কে সচ্চিদানন্দনের কবিতা


( কবি কে সচ্চিদানন্দ সমসাময়িক ভারতীয় কবিদের মধ্যে একজন শীর্ষস্থানীয় কবি। তাঁর সম্বন্ধে কিছু বলা আমার পক্ষে ধৃষ্টতা। ভারতীয় তথা বিদেশী বহুভাষায় তাঁর কবিতা অনুদিত হয়েছে। তিনি প্রধানত মলায়লম ও ইংরেজী ভাষায় লিখে থাকেন। ভারতে যত রকমের সাহিত্য সম্মান দেওয়া হয় সমস্তই তাঁর পাওয়া হয়ে গিয়েছে। তাঁর নাম সম্ভাব্য নোবেল প্রাপকদের তালিকাতেও বিবেচিত হয়েছে। অসামান্য কাব্যপ্রতিভার অধিকারী এই কবির চারটি কবিতা বাংলায় রূপান্তরিত করার প্রচেষ্টার মাধ্যমে কবিকে আমার বিনম্র প্রণাম জানাই। )


।।১।।


আমি


১৯৪৫ সাল
আমি মায়ের স্বপ্নে এসে বললাম,
মা, আমি আসছি ।
মা বিশ্বাসই করলো না।


জন্মে গেলে
বাবা কিন্তু ঠিক চিনেছিলো---
ওই যে আমার বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের জরুলটা
কিন্তু মা ?
আমৃত্যু বিশাস করে গেলো
আসলে আমি নয়
অন্য কেউ আমি হয়ে
তার কোলে চলে এসেছি !


বাবা আর আমি দুজনে মিলে চেষ্টা করেছিলাম
অনেক চেষ্টা করেছিলাম,
কিন্তু স্বপ্নের কথা তো
মানানো মুশকিল।
বেচারী মা, সারা জীবন
শুধু স্বপ্নের আমার অপেক্ষায় কাটিয়ে দিলো !


সব শেষে
মৃত্যুর পর
মা যখন আবার
আমার মেয়ে হয়ে জন্মাল,
তখন মায়ের ভুল ভাঙলো।
মা মানলো, আমিই তার
সেই স্বপ্নের ছেলে।


কিন্তু ততদিনে আমার মনে
সন্দেহ বেশ পাকাপোক্ত বাসা বেঁধেছে ।
আমি ভাবি এ কার হৃদপিন্ড ?
আমার বুকের মধ্যে ধুকপুক করে
এ কার হৃদপিন্ড ?


একদিন এ সমস্যা মিটে যাবে,
সেইদিন আমি খুঁজে নেব
আমার হৃদয়, আমার কথা।


।।২।।


মানুষ আসার আগে


মানুষ আসার অনেক আগে
পশু পাখিরা কইতো কত কথা


পশু পাখিরা আসার অনেক আগে
গাছ গাছালি কইতো কত কথা


গাছ গাছালি আসার অনেক আগে
পর্বতেরা কইতো কত কথা


পর্বতেরা আসার অনেক আগে
মহাসমুদ্র কইতো কত কথা


মহাসমুদ্র আসার অনেক আগে
আকাশ ছিল মুখর বাঙময়


মানুষ বলা করলো যেদিন শুরু
মন্ত্রবলে সবাই হোলো চুপ


ইস্পাতের সেই ফলার মতো কথা
নৈ:শব্দের গায়ে পড়লো ঢলে


দেখতে কি পাও ?
দিনের যখন সবে মাত্র শুরু
সবার অঙ্গ রক্ত মেখে লাল !


।।৩।।


তাহার নামটি উম্মুকুলসু


মেয়েটির নাম উম্মুকুলসু
ভীষণ বাজে নাম---
একটুও তার পছন্দ নয়।
নামের সাথে ঝগড়া করে
নামটি দিলো ফেলে
ছুড়ে বহুত দূরে।
কাঁদতে কাঁদতে নামটি গেল স্কুলে একটু দূরে
সিঁড়ির উপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে
কাঁদতে লাগলো নাম
উম্মুকুলসু, ভীষণ বাজে নাম।


আমার বন্ধু আবু বকর
দেখতে পেলো নাম।
কেগো তুমি ? কাঁদছো কেন ?
কি হয়েছে বলো ।


আমি উম্মুকুলসুর নাম
ও আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
আচ্ছা, নামহারা ওই মেয়ে
আমাকে ছেড়ে করবে কি তা বলো ?
লোকেই বা ওকে
ডাকবে কি করে বলো ?
ওতো স্কুলেও নেই, গ্রামেতেও নেই
বাড়ির কথাও ছাড়ো !


"উম্মুকুলসু, উম্মুকুলসু
যার নামটি হারিয়ে গেছে...."
আবু বকর যেই দিয়েছে ডাক
উম্মুকুলসু পিছন পানে চায়


এমনি করে উম্মুকুলসু
নামটি ফিরে পায়
ঠিক যেমন করে
নামকরণ তার দুনিয়া খুঁজে পায় !


।।৪।।


যত্র কবিতা


চ্যালা কাঠ একটার পর একটা
শব্দও একটার পর একটা
ক্রমশ: সাজিয়ে তুলি
নিজস্ব চিতার মতো কবিতা আমার
আমি ভস্মিভূত হই
আমারই কবিতায় শুয়ে।


কলাপাতার* ওপর শোয়ানো আমাকে
নিজেই চড়াই কবিতায় আমার
সমস্ত শব্দে আগুন ধরে যায়
আমার অস্থি মজ্জা চড়বড় করে
ফাটতে থাকে শব্দের তাতে
আমার হৃদপিন্ড ভাজা ভাজা হয়ে যায়
আমার কণ্ঠে আগুন লেগে
নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে গান


আমার নিজের চোখে দেখা জীবনের ছবি
আমারই চিতাকে ঘিরে প্রত্যক্ষ করো তুমি
জ্বলন্ত জীবন আমার পুড়ে খাক হতে থাকে
আমার ধমনী ফেটে বেরিয়ে আসে
সমস্ত স্বপ্ন নির্যাস
আমার মস্তিস্ক গলে গিয়ে
ছিটকে পড়তে থাকে টুকরো টুকরো স্মৃতি


তুমি আরো ঘৃতাহুতি দাও
ছুড়ে দাও আরো দুচার টুকরো কাঠ
আমার কানে পুড়তে থাকে ছোটবেলার গান
আঙুলের গাঁটগুলো খসে পড়ে
যত দূর হেঁটে গেছি সব পথ জ্বলে যায়।


আমি ছাই হয়ে যাই।


দেখো আমারই চিতা ভস্মে শুয়ে
ছানা পোনা নিয়ে মৌতাতে মাতে
এক বিড়াল পরিবার।
দেখো আমারই চিতা ভস্মে ফুটে ওঠে
বুনো ফুল বুনো চারার শাখায়।
দেখো আমারই চিতা ভস্ম গায়ে মেখে খেলে
কালো কুলো ছেলেমেয়ের দল।
দোহাই তোমায় এই ছাই ভাসিও না জলে !


(* কবির দেশে মৃত দেহ চিতায় তোলার আগে কলা পাতায় শোয়ানো হয়।)