বাংলা-কবিতার তথ্যানুসারে নতুন নিবন্ধিত কবি 'স্বাগতা সাঈদে' এর জন্ম (২৭ এপ্রিল) জার্মানিতে। বর্তমানে তিনি ইংল্যান্ডে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত আছেন। এই আসরে নতুন যোগ দেয়া কবির এপর্যন্ত ২টি মাত্র কবিতার পোস্ট আছে। এর বাইরে এই কবির আর কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। পাঠকের জন্যে আলোচিত কবিতাটি তুলে ধরছি:


“অস্তিত্বহীনের অনন্তে”
- স্বাগতা সাঈদ


আকিলিসের তরবারির
সূর্য ছটা নই,
বহু ব্যবহারে ক্ষওয়া
কোনও কামারের হাতুড়ি… হয়তো!


ওডিসিউস এর ঘরে ফেরা নই,
পেনেলোপের প্রতীক্ষাও নই-
চিবুক ছুঁয়ে যাওয়া সম্রাটের আদরে
কোনও হারেমের শুকনো উষ্ণতা কেবল।


অর্জুনের বাণে বিদ্ধ
ভীষ্ম নই, দ্রোণ নই, কর্ণ নই!
অজস্র শবের কবরে
নাম-না-জানা সৈনিকের
শেষ শ্বাসের বিপুল ভার আমি।


হেলেনের প্রার্থনা-
দ্রৌপদীর প্রতিশোধ নই।
কাতর বিধবার ছেঁড়া কান্না ভেজা
ভবিষ্যৎহীন প্রলাপ-
আমার পরিচয়।


মহাভারত নই।
তবু মহাকাব্যের পথে
আমার হাঁটা।
বিরামহীন হারিয়ে চলা
দূর থেকে দূরে-
নিজ থেকেও বহু দূরে
আমার গন্তব্য-


কারও দানে নেই পূর্ণতা,
আমার শূন্যতায় নেই কারও ভাগ,
স্পর্শে অধরা আমি-
তোমার প্রজন্ম রক্ষায়।


বাঁধতে চাই, বাঁচতে চাই,
জড়াই, জুড়াই-
ধরা দিতে চাই, পারি না-
দুরের হতে চাই, ছাড়ি না-


অনন্ত মুক্তির আস্বাদে
অভিশাপ আমার।।


কবিতাটি পড়ে যথাসাধ্য উপলব্ধিতে এনে এর অন্তর্মূল ছুঁতে চাইলাম। বলতে দ্বিধা নেই, পৌরাণিক কাহিনী থেকে চরিত্র ও বিষয় চয়ন করায় কবিতাটির ম্যাটাফেজে'র' মটিভ' অভিসন্ধানে গুগলের দ্বারস্থ হয়ে যা পেলাম তা-ই এই কবিতার আলোকে নিজের মতো করে উপস্থাপন করছি:


শুরুতেই বলে নেয়া যাক; প্রাচীন গ্রিকের উপকথা নিয়ে রচিত মহাকবি হোমারের মহাকাব্যগুলো থেকেই পাশ্চাত্য সাহিত্য ধারার সূত্রপাত। তারমধ্যে ‘অডিসি’ এবং ‘ইলিয়াড’ অন্যতম। কথাসাহিত্য ও সাহিত্যের সাধারণ ইতিহাসে এই দুই মহাকাব্যের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। আর সেই ধারাক্রমে সূচিত হয়েই বিবর্তিত হতে হতে আজকের এই সাহিত্য রঙ্গম।


হোমার রচিত বিখ্যাত ‘মহাকাব্য অডিসি‘। গ্রিক উপকথার উপাখ্যান এই মহাকাব্যের দুঃসাহসীক যোদ্ধা অডিউসিউস বা ইউলিসিস (Ulixes) ছিলেন ইথাকার রাজা। তিনি প্রীক পুরাণের অন্যতম সাহসী ও কৌশলী বীর, চৌকশ বাগ্মী এবং কূটনীতিবিদ হিসাবেও সুবিধিত ছিলেন। তৎকালের সেরা সুন্দরী হেলেনের অগণিত পাণিপ্রার্থীদের মধ্যে অডিউসিউসও ছিলেন একজন, তথাপি তিনি হেলেনকে স্পার্টা রাজ মেনেলাউসের কাছে বিয়ে দিয়ে নিজে বিয়ে করেন হেলেনের আত্মীয়া পেনিলোপীকে। একসময় ট্রয়ের রাজপুত্র ‘প্যারিস’ মেনেলাউসের স্ত্রী হেলেনের প্রেমে অন্ধ হয়ে তাকে অপহরণ করে ট্রয়ে নিয়ে যান।


