দ্বিতীয় এবং শেষ অংশ -


পাউন্ডের ক্যান্টোস তথা মাস্টারপিস


১৯২০ সালে পাউন্ড প্যারিসের উদ্দেশ্যে লন্ডন ত্যাগ করেন । ততদিনে সাহিত্যের জগতে তিনি নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন । এই সময়ে তাঁর সবচাইতে উচ্চভিলাষী স্বপ্ন কেন্টোস এর কাজ শুরু করেন । ১৯১৭ সালে জয়েসকে একটি চিঠিতে লিখেন “আমি একটি অসীম কবিতা শুরু করেছি । এটি কোনো শ্রেণীতে পড়ে না কিন্তু এ কবিতাগুলোতে সবকিছু পাওয়া যাবে । ”
তার ছোট ছোট কবিতাগুলো মাস্টারপিস বলে খ্যাত ‘ক্যান্টোস’ এর উপর নিরীক্ষা থেমে থাকেনি এবং এ ক্ষেত্রে তাঁর সাফল্য ও স্বার্থকতা বিশ্ববিদিত ।
১৯১৭ সালে প্রথম ৩টি ক্যান্টোস পোয়েট্রিতে প্রকাশিত হয় ।  চতুর্থ ক্যান্টোসটি প্রকাশিত হয় ১৯১৯ সালে । ৫,৬,৭ নং ক্যান্টোস ১৯২১ সালে প্রকাশিত হয় । ৮ নং ক্যান্টোসটি  প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে । কিন্তু নতুন কোন পুনর্মুদ্রন ছাড়া পরবর্তী দশ বছরে আর কোন নতুন ক্যান্টোস পাওয়া যায় নি । ১৯২৫ সালে মাত্র ৯০ টি কপি প্যারিসে ১৯২৫ সালে এবং A draft of XXX Cantos ১৯৩০ সালে প্রকাশিত হয় । কিন্তু ১৯৩৩ সালের আগে লন্ডন এবং নিউইয়র্কে তাঁর প্রথম ত্রিশটি ক্যান্টোস প্রকাশিত হয় নি ।
১৯৩১ সালে Hound and Horn এর উপর একটি পর্যালোচনা দি ক্রিটিক্যাল হেরিটেজে প্রকাশিত হয় । ডিউল্ডি ফিটস বলেন – “আজকের দিনে ক্যান্টোস যে উচ্চভিলাষী কবিতার পরিকল্পনা তাতে কোনো সন্দেহ নাই” । তিন দশক পরে “দি ক্যান্টোস ইন ইংল্যান্ড ” ক্রিটিক্যাল হ্যারিটেজ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । ডোনাল্ড হলের মতে পাউন্ড মহৎ কবি এবং ক্যান্টোস তাঁর মাস্টারপিস “।
যখন ক্যান্টোসের XVI আবির্ভুত হলো উইলিয়াম কার্লোস ১৯২৭ সালে ক্রিটিক্যাল হেরিটেজে বললেন – পাউন্ড কবিতাকে আমাদের কাছে পৌঁছাতে চেয়েছেন কিন্তু দুঃখের বিষয় যে তা তিনি পারেন নি । পাউন্ড নিজেও শংকিত ছিলেন এ বিষয়টিতে ।
এ সম্পর্কে। বলেন - সমস্ত কবিতাগুলোই আবছা বিশেষ করে এর টুকরো টুকরো কবিতাগুলো ।
ফিটস দুটো কমন অভিযোগ করেন ক্যান্টোসগুলো সম্পর্কে – প্রথমত - কবিতাগুলো দুর্বোধ্য ,এলোমেলো , ন্যায়ভ্রষ্টতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা যায় । এবং দ্বিতীয়ত – গঠনগত দিক থেকে এবং সুরের ক্ষেত্রে এগুলো আকারশুন্য অনিয়াতাকার এবং অগোছালো জানযটে ভর্তি । জর্জ কেরন্স বলেন – ক্যান্টস যদি পড়তে হয় তবে অনেক সময় দরকার হয় ।  একটি ক্যান্টোসেও অনেক তথ্যসুত্রের একত্রীকরনের প্রয়োজনীয়তা বোধ হয় । পাউন্ডের কাজের উপর প্রথম সমালোচনা মূলক পদক্ষেপ  “কেনারের “দি পোয়েট্রি অব এজরা পাউন্ড” ১৯৫১ সালে প্রকাশিত হয় ।
