১.
তোমাকে বলেছি, তুমি এ শহরে এসো একবার
যদিও আমার কোন বাড়ি নেই এ শহরে আজও
যা আছে, সেখানে এসো, সেখানেই এসো হে যুবতী
হাওয়ার জমিতে দেখো কত লক্ষ গর্ত হয়ে গেছে
সাধের নিঃশ্বাস ফেলে ফেলে, তবু এখনো সকালে
কেউ কেউ ভাঁড়ে করে চা- দিলে না করি না জানো
ইতিহাস জানে কত বিপন্ন সময়ে শুধু চা-ই
পেরেছে সামাল দিতে, মনুষ্য প্রতিভা গুলি এত
অস্থির ঊর্ধমুখী সুতো ছাড়া, সে আর বোলো না
পথে যে বাতাস আসে, তার কথা ভাবে না প্রথমে


২.
এ ঋতুতে নর্দমায় জল কম, পলিথিন বেশী
আমার স্বপ্নের মাছ দুটি একটি করে মরে যায়
অথচ এখনো কারা সমুদ্রে বানায় বালিঘর
কতবার বলেছি যে তুমি এসো শহরে এবার
এমন রুক্ষ চোখে চোখ রেখে শ্যাওলা জমাবে
বলে সেই কবে থেকে নিস্পলক সাজিয়ে রেখেছি
মানুষ এখন কিছু অর্থহীন খবর ছড়ায়
অখণ্ড পৃথিবী যেন উজ্জ্বল ক্রিকেট গ্যালারি


৩.
পৃথিবীর বুকে শুধু মাটি আছে, বীজ নেই আর
সম্ভাবনা হীন দিনে প্রবৃত্তির কাছে হাঁটু মুড়ে
বসে আছে মানুষেরা, তুমি এলে এইসব ছেড়ে
যাব অন্ত:পুরে যাব নিজস্ব পাপের কাছে যাব
নিহত মুহূর্ত থেকে খুঁড়ে নেব উপেক্ষিত পথ
সে পথে তোমাকে এনে নির্ভুল বিকেলে দেখাব
মাটি ফুঁড়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে উদ্ভিদ আবার
এ শহরে তুমি এলে অসম্ভব আশাগুলি নড়ে


৪.
তোমাকে কেন যে ডাকি, এ শহরে, খারাপ সময়ে
নগর-পরিখা জুড়ে মশাল-প্রহরা-কানাকানি
যেন কোনো আক্রমণ সময়ের অপেক্ষায় শুধু
অথচ ভেতর থেকে আর কিছু অবশিষ্ট নেই
বাইরে যে হাসি, সব ক্যামেরার মধ্যে জমা আছে
নচেৎ কোথাও নেই, শুধু মানুষের দীর্ঘতম
খিদেগুলি বসে আছে একঘেয়ে গুহার ভেতরে
মানুষই জানে না। সকল সম্পর্ক ছেড়ে যাব
একদিন আলো ঢেলে গুহাকে বিপন্ন করি যদি
অনায়াসে, দেখো তুমি, মানুষের হাতে মরে যাব


৫.
গোপনে, চরিত্র থেকে ঈর্ষা উবে গেছে একদিন
মানুষ ভেবেছে ক্লীব; তুমি জানো এও উত্তরণ
আমাদের চিঠিগুলি অর্থহীন, ভারী হয়ে আছে
তবু এসো। যেরকম মাংস সুসিদ্ধ হওয়া আঁচে
মেরু-পর্বতের হিম গলে আসে আমার উঠোনে
যাবতীয় চিঠিপত্র ভেসে যায়, স্মৃতি বাসস্থান
সব ডুবে যায়। এ শহরে তুমি এসো সেরকম
দেখো; ঈর্ষা, অধিকার ভুলে; দেখো মানুষের শিশু


