ধন্যবাদ জানাই অনুসন্ধিৎসু কবি জে আর এ্যাগ্নেসকে। পদাবলী সাহিত্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চেয়ে তিনি একটি পোস্ট দেন। তাঁকে তথ্য দিতে এবং নিজের জানা তথ্যকে ঝালাই করে আরো সমৃদ্ধ করতে অবশেষে উইকিপিডিয়ার দ্বারস্থ হই। সেখান থেকে কিছুতথ্য চয়ন করে সহজ ভাষায় নিজের মত সম্পাদনা করলাম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এই রচনায় আমার কোন মৌলিকত্ব নেই। কেবলই নিজের জানাটুকু আসরের কবিদের সাথে ভাগ করা মাত্র। সুতরাং কারো চোখে কোন ভুল ত্রুটি ধরা পড়লে দয়া করে সংশোধন করে দিবেন।


পদাবলী সাহিত্যের গোড়ার কথা:
প্রাচীন ও মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের প্রধান ক্ষেত্রগুলো ছিল চর্যাপদ, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলি ইত্যাদি। পরবর্তীকালে বাউল গান ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ভানুসিংহের পদাবলী ইত্যাদি এই সাহিত্যকে আরো আধুনিক ও সমৃদ্ধ করে তোলে।


চর্যাপদ: একশ বছরও হয়নি! এইতো মাত্র সেদিন, ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কর্তৃক নেপালে আবিস্কৃত 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়' নামক পুঁথি থেকে ধারণা করা হয় - এটি বাংলা লিপি ও ভাষার সর্বপ্রাচীন নিদর্শন এবং নব্য ভারতীয় আর্যভাষারও প্রাচীনতম রচনা।  আজ চর্যাপদের সঙ্গে বাংলা ভাষার যোগসূত্র অনস্বীকার্য ও সর্বমহলে স্বীকৃত। প্রাচীন চর্যাপদের প্রধান কবিগণ ছিলেন লুইপাদ, কাহ্নপাদ, ভুসুকুপাদ, শবরপাদ প্রমুখ।


খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত এই গীতি-পদাবলির রচয়িতারা ছিলেন সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ। বৌদ্ধ ধর্মের গূঢ় অর্থ সাংকেতিক রূপের আশ্রয়ে ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যেই তাঁরা পদগুলি রচনা করেছিলেন। ধারণা করা হয়, বাংলা সাধন সংগীত (বিশেষত লালন গীতি, বাউল গান, দেহ-তত্ত্ব...) শাখাটির সূত্রপাতও হয়েছিলো এই চর্যাপদ থেকেই। এই বিবেচনায় এটি একটি ধর্মগ্রন্থজাতীয় রচনা। একই সঙ্গে সমকালীন বাংলার সামাজিক ও প্রাকৃতিক চিত্রাবলি এই পদগুলিতে উজ্জ্বল। এর সাহিত্যগুণ আজও চিত্তাকর্ষক।


মঙ্গলকাব্য: এটি মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের এক বিশেষ শ্রেণীর ধর্মবিষয়ক আখ্যান। মঙ্গলকাব্য ছিল সকল মধ্যযুগীয় সাহিত্যের ধারক, বাংলা ভাষার ক্রান্তীয় মধ্যযুগীয় বহিঃপ্রকাশ। মঙ্গলকাব্য বিশেষ কোনও হিন্দু দেব-দেবীকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। বলা হয়ে থাকে - এই কাব্যে আঞ্চলিক দেবতার আরাধনা তথা মাহাত্ম্য-কীর্তন করা হয়। এই কাব্য শ্রবণেও মঙ্গল হয় এবং বিপরীতে হয় অমঙ্গল। মঙ্গলাধারার যে কাব্য ঘরে রাখলেও মঙ্গল হয় তাকে মঙ্গলকাব্য বলা হয়।


মঙ্গল কাব্যের কয়েকজন বিখ্যাত কবি ছিলেন -
কানাহরি দত্ত, নারায়ণদেব, বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপলাই, মাধব আচার্য, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, ঘনরাম চক্রবর্তী, শ্রী শ্যাম পন্ডিত, ভরতচন্দ্র রায় গুনাকর, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ, দ্বিজ মাধব, আদি রূপরাম, মানিক রাম, ময়ূর ভট্ট, খেলারাম, রূপরাম, সীতারাম দাস, শ্যামপন্ডিত, দ্বিজ বংশী দাস, দ্বিজ প্রভারাম...


