প্রথমেই পাঠক শুভানুধ্যায়ী ও কবি বন্ধুদের কাছে ক্ষমা চাইছি – চটকদারি শিরোনাম দেখে কেউ বিভ্রান্ত হবেন না যেন। আমার লেখায় কোন নিয়ম-কানুন বাতলাবো না বরং কবিতা লিখতে নিয়ম-কানুন যে খুব জরুরী নয় সে কথাটিই তুলে ধরার চেষ্টা... তবে নিয়ম-কানুন ‘নেই’-এর মাঝেও একটু শৃখলা থাকলে মন্দ হয় না।


আলোচনা সভায় আজ কবি স্থপতি হাফিজুর রহমান চৌধুরীর “কবিতা লেখার আসলে কি কোন নিয়ম কানুন আছে” শির্ষক রচনাটি পড়লাম। তখনই মনে পড়ল; কিছুদিন আগে আমি বানান বিষয়ে ধারাবাহিক লেখাগুলো পোস্ট করার সময় কতিপয় কবি বন্ধুর পরামর্শে এবং সেই লেখার ধারাবাহিক স্পৃহায় ও আপন গরজেই এ বিষয়ে কিছু লিখে রেখেছিলাম। বন্ধুদের কথাও দিয়েছিলাম যে, সময় সুযোগ মত কিছু লিখব। কিন্তু নানান বাস্তবতায় এতদিন তা আর পোস্ট করা হয় নি। আজ কবির আলোচনা থেকে প্রাণিত হয়েই সেই লেখাটি শেষ করে পোস্ট দিচ্ছি। সেই সাথে কবিবন্ধু হাফিজুর রহমান চৌধুরীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।


আমি এক মূর্খ কবি – ব্যক্তিগতভাবে মনে করি; কবিতা লেখার জন্যে অনেক শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত হতে হবেই বা কবিতা লেখার নিয়ম-কানুন জেনে-বুঝে আসতে হবে তার কোনটিই বাধ্যতামুলক নয়। কবিতা লেখার জন্যে কাব্যের প্রতি আসীম দরদই যথেষ্ট।  


তবে কবিবন্ধু হাফিজুর রহমান চৌধুরীর বক্তব্য - "ব্যক্তির অনুভূতিকে দশের অনুভূতিতে রূপান্তর করা" বিষয়ে আমিও একমত। আমার কথা; লেখাটি যেন স্পর্শগ্রাহ্য হয়, বিষয়বস্তু ও বক্তব্যের ঐক্যতানে বাঙময় হয়, বেশি সংখ্যক পাঠকের বোধের আওতায় থাকে এবং সবশেষে - লেখাটি পড়ে পাঠকের মনে যেন যুগপৎ আনন্দ দোলা দেয় ও ভাবের উদয় হয় এবং উপসংহারে একটা সারমর্ম নিয়ে তৃপ্ত হতে পারেন, ব্যস।


প্রসঙ্গক্রমে নিজের কথাটি বলতে চাই; মোটেও আমি শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত বা কবিতা লেখার নিয়ম-কানুন জেনে-বুঝে আসা লোক নই। যা-ই লিখি কাব্যের প্রতি দরদ থেকেই, অপরাপর কবিদের কাব্যপাঠে যে টুকু শিখতে পেরেছি; সে টুকুই লিখি। তার কতটুকু কবিতা হয় আমি নিজেও জানি না। পাঠক মানলে তা কবিতা না মানলে ছেঁড়াপাতা।


আমার ব্যক্তিগত মতামত - বোধ বক্তব্য ভাষা-বিন্যাস কাব্যময়তা চিত্রকল্প রূপক উপমার পাশাপাশি কবিকে আরো কিছু বিষয়ের প্রতি সবিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন। যেমন-


ক) কবিতায় বিধৃত বাক্য বা বক্তব্যের স্পষ্টতা: বাক্যে ব্যবহৃত শব্দটির ভুক্তিগত রূপান্তরের যথার্থ ও স্পষ্ট রূপটির প্রয়োগে সতর্কতা প্রয়োজন। তা নয় তো - বাক্যটি কোন রকমে বোঝা গেলেও কবির ভাষাজ্ঞানের দীনতা প্রকাশ পায়। তাই, আসরে অনেক কবির কবিতাতেই বানান সহ সে সব বিষয়গুলো যথাসম্ভব মার্জিত পরামর্শে সংশোধনের ইঙ্গিত করে থাকি। তাতে কেউ খুশি হন কেউ বা অপমানও বোধ করেন। এই লেখার সুবাদে সেইসব বন্ধুদের কাছে মার্জনা চাইছি। আমি যা বলি – কবির ভাল’র জন্যেই বলি।