৬.
যা কিছু জটিল তার কাছে বসে পড়ি, দেখি জটা
কীভাবে আলগা হয়, ধীরে ধীরে সুতো খুলে আসে
স্বপ্ন-সিনেমার মতো, অথচ এ অধীর সময়ে
ছিঁড়ে যাওয়া শব্দগুলি শ্রবণের অপেক্ষা জানে না
জানি যে, নক্ষত্রগুলি বহুদূরে, কবেকার আলো
এমন সহজ হয়ে রাতে এলে অবিশ্বাস হয়
মানুষের কাছে তবু কিছু গুপ্ত ভাষা আছে আজও
তুমি সে হদিস জানো, পাঠের কৌশল জানো তুমি
এসো এ সময়ে এসো, সারশূন্য আলোর বিকেল
ছিঁড়ে এসে দিয়ে যেও জটা জন্ম, সুতোর বুনোট


৭.
তবে কি আলোর কথা কিছু বাকি নেই? তা তো নয়;
দীর্ঘ বাক্যালাপে এখনও তো সন্ধ্যা নেমে আসে
এখনও তোমার চোখে মণি জুড়ে মাদকতা আনে
চায়ের বাদামী রঙ, কিছু গাঢ়, কিছু অপ্রতিভ
মানুষের আড্ডা গুলি কেউ এলে জমে ওঠে আজও
কেউ চুপ করে যায়, কেউ সেটি লক্ষ্য করে ঠিক
কেউ রাতে বাড়ি ফিরে চুমু খায় সন্তানের গালে
এসবই আশার কথা, যেমন তুমিও বলেছিলে
সম্ভাব্য জানালাগুলি খোলা রেখো, ভুল হয়ে যায়
বঙ্গোপসাগর থেকে হাওয়া আসে, তোমাকে আনে না।


৮.
কপালে রেখো না হাত, জ্বর এলে, বসুক নিকটে-
বরং সে হাত রাখো জানালার শিকে, মুখ চেপে-
অন্যমনে দৃষ্টি রাখো কোলাহল পেরিয়ে কোথাও
যেন প্রতীক্ষার রঙ ফুটে ওঠে তৈলচিত্র জুড়ে
কেননা এখন জ্বর-লুপ্তপ্রায় এই চরাচরে
কোথাও অপেক্ষা নেই, তুমি এসে শেখাও আবার
কীভাবে শব্দের পিঠে চাবুক চালানো দৃঢ় হাত
নিজস্ব চিন্তার কাছে ভেঙে পড়ে, ভিক্ষা করে, কাঁদে
কীভাবে সমস্ত রক্ত জড়ো হয়ে কপালের শিরা
ফোলায়, কাঁপুনি আনে, স্পর্শ থেকে তফাত রেখেও


৯.
মানুষের রক্তরস অসম্পৃক্ত হয়ে আছে বলে
এখনো দুঃখ এসে মিশে যায়, জানি একদিন
একা একা বেড়ে উঠবে আরোহীর মত পাক খেয়ে
হাড়ের শরীর বেয়ে, সেদিনের অপেক্ষায় আছি
অন্তঃসার শূন্য যত আলিঙ্গন, সৌজন্য-আলাপ
বন্ধ হবে, যত মণি-মুক্তো আছে দুঃখের ভেতর
সব আবিষ্কৃত হয়ে আলো হবে প্রকৃত প্রতিভা
তুমি শুধু দেখো, যেন, লঘু শোকে আহত না হই


১০.
সার্থক বেদনা এলে মানুষের ঘুম উড়ে যায়
আবার নিজেই আসে, অতর্কিতে, জানিয়ে আসে না
যখন অন্তরালে আলোড়ন মৃদু হয়ে ওঠে
তখন নিভৃতে আসে। তুমি এতদিন স্তব্ধ কেন
গত বসন্তের ফুল এখনো সুবাস রাখে কিছু
তোমার স্পর্ধাগুলি মনে হয় অতীত দিনের
মনের ভেতরে ঢুকে গেঁথে যাবে তেমন করাত
বহু বহুদিন আগে কখনো তো কেটেছে করোটি
তবে এত শূন্য কেন, নিরীহ পঙক্তি গুলি আর
ভালো লাগে না যে, তুমি ফিরে এসো, দুঃখ শোনাও


