বন্ধুরা, হয় তো অনেকেই জানেন তারপরও আজ আমার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশের জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে কিছু তথ্য শেয়ার করতে চাই।


জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯ সালে, বাংলাদেশের বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। ২২ অক্টোবর, ১৯৫৪ প্রায় ৫৫ বছর বয়েসে তিনি (কোলকাতায় ট্রামের নিচে পড়ে আহত হন ও পরে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে) মৃত্যু বরণ করেন। কথিত আছে; পারিবারিক জীবনে তিনি তেমন সুখে-স্বস্তিতে ছিলেন না, তাই তাঁর এই ট্রাম-দুর্ঘটনাকে কেউ কেউ আত্মহত্যা হিসাবে চিহ্নিত করতে চায়।
  
তাঁর বাবা সত্যানন্দ দাশগুপ্ত (১৮৬৩-১৯৪২) ছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, বরিশাল ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক এবং ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। মাতা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন গৃহিনী, কিন্তু তিনি কবিতা লিখতেন। তাঁর সুপরিচিত কবিতা আদর্শ ছেলে (আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়ো হবে) আজও মানুষের হৃদয়ে গেঁথে আছে। পিতামাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান জীবনানন্দ দাশের ডাকনাম ছিল মিলু।


জীবনানন্দ কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি এ কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বি.এ. পাশ করেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগসহ মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীকালে তিনি কিছুকাল আইনশাস্ত্রেও অধ্যয়ন করেন। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে জীবনানন্দ কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন।

জীবনানন্দ দাশ এক সময় ‘দৈনিক স্বরাজ’ পত্রিকার সাহিত্য বিভাগের সম্পাদকও ছিলেন। তাঁর রচনায় বরাবর গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যময় প্রকৃতির চিত্র কাব্যময় হয়ে উঠেছে। তাই, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কবিতাকে ‘চিত্ররুপময়’ কবিতা বলে অভিহিত করেছেন। এছাড়া তাঁর রচিত কবিতায় আধুনিক নাগরিক জীবনের হতাশা, নিঃসঙ্গতা, বিষাদ ও সংশয়ের চিত্র দীপ্যমান হয়ে ফুটেছে। এছাড়া তাঁকে ধূসরতার কবি, তিমির হননের কবি, নির্জনতার কবি, রুপসী বাংলার কবি, বিপন্ন মানবতার নীল কণ্ঠ কবি ইত্যাদি অভিধায়ও অভিষিক্ত করা হয়ে থাকে। তিনি ছিলেন আধুনিক বাংলা কাব্যের ক্ষেত্রে কল্লোল যুগের কবি।


১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে অকাল মৃত্যুর আগে তিনি নিভৃতে ১৪টি উপন্যাস এবং ১০৮টি ছোটগল্প রচনা গ্রন্থ করেছেন। তিনি সম্পূর্ণ নিভৃতে উপন্যাস-ছোটগল্প লিখেছিলেন জীবনানন্দ এবং জীবদ্দশায় একটিও প্রকাশ করে যান নি। তাঁর মৃত্যুর পর উপন্যাস-গল্পের পাণ্ডুলিপির খাতাগুলো আবিষ্কার হয়। তাঁর জীবন কেটেছে চরম দারিদ্রতার মধ্যে। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধকাল পর্যন্ত অনপনেয়ভাবেই বাংলা কবিতায় তাঁর প্রভাব মুদ্রিত হয়েছে। রবীন্দ্র-পরবর্তীকালে বাংলা ভাষার প্রধান কবি হিসাবে তিনি সর্বসাধারণ্যে স্বীকৃত। তিনি ছিলেন বিবরবাসী মানুষ। তবে মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই তিনি বাংলা ভাষায় আধুনিক কবিতার পথিকৃতদের একজন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন।


২৯ বছর বয়েসে তিনি প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন - ‘ঝরা পালক’ (১৯২৮)। এ যাবত তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলো হ’ল - ঝরাপালক (১৯২৮), ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬), বনলতা সেন (১৯৪২), মহাপৃথিবী (১৯৪৪), সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮), রূপসী বাংলা (১৯৫৭), ও বেলা অবেলা কালবেলা (১৯৬১)।


তাঁর রচিত উপন্যাস ও প্রবন্ধগ্রন্থসমূহ - মাল্যবান (১৯৩৪), সতীর্থ (১৯৭৪), কল্যাণী(দেশ প্রত্রিকা: ১৯৯৯)। কবিতার কথা (প্রবন্ধগ্রন্থ ১৯৫৬)। তবে প্রবন্ধগ্রন্থ - কবিতার কথা (১৯৫৬), কাব্যগ্রন্থ - রূপসী বাংলা (১৯৫৭), বেলা অবেলা কালবেলা (১৯৬১), কল্যাণী (১৯৯৯)ইত্যাদি গ্রন্থসমূহ তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়। তাঁর অগ্রন্থিত কবিতাবলী নিয়ে প্রকাশিত কবিতা সংকলনগুলো হলো: সুদর্শনা (১৯৭৩), আলো পৃথিবী (১৯৮১), মনোবিহঙ্গম, হে প্রেম তোমার কথা ভেবে (১৯৯৮), অপ্রকাশিত একান্ন (১৯৯৯) এবং আবছায়া (২০০৪)।


জীবনানন্দ দাশের জীবন এবং কবিতার উপর প্রচুর গ্রন্থ লেখা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, বাংলা ভাষায়। এর বাইরে ইংরেজিতে তার ওপর লিখেছেন ক্লিনটন বি সিলি, ‘আ পোয়েট আর্পাট‌‌’ নামের একটি গ্রন্থে। ইংরেজি ছাড়াও ফরাসিসহ কয়েকটি ইউরোপীয় ভাষায় তাঁর কবিতা অনূদিত হয়েছে। বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থের বিখ্যাত কবিতা ‘বনলতা সেন’ কালজয়ী কাব্য হিসাবে স্বীকৃত। কথিত আছে -  ‘বনলতা সেন’ কবিতাটির বিষয়বস্ত্ত জীবনানন্দ দাশ কবি এডগার এলান পো’র ‘টু হেলেন’ কবিতা থেকে নিয়েছিলেন যা - ১৯৪২ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়।


নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলন ১৯৫২ খৃস্টাব্দে পরিবর্ধিত সিগনেট সংস্করণ বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থটি বাংলা ১৩৫৯-এর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ বিবেচনায় পুরস্কৃত করা হয়। কবির মৃত্যুর পর ১৯৫৫ খৃস্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৪) সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করে।


(উইকিপিডিয়া সহ নানান তথ্যসূত্র থেকে সংকলিত)