদ বধ প্রভৃতি।


ঝুমুর গান ঃ
রাঢ় বাংলার লোকসংগীতের অন্যতম প্রাণ সম্পদ ঝুমুর গান। শাল, পিয়াল, কেঁদ, করম আর মহুয়ার জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ি প্রকৃতি ঘিরে যে গানের প্রভাহমানতা এক সুউচ্চ সংগীত শৈলীর পরিচয় প্রদান করে- তাই ঝুমুর গান নাম পরিচিত। ঝুমুর ছিলো হাঁকা পর্যায়ের শব্দ উদগিরণের একটি কলা মাত্র | ক্রমবিবর্তনের মধ্য দিয়ে স্বর তাল মাত্রা এবং ছন্দের বিভাজনে সুরের বিধিবদ্ধতায় তা সংগীতে উত্তীর্ণ হয়েছে |
রাঢ় বাংলার কবিতায় ঝুমুর গানের অবদান অস্বীকার্য, আমরা দেখিছি কবি নজরুলের কবিতায় ও গানে ঝুমুর গান অসংখ্য জায়গায় ব্যাবহার করেছেন। কবিগুরুও শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন ঝুমুর গান ও সাঁওথালি গান ও কবিতা নিয়ে চর্চা করেছেন।
ঝুমুরের এক ভাগ - দরবারী ঝুমুরে দেখা যায় সাহিত্যের ক্ষেত্রে একটু পরিশীলিত ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে এবং সুরের বৈচিত্র্যর ক্ষেত্রে কীর্তন সুরের ও রাগরাগিণীর প্রভাব ও রয়েছে |  
দরবারী ঝুমুর গানের উদাহরণ দেওয়া হল-
১।
"আসিল বসন্ত ঋতু হরসিত প্রাণ
নবসুরে কোকিলা, কোকিল করে গান "
"ওরে কানা ভ্রমর তুমি নাগর
কইর না আর ছটর ফটর "
২।
"কার গরভে কৃষ্ণ দশমাস রইল হরি হায়রে
কার দুধ পিয়ে বড় ভেলায় যমুনা তীরে
বাঁশীয়া বাজায় ধীরে ধীরে || "


ভাদু


পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বর্ধমান, মেদিনীপুর ও বীরভূম জেলার জনপ্রিয় লোক সংগীত হল ভাদু ৷ অনাথ শিশুকন্যা ভাদুর জীবনকাহিনি নিয়ে ভাদু উৎসব পালিত হয় ৷ উৎসবের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ভাদু গান ৷ ভাদুর জীবনকাহিনি নিয়ে তাতে আঞ্চলিক সুর দিয়ে এই গান গাওয়া হয় ৷ সাধারণত গ্রাম বাংলার অবিবাহিত মেয়েরাই এই গান গেয়ে থাকেন ৷ কবি নজরুলের কবিতায় ও গানে ভাদু সংগীত উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।