১১.
সম্মোহিত চোখে যেন মায়াবী প্রস্থানগুলি দেখে
যেতে পারি। মানুষ না চায় যদি মানুষের সান্নিধ্য, মায়া
তখন প্রত্যাশা, দাবী এত স্থূল অশালীন বলে মনে হয়
যেন ঘন অরণ্যের বুকে অকস্মাৎ মাথা তুলে
দাঁড়িয়েছে বেমানান পুরাতন টেলিফোন বুথ
তেমনই কদর্য হয়ে মানুষের মনোবাঞ্ছাগুলি
একা ফাঁকা পড়ে থাকে, অথচ তোমার কথা জানি
জানি যে সহজ রঙে এঁকে দিতে পারো চলে যাওয়া


১২.
জানি এই পৃথিবীর সিংহভাগ জমির ওপরে
প্রাচীর রয়েছে শুধু। মানুষের গোপনীয় ক্ষত
ক্রমে আরো অন্ধকারে চলে যাবে, যেন কোন আহ্বান বিমুখ
এক পকেটের মধ্যে জলে ভেজা পুরাতন নোট
অসময়ে রৌদ্র পেয়ে আবডালে সাবান শুকোয়
অথচ ক্ষণিকে, যদি আসে অন্য ক্ষতর ছায়ায়,
এখনো বুদবুদ ওঠে, মানুষের শিশুর মতন
অকারণে হেসে ওঠে, আমাদের বিস্ময় জাগায়


১৩.
শরীরের মধ্যে কিছু অস্পষ্ট জোনাকি ওড়ে গাঢ় অন্ধকারে
বহুদিন অনাদরে যেভাবে আগাছা বেড়ে ওঠে
পথের সমগ্র জুড়ে, সেভাবেই তোমার কবিতা
আমার শরীরে তার ঝোপঝাড় গজিয়ে তুলেছে
বুঝেছি এভাবে যদি ফেলে রাখি, তবে একদিন
আমার ভেতরে সব যাতায়াত বন্ধ হয়ে যাবে
অপেক্ষায় বসে আছি, একদিন তুমি হাতে করে
অক্ষরে অক্ষর ঘষে সমস্ত জোনাকি জ্বেলে দেবে


১৪.
বেদনা অস্ফূটস্বরে উচ্চারণে আনে মায়াজাল
তুমিও আবদ্ধ আছো, আমিও বিচ্ছিন্ন হতে চাই
অথচ সে বখাটে যুবক দেখো বাড়ি ছেড়ে গিয়ে
আবার ফেরৎ আসে, আমরাও এভাবে ফিরেছি
সুখ কি অসুখ সে তো আলোচ্য ছিল না কোনদিন
শুধু তার তীব্রতাই আঁচড় কেটেছে জমি জুড়ে
সে জমি স্বায়ত্ত ছেড়ে ঔপনিবেশিক ক্ষুরে ক্ষুরে
উথালপাতাল হয়ে নিয়ে আসে ফলনের দিন


১৫.
তোমার বুকের মধ্যে কুয়োতলা, শ্যাওলা-পিছল
দড়ি বালতি ফেলে গেছে হাজার বছর আগে কেউ
শুধু শূন্য কপিকল একা একা ঘুরছে বাধাহীন
আর তার ছোঁয়া পেয়ে বাতাসও উঠছে পাক খেয়ে
আমি সেই ধোঁয়া দেখে ঘোলাটে চোখের মণি দেখে
কী করি না বুঝে লাফ দিয়েছি সে কুয়োর ভিতরে
সেই থেকে গেঁথে আছি মাথা নীচে, রক্ত ফোটা চোখে
কাৎ হওয়া বালতি থেকে আলো আসছে গড়িয়ে গড়িয়ে