খ) বানান ও ভাষা ব্যাকরণের প্রতি যত্নবান হওয়া: একটা নান্দনিক সুখপাঠ্য কবিতার জন্যে সুন্দর ভাষার যথার্থ (ব্যাকরণ সম্মত) প্রয়োগ ছাড়াও বানানের শুদ্ধতার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। বানান ভুলের জন্যে অনেক সময় অর্থ এবং বক্তব্য পাল্টে যায়। যেমন - দাঁড়ি/দাড়ি/দারি/ধারী; নয়/নই/নেই/নেয়/নিই; করাই/কড়াই/করায়; পড়াই/পরাই; ক্ষুধা/খুদা ইত্যাদি। শব্দগুলো খেয়াল করে দেখুন বানানের একটু হেরফের হলে অর্থ ও বোধের কত তারতম্য ঘটে যায়। সুতরাং একটা সুন্দর কবিতার জন্যে বানানের শুদ্ধতা অপরিহার্য শর্ত বলে আমি মনে করি।


গ) সুন্দর বিন্যাস ও সম্পাদনার রুচিজ্ঞান: একজন কবি বা সাহিত্যিক কিন্তু একজন শব্দশিল্পীও। সুতরাং তাঁর শিল্পবোধ অবশ্যই নান্দনিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। অনেক সুন্দর লেখাও যেনতেন ভাবে ‘খড়ের গাদা’ কিংবা ‘কাকের ঠ্যাং, বকের ঠ্যাং’ এর মত ফেলে গেলেই হয় না। এর পরিবেশনায়ও শিল্পবোধ থাকতে হয়। তবেই পাঠক পড়তে আগ্রহ বোধ করবেন। যেমন; অনেক সাধারণ মানের খাবারেও পরিবেশন গুণে আকর্ষণ বাড়ে, এটাও তেমনি একটা আর্ট।


ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি; একটা লেখায় (তা কবিতাই হোক বা গল্প প্রবন্ধই হোক) যত ভাল ও জ্ঞানগর্ভ বিষয়ই থাকুক না কেন - তা যদি সম্পাদনা জ্ঞানের অভাবে আবর্জনার স্তূপ বলে মনে হয়, তখন পড়তে আগ্রহ পাই না, ক্ষেত্রবিশেষে বিরক্তিরই উদ্রেক করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমি তো পড়িই না! অন্যেরা পড়েন কি না আমার জানা নেই। যেমন – এই লেখাটি যদি আমি কোন প্যারা না করে বিরতিহীন ভাবে লিখে যেতাম তা হলে আমার বিশ্বাস – অনেকেই পড়তে আগ্রহ বোধ করতেন না। কিন্তু বিন্যাসটা সুন্দর হলে পুরোটা না পড়লেও দুই এক প্যারা পড়বেনই। সেই দুই এক প্যারা পড়ে ভাল লাগলে পুরোটাও পড়তে পারেন।


ঘ) সঠিক যতিচিহ্নের ব্যবহার: বাংলাভাষায় মূল যতিচিহ্ন মাত্র তিনটি; দাঁড়ি, কমা ও প্রশ্নবোধক চিহ্ন। সম্প্রতি বিদেশি ভাষার চর্চার ফলে আমরা এখন আরো অনেক যতিচিহ্নের ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু একই ভাব প্রকাশে বিভিন্ন জন তাঁর বোধ ও মেধা মোতাবেক পছন্দসই যতিচিহ্নের ব্যবহার করতেই পারেন। কিন্তু যা-ই করি না কেন তাতে বুঝতে যেন কারো অসুবিধা না হয়, ভাবের ব্যাত্যয় না ঘটে – সে বিষয়টাও মাথায় রাখতে হবে। একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা আরো পরিস্কার করা যাক; একটা দেয়াল লিখন - 'এখানে প্রশ্রাব করবেন না, করলে দণ্ডিত হবেন।' এবার বাক্যের মধ্যস্থিত (,) কমা-টি নড়িয়ে দিলে কি অর