এক কবি, এক সন্ন্যাসী ও এক যাদব কথা


এক তীব্র বর্ষণ মুখর রাতে
সমস্ত স্থান কাল পাত্র জুড়ে ব্যাপৃত
এক কবি কল্পনার প্রেক্ষাপটে
ক্রমে ক্রমে এক তরাই অঞ্চলে
তীব্র ধাবমান এক নদী আবির্ভূত হল,
কবি তার নাম রাখলেন মাহি।
নদীর ধারে এক রম্য অট্টালিকা ,
সেখানে উষ্ণ শয্যায় বসে বসে
ওম নিচ্ছেন এক অতি ধনী যাদব।
কবি তার পাশে নিদ্রিত রাখলেন
এক সুন্দরী  পতিব্রতা রমণী।
অন্য অন্য কক্ষে শায়িত রাখলেন
কয়েকটি আদরের পুত্র কন্যা।
গোশালায় স্থাপিত করলেন
তিরিশ হাজার হৃষ্ট পুষ্ট
গরু, বাছুর, বলদ।
এর পর কবি একটু দূরে
রোপন করলেন অতি বৃদ্ধ এক বট
তার নিচে শুধু একটি রাতের জন্য
আশ্রিত রাখলেন এক শ্রমণকে
কবি তার নাম দিলেন আনন্দ।
বট বৃক্ষকে দিলেন আকুলতা
তখন থেকেই সে সন্ন্যাসীকে
এই বিপুল বৃষ্টির দাপট থেকে
রক্ষা করার জন্য আকুল হল।
সন্ন্যাসীকে দিলেন এক মুক্ত চৈতন্য
সন্ন্যাসী সেই গাছের নিচে বিশ্রাম রত।
কবি অতঃপর যাদবের প্রতি মন দিলেন
এই উদ্দাম বৃষ্টিতে যাদব বেশ উৎফুল্ল
তার গোদোহন সমাপ্ত
গৃহিনীর হাতে সুস্বাদু রান্নায় রসনাও তৃপ্ত
মনে মনে ভাবলেন,
হে বরুণ, তুমি যত ইচ্ছা বৃষ্টি ঝরাও
এই অট্টালিকায় আমি সুরক্ষিত, উষ্ণ, তৃপ্ত !
কবির ঠোঁটে ফুটে উঠলো মৃদু হাসি
তিনি এবার সন্ন্যাসীর প্রতি মনযোগী হলেন।
নির্বিকার চিত্ত সন্ন্যাসীকে
প্রানপন আড়াল করতে ব্যাকুল বটবৃক্ষকে
আশ্বস্ত করলেন শ্রমণ,
ষড়রিপুকে পরাস্ত করে সেই শ্রমণ
যেদিন যেখানে পারেন সেখানেই রাত্রিবাস করেন,
আপাতত বৃষ্টির রেনু তাঁকে সিক্ত করছে
সন্ন্যাসী বরুণকে আহ্বান করে বললেন,
হে দেব, আপনি নিশ্চিন্তে বর্ষণ করান
আমি অন্তর থেকে সুরক্ষিত, উষ্ণ এবং তৃপ্ত !
মশামাছি বিহীন উষ্ণ কক্ষে
যাদব একবার কান খাড়া করে শুনলেন
গোশালায় গরু বলদেরা চুপচাপ,
পাশে নিদ্রিতা সুন্দরী স্ত্রী,
মনে মনে বরুণকে ধন্যবাদ দিলেন
এত বৃষ্টিতে মাঠ প্রান্তর ঘাসে ভরে যাবে
বলদ গরুদের দীর্ঘ দিনের খাদ্য সঞ্চিত হবে।
যাদব বললেন, হে বরুণ ,
তুমি যত পারো বৃষ্টি ঝরাও
আমি নিশ্চিন্ত !
কবি একটু নড়ে চড়ে বসলেন
সৃজন ছন্দ ধাবিত এবার সন্ন্যাসীর প্রতি---
এক দীর্ঘ সংযম, আত্ম সমীক্ষণ,
অধ্যবসায়, শিক্ষা, দীক্ষা সহযোগে নির্মিত
এক ভেলায় করে জীবনের সব
কামনা বাসনা সুখ দুঃখ
তৃপ্তি অতৃপ্তির নদী পেরিয়ে এসে
তিনি এই এই অঝোর বারিধারার প্রতি
শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,
হে বরুণ, আপনি যত ইচ্ছা বর্ষণ করুন
আমি সব বন্যা অতিক্রান্ত ,নিশ্চিন্ত, নিরাপদ !