১৬.
গল্পের ভেতরে সেও ছিল, আমি প্রথমে বুঝিনি
কাদার শরীরে মিশে রোদ মাখা নিভৃত কুমীর
কীসের সন্ধানে যেন জলের গভীরে নেমে গেছে
রোদে পোড়া কাদায় সে ছাপ দেখে শিউরে উঠেছি
জানি আমি ডুবে গেলে এ নদীও কাঁচা রক্তে লাল
হয়ে উঠবে ধীরে ধীরে, প্রত্যঙ্গ ফুলে ভেসে যাবে
অন্য কোন নদীতটে, কাদার শরীরে মিশে রোদ
পোহাবে নিভৃতে, শুধু কি ভীষণ ভয় করবে তার


১৭.
তোমাকে কখনো আমি বিশদে বলি নি তার কথা
নিপুণ খুনীর মত বলেছি যতটা বলা যায়
আড়ালে রেখেছি কিছু, অসত্য বলেছি ন্যূনতম
তবুও বাক্যের মধ্যে শব্দ ব্যবহারকালে ঠোঁট
অযাচিত নড়ে উঠে তোমাকে যে ইঙ্গিত দিয়েছে
সেই সূত্র ধরে তুমি পৌঁছে গেছ কী জানি কোথায়
নিশ্চিত সত্যির পথে আলোকিত হয়ে ফিরে এসে
দু'চোখে চাদর টেনে দিও, অন্ধ হয়ে বসে আছি


১৮.
চোখের কিনারা থেকে কাজলের ঊর্দ্ধমুখী বাঁক
আমায় বিরক্ত করে, মাত্রা ছাড়া শব্দের মতন
জুড়ে বসে থাকতে চায়, ভাবি মুছে দেব হাতে করে
যেদিন আবার দেখা হবে, দেখা হবে কি আবার
মনে হয় শুধু ওইটুকু খুঁত মুছে দেব বলে
আঙুলের গায়ে গায়ে স্বেদবিন্দু জড়ো হয়ে ওঠে
কিন্তু তুমি জানো ঠিক, তার সাথে, ভিড়ের বিকেলে
যখন আঙুলগুলি অচেতন, দেখা হয়ে যাবে


১৯.
তবু দেখো, মানুষের আকৰ্ষণ বিস্ময় জাগায়
শাবল-কোদাল দিয়ে কেটে ফ্যালে পাথুরে মৃত্তিকা
খননে উপচে আসে, আকাশের নীল মেশা জলে
সুসময় ছায়া ফ্যালে, একদিন ছায়ার কঙ্কাল
জল থেকে উঠে আসবে ধীর পায়ে, নুয়ে আসা মাথা
জিরোবে পাড়ের ধাপে। পথ ভুলে কোনো পাখি এলে
দুহাতে ধরবে চেপে তার আর্ত ছটফটানিটুকু
তোমার ভেতরে আমি দেখেছি সে দানব-সন্ন্যাসী


২০.
মানুষের ছায়াগুলি রাস্তা জুড়ে কাটাকুটি খেলে
ঈষৎ ওপর দিয়ে উড়ে যায় পাখিদের ছায়া
কেউ কেউ বাঁধা পড়ে, শূন্যে ভেসে চলে তারপর।
কিছু কিছু বাধা পেয়ে মাটিতে আছাড় খায়, ভাঙে
জানি না এমন দৃষ্টি কোথা থেকে পেয়েছো ও চোখে
মনে হয় যেন মানুষের ডানা ছিল একদিন
আজ নেই শুধু তুমি আছো এই অপরাহ্ন স্রোতে
তোমার দেশের দিকে পায়ে বেঁধে আমাকে ওড়াও