বৈষ্ণব পদাবলী: তারপরেই আসে বৈষ্ণব পদাবলীর কথা। ইহা বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্বের রসভাষ্য নামে খ্যাত একজাতীয় ধর্মসঙ্গীত। বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের সূচনা ঘটে চর্তুদশ শতকে বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস-এর সময়ে। তবে ষোড়শ শতকে এই সাহিত্যের বিকাশ হয়। বৈষ্ণব পদাবলীর প্রধান অবলম্বন রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা।


বৈষ্ণব পদাবলীর শিল্পীরা ছিলেন নরহরি সরকার , বাসু ঘোষ, লোচন দাস,জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, প্রমুখ। পরবর্তীকালে শ্রীচৈতন্য একে ধর্মীয় আন্দোলনে রূপান্তরিত করেন। বৈষ্ণব পদাবলী ব্রজবলি ও বাংলা ভাষায় রচিত।


নাথ সাহিত্য: এটিও প্রাচীন বাংলার একজাতীয় পদাবলি। যোগসাধনায় লিপ্ত নাথপন্থী সাধকেরাই ওই ধর্ম-সাহিত্যের মূল প্রেরণা। এজন্য নাথপন্থী সাধকদেরকে যোগী বলা হয়। বৌদ্ধগান ও দোহার ভাষারূপের পরিচয় মেলে নাথসাহিত্যে। নাথসাহিত্যের সিদ্ধপুরুষগণ - মীননাথ বা মৎস্যেন্দ্রনাথ, জলান্ধরীপাদ বা হাড়িপা, গোরক্ষনাথ বা গোরখনাথ এবং কানুপা বা কাহ্নপাদ প্রমুখ। 


চণ্ডীদাস: মধ্যযুগের চতুর্দশ শতকের বাঙালি কবি। তিনি চৈতন্য-পূর্ব বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলী রচয়িতা হিসেবে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। চৈতন্যদেবের জন্মের আগে থেকেই চণ্ডীদাসের নামে বহু গীতিপদ মানুষের মুখে মুখে ফিরত। চৈতন্যদেব নিজেও তাঁর পদ আস্বাদন করতেন। শ্রুতি আছে, রজকিনী রামী তাঁর সহজসাধনের সঙ্গিনী ছিলেন।


প্রসঙ্গত একটা তথ্য জানা দরকার মনে করি - বাংলা সাহিত্যে চণ্ডীদাস কিন্তু দুজন! পদাবলী রচয়িতা চণ্ডীদাস আর শ্রীকৃষ্ণকীর্তন রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাস - এঁরা এক ব্যক্তি নন।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: ব্রজবুলি ভাষায় রচিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিছু গান যেমন - 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী' বৈষ্ণব পদাবলী দ্বারা প্রভাবিত। এর মধ্যে বিখ্যাত - 'মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান', 'গহন কুসুম কুঞ্জমাঝে', 'শাঙন গগনে ঘোর ঘনঘটা' ইত্যাদি। এছাড়া- 'ওহে জীবন বল্লভ', 'মাঝে মাঝে তব দেখা পাই', 'নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে', 'আমি জেনেশুনে তবু ভুলে আছি' ইত্যাদি গানে বৈষ্ণব পদাবলীর ভাব প্রস্ফুটিত হয়েছে।


এখানে শুধু পদাবলী সাহিত্যের উৎসমুখ থেকে ধারাবাহিক প্রাচীন ইতিহাসটুকুই তুলে ধরেছি। এরপর আছে পদাবলী রচনার বৈশিষ্ট্য, শৈলী-কৌশল, নিয়ম-কানুন, ধরন-ধারন ইত্যাদি। সেসব বিষয়ে পাতার অন্য কোন বিজ্ঞ কবি আলোকপাত করবেন। সময়-সুযোগে মিললে অন্য কোনদিন আমিও আলোচনা করতে পারি। ধন্যবাদ সবাইকে।


* এবিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে বন্ধুরা উইকিপিডিয়ার সাহায্য নিতে পারেন।


সূত্র: ভৌমিক, দুলাল >"মঙ্গলকাব্য"> banglapedia