যাদব যেন সামান্য  বিচলিত মনে হল
ঘুমন্ত স্ত্রীর মুখের পানে একবার চেয়ে
যাদব নিঃশব্দে অন্য কক্ষে নিদ্রিত সন্তানদের
একবার উঁকি দিয়ে দেখে এলেন
এরা সকলেই সুস্থ, সবল , পিতৃভক্ত
যাদব শান্ত হয়ে বিছানায় ফিরে গেলেন
নিজের কর্মক্ষম হাত দুটো একবার মুঠো করলেন
পেশি বহুল শরীরের দিকে তাকালেন
ঘরের কোণে মজবুত লোহার সিন্দুকে
সঞ্চিত বিপুল ধন সম্ভার
সম্পূর্ণ সুরক্ষিত,
বাইরে অঝোর বৃষ্টি
যাদব বললেন, হে বরুণ,
আপনি ইচ্ছা মতো বর্ষণ করুন
মনে আমার কোন অশান্তি নেই
আমি সুখী, ভবিষ্যত-ভাবনাহীন , নিশ্চিন্ত !
কবি পুনরায় সন্ন্যাসীর প্রতি মনোযোগী হলেন,
তিনি সন্ন্যাসীর জন্য
বরাদ্দ করেছেন একটুকরো চীর বসন
কপর্দক শুন্য সন্যাসী তবু কারোর অধীন নয়
তাঁর অধীনেও কোন মানব বা পশু পাখি নেই
কোন উষ্ণ কক্ষে তিনি বন্দী নন
তাঁর বিচরণ ক্ষেত্র সমগ্র পৃথিবী
সারা জীবন তপস্যার মাধ্যমে
যে অসীম সম্পদ  তাঁর আয়ত্ব
তা এতোই সুরক্ষিত যে কোন লৌহ সিন্দুক সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজন
সেই অসীম সম্পদে বলিয়ান শ্রমণ
বরুণ দেবকে বললেন,
আপনি ইচ্ছামতো বর্ষণ করান
আমি জন্ম-মৃত্যুর চক্রের অতীত
মহা নির্বাণ লাভই আমার ভবিতব্য।
কবি আবার মৃদু হাসলেন
তিনি যাদবের চোখে ঘুম দিলেন না
তার বদলে তাকে দিলেন সন্ন্যাসীর সন্ধান
যাদব কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে
বিছানায় উঠে বসলেন
এই যে এতো বৈভব তা কি সত্যই সুখ আনে ?
নাকি, সেই বৈভব আসলে এক ধরণের অতৃপ্তি ?
যাদব কি সেই অতৃপ্তিকেই সুখ বলে ভুল করছেন ?
তিনি থাকতে না পেরে ঘুমন্ত স্ত্রীকে ডেকে তুললেন
বললেন, পেয়েছি আমি সন্ধান পেয়েছি সেই মহা দ্রষ্টার !
কবি এবার একটু দম নিলেন
নিজেরই কল্পক্ষেত্রে নিজেকে মেলে ধরে
কিছুক্ষন নিরীক্ষণ করে
অবশেষে নিজেকেই প্রশ্ন করলেন---
আমি কে ? আমি কি ?
আমার তো যাদবের বৈভব নেই,
নেই  সন্ন্যাসীর জীবন,
বিস্তীর্ণ দিগন্তের দিকে তাকিয়ে
কবি দেখতে পেলেন এক আলোক স্তম্ভ
সেই ইশারা কবিকে অবহিত করলো তাঁর জন্ম বৃত্তান্ত
কবি সেই কোন আদিম কালের এক গুহা থেকে বেরিয়ে
আকাশের দিকে তাকালেন
সমস্ত আকাশ জুড়ে মুঠো মুঠো জুঁই ফুলের মতো তারা
কবি বুঝলেন, কবিতা শ্বাস প্রশ্বাসেরই মতো এক অনিবার্যতা
তাঁর কণ্ঠে নিসৃত হলো,
মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল-মাঝে
আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে
তাঁর প্রতীত হল , মানুষ তো সর্বাগ্রে কবি
মহাজাগতিক এক কাব্যবিস্ময়ই পারে
মানুষকে এক মহত্তর সত্যের সন্ধান দিতে---
True civilized worlds are poetic shocks:
shock of stars, sun, plants
animals, shock of the round globe,
of rain,light, numbers,
shock of life, shock of death....
যাদবের বৈভব নয়, সন্যাসীর কৃচ্ছ সাধন নয়
এক কাব্যিক সারল্যই পারে মানব সমাজকে
এক মহত্তর জীবনের সন্ধান দিতে....
সব শোক, দুঃখ, আনন্দ বেদনাকে
আপন অনুভূতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করার শক্তি কবিতা ছাড়া আর কেই বা দিতে পারে ?
Alone the poetic spirit corrodes and constructs, refines and revives
বাইরে মুষল ধারে বৃষ্টি কখন থেমে গেছে
কবির ঠোঁটে আবার ফুটে উঠলো মৃদু হাসি
কবি  বরুণ দেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
কিন্তু তুমি নেই বাহিরে---অন্তরে মেঘ করে
ভারী ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে !


( কবিতায় রবীন্দ্রনাথ, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও Aime Cesaire র উদ্ধৃতি ব্যবহৃত হয়েছে।)