পরিণতিতে হেলেনকে মুক্ত করতেই শুরু হয় বহুল আলোচিত 'স্পার্টা বনাম ট্রয়ের যুদ্ধ'! অডিসিউসের দুঃসাহসীক পরিকল্পনায় সুদীর্ঘ ১০ বছরব্যাপী চলা স্পার্টা বনাম ট্রয় যুদ্ধের অবসান ঘটে। অপরদিকে হোমারের অপর মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘অ্যাকিউলিস’ও ছিলেন এক সুদর্শন এবং সাহসী ও চৌকশ যোদ্ধা।


দ্বান্দ্বিক ভাবনায় রচিত বিদ্রোহের অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় জ্বলতে থাকা এই কবিতায় ‘অ্যাকিউলিস’এর তরবারির কথাও বলা হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে কবিতায় ওডিসিউসের স্ত্রী ‘পেনিলোপি‘র প্রেম-প্রতীক্ষার কথাও এসেছে। তারপরই মহাভারতের বিখ্যাত যোদ্ধা দ্রোণাচার্য্য কর্ণ সহ অর্জুনের বাণে বিদ্ধ ভীষ্মকেও তুলে এনেছেন কবিতায়। গ্রিক পৌরাণিক মহাকাব্য থেকে মহাভারত পরিভ্রমণ শেষে সচেতনভাবেই যেন কবি আপনত্বে ফেরেন। অনুভব করেন তাঁর গন্তব্য - “নিজ থেকেও বহু দূরে” হয়তো বা কোনটিই নয়, গন্তব্য যার - এমনি অসীম শূন্যতার হাহাকারে এক স্বাপ্নিক পরিভ্রমণ...

গন্তেব্যের পর পরিচয় বিষয়েও কবি ভাবনার প্রকাশ পায় এইভাবে - “কাতর বিধবার ছেঁড়া কান্না ভেজা ভবিষ্যৎহীন প্রলাপ” হয়তো তাঁর পরিচয়... একসময় কবি অনুভব করেন -“কারও দানে নেই পূর্ণতা, আমার শূন্যতায় নেই কারও ভাগ।” খুবই বাস্তববাদী ভাবনার সার পাওয়ায় এই ক’টি কথায়!
অবশেষে, “অস্তিত্বহীনের অনন্তে” মুক্তির আস্বাদকে তিনি অভিশাপ এর সঙ্গেও তুলনা করেছেন।


পরাবাস্তবের পটভূমিতে রচিত কবিতা হলেও মননের সংবেদনশীল অনুভূতিগুলোকে যে এই কবিতায় প্রাধান্য দেয়া হয়েছে বেশ, তা বোঝাই যায়। যেমন;


"চিবুক ছুঁয়ে যাওয়া সম্রাটের আদরে
কোনও হারেমের শুকনো উষ্ণতা কেবল"


এই "শুকনো উষ্ণতা" যে ভালোবাসার নামে এক প্রহসন মাত্র - তা কবিতায় স্পষ্ট করেছেন কবি। এমনিভাবে হৃদয় নাড়িয়ে দেয়া আর এক উচ্চারণ; যখন পড়ি, শিহরিত হই -

"অজস্র শবের কবরে
নাম-না-জানা সৈনিকের
শেষ শ্বাসের বিপুল ভার আমি"


কবির এই উক্তিটি কি মানুষের হৃদয়ানুভূতিকে ক্ষণিকের জন্যে হলেও তছনছ করে দেয় না?


ঐতিহাসিক চিত্রকল্পের পরিসজ্জা কবিতাকে দিয়েছে অনেক ভাবনার প্যারাডক্স। যে ভাবনার নেই কোন মিমাংশা, নেই কোন সীমানা; যার গন্তব্য সীমানাটি তার অচেনা আর বিষ্ময়মাখা কল্পনা(?) মাত্র! এর সবই যে স্বপ্নকেও হার মানায়!


ঐতিহাসিক মেটাফেজের সম্মিলনে বিরচিত কবিতাটি যথার্থই এক বিমূর্ত ভাবনার বলেই মনে হয়েছে আমার; যার আদিও নেই অন্তও নেই, আছে কিছু সীমাহীন কাব্যিক বৃত্তান্ত বিশেষ! তাই কবি যেমন 'অস্তিত্বহীনের অনন্তে'র সীমাহীন ভাবনার আবর্তে হারান, সাথে নিয়ে যান তার পাঠককেও! তেমনি অনুগামী হয়ে খানিককাল কবিতাটি নিয়ে নাড়াচাড়া করলাম মাত্র।


এতকিছুর পরও কবিতাটির ঊন-পশমের ছোঁয়াও পেয়েছি বলে মনে হয়নি। আমার অপূর্ণ বোধের অগম্য এই দুর্দান্ত কবিতার কবিকে স্যালুট।