পাউন্ড বলেন – মৃতদের জগতে বিচরন, ইতিহাস বিনির্মান এবং ক্যান্টোসের গঠনের মূহুর্ত সবকিছুর মধ্যে একটা ঐক্য ক্যান্টোসগুলোতে পাওয়া যাবে ।  যে তিনটি গ্রন্থ ক্যান্টোস রচনায় প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে সেগুলো হলো দান্তের “ডিভাইন কমেডি”, হোমারের “ওডিসি ” এবং ওভিদের মেটামরফসিস ।
ক্যান্টোসে পাউন্ড কনফুসিয়াসের শিক্ষা ,ঐতিহাসিক উপকরণ এবং তাঁর অভিজ্ঞতার মুহুর্তগুলোর মিলিত আবেগ তুলে ধরেন। ক্যান্টোসে আমি উপস্থাপিত করেছি ওডেসিউসের অন্ধকার জগতের বিচরন ,যেখানে সে মৃত আত্মা থেকে পাওয়া তথ্যের মাধ্যমে সে বাড়ি ফিরতে সক্ষম হয় । এই দৃশ্যগুলো কবির ব্যাক্তিজীবনের সাহিত্যের প্রতি অনুসন্ধিৎসা যেমন প্রকাশ করে একই সাথে তাঁর সময়ের অনেক তথ্য পাওয়া যায় যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।
ক্যান্টোসে পরবর্তীতে ঐতিহাসিক চরিত্র যেমন সিগিসমুন্ডো মালাটেস্টা প্রবেশ করেন । এখানে রাজনীতি এবং সাহিত্যের মধ্যে সৃষ্টিশীলতার বিষয়টিও নিয়ে আসেন । ব্যাংকিং , অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং সুদ আজকের অর্থনৈতিক বিপ্লবের বাস্তবতায় শোষনমূলক ব্যবস্থা এই বিষয়গুলো তিনি ক্যান্টোসে একত্রিত করেছিলেন । ফ্রোলা বলেন ক্যান্টোস হলো মৌখিক যুদ্ধ । বস্তুতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে মানুষের অন্তর্গত আচরণ যা রাজনৈতিক আধিপত্যকে সমর্থন করে ।
ক্যান্টোস সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংস্কার কে ভিত্তি করে অর্থনীতিকে সংস্কার করে যা রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে আলাদা নয় । ” গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করে এই ক্যান্টোস । তাছাড়া এগুলো বোঝার জন্য ব্যাখ্যামূলক অনেক গ্রন্থ্ প্রকাশিত হয়েছে যেগুলোতে ক্যান্টোস সম্পর্কে ব্যাখ্যা ছাড়াও অনেক পান্ডিত্যপূর্ণ কাজ ও রয়েছে । ক্যান্টোস উপলব্ধি এবং মূল্যায়নের জন্য গ্রন্থগুলো ডিজাইন করা হয়েছে ।
হোমারের ওডিসি এবং দান্তের ডিভাইন কমেডির মতো পাউন্ডের ক্যান্টোস ও আধুনিক মহাকাব্য । পাউন্ড বলেন গত চল্লিশ বছর ধরে আমি শিখেছি । এমেরিকা অথবা অন্য কোন দেশের অর্থনৈতিক ইতিহাস লিখতে চাইনি । কিন্তু চেয়েছি মহাকাব্য লিখতে যার জন্ম একটা ঘন বনে । মানব চরিত্রের প্রায়শ্চিত্তমূলক স্বত্বা থাকে এবং আলোর দিশারী একজন বিশেষ জ্ঞানী মানুষ থাকেন তাঁর চরিত্রকে ঘিরে গড়ে ওঠে যে কাহিনী সেই হলো ক্যান্টোস ।
বারন্সটেইন বলেন পাউন্ডের মহাকাব্যে বিশেষ করে তার কেন্টোসে অনেকগুলো চরিত্রের সমাবেশ থাকে । মুল যে ভাবাবেগ তৈরী হয় একটি এপিকে সেটি কোন চরিত্রের হিরোইক ইমেজের চাইতে বিশেষ কোন গুন দ্বারা অর্জিত হয় । পনেরশ শতকের দিকে সিগমুন্ড মালাটেস্টা , এলিজাবেথ জুরিস্ট , এডোয়ার্ড কোক , এলিজাবেথ ওয়ান , জন এডামস,এবং থমাস জেফারসন এর লেখায় ব্যক্তির সাহস , স্বতন্ত্র এবং স্বাধীন চিন্তাভাবনা ইত্যাদির মাধ্যমে চরিত্র গুলোর মধ্যে একটা নায়কোচিত রোমান্টিক রস মূর্ত করেছিলেন । পাউন্ড ইতিহাস এবং পুরান থেকে এবং একই সাথে আধুনিক বিশ্ব থেকে চরিত্রগুলোতে এনেছেন কনফুসিয়াসের আদর্শগত সততা এবং ন্যায়পরায়নতা এবং একই সাথে মানুষের মধ্যে লোভ , অজ্ঞতা এবং পরশ্রীকাতরতার কথাও তুলে ধরেছেন ।
একটি মহাকাব্য গড়ে ওঠে একটু জানা পৃথিবী থেকে এবং এর শিক্ষা থেকে । এটা এমন যে ” এটি একটি জাতির গল্প” ।  কেন্টোস গুলো ডিজাইন করা হয়েছিল এগুলোর নাট্যরূপ দেয়ার জন্য এবং সাংস্কৃতিক জ্ঞান অর্জনের জন্য ।
পাউন্ডের এপিক গুলো মধ্যযুগের অন্যান্য এপিকগুলোর মতই এবং বিশেষ করে দেবদেবীর অলৌকিক কর্মকান্ড নিয়েই কাহিনী এগিয়ে যায় । এছাড়া এপিকগুলোর গঠন প্রাসংগিক এবং এর ফর্ম গুলো পুনরায় আধুনিক বিশ্বের জন্য উপযুক্ত করে গঠন করা হয়েছে ।
“ক্রিশ্চিয়ান ফ্রোলা বলেন -তার ক্যান্টোসে রয়েছে বিভিন্ন সংস্কৃতি , ভাষা এবং অনেক রকম ঐতিহাসিক কাহিনীর সমাবেশ। এগুলোর নৃতাত্ত্বিক পরিপ্রেক্ষিত আজকের বিশ্বের একটি সত্যিকারের ছবি প্রকাশ করে । এগুলো কোন জাতির অথবা দলের পুরনো ধ্যান ধারণা যারা একক অথবা কাছাকাছি সংস্কৃতির এবং মানব সম্প্রদায়ের এবং জটিল জীবন যাত্রার বৈচিত্র্যের সীমা নির্ধারন করে । সুতরাং ক্যান্টস হলো আমাদের সত্যিকারের চির উন্মুক্ত ,উপলদ্ধি এবং অভিজ্ঞতার জগত ।
পাউন্ড যখন ইতালীর কারাগারে ছিলেন তখন তিনি তখন “Pisan Cantos,” শেষ করেন । পল এল মন্টগোমেরি নিউ টাইমসে বলেন এই সেঞ্চুরীতে যতগুলো মাস্টারপিস আছে তার মধ্যে পাউন্ডের কেন্টোসই সেরা “। এই কবিতা গুলোর জন্য তিনি ১৯৪৯ সালে বলিঙ্গন প্রাইজ পান ।
ডোনাল্ড ই হেরডেক ব্লুমবারিতে পর্যালোচনা করেন -ক্যান্টোসগুলো হলো পাউন্ডের চিঠি আমাদের সবার কাছে । মানুষের জেদ , তার কৌতুকবোধ, তার প্রাথমিক খসরা ,জীবনের ওঠানামা , নিজেকে প্রচার এবং প্রসারের তাগিদের অনুভব ।” পাউন্ড যদিও তার সৃষ্টিশীল কাজ যেমন কবিতা লিখা , অনুবাদ করা , সম্পাদনা করা এসব কাজের জন্য যে উদ্যম,আগ্রহ প্রচেষ্টা ইত্যাদি সবই সচেতন ভাবে নিজের জন্য যেমন করেছেন তেমনি তাঁর উত্তর সুরী লেখকদের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন । তাঁর সম্পর্কে বলা যায় “এজরা পাউন্ড আমাদের জন্য তাঁর পৃথিবী নির্মান করেছিলেন “।
ফ্যাসিস্ট রাজনীতির সাথে জড়িত থাকার কারণে এজরা পাউন্ডকে কারারুদ্ধ করা হয় । কিন্তু সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য তাঁর রাজনৈতিক কর্মকান্ড উপেক্ষা করা হ্য় । লেখকদের একটানা আপিলের কারণে তাঁকে মুক্তি দেয়া হয় ।
এরপর তিনি ইতালীতে ফিরে আসেন এবং জীবনের শেষ দিনগুলোতে এজরা পাউন্ড ইতালীর ভেনিসে একটা নিভৃত স্থানে অবস্থান করেন । ১৯৭২ সালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ।
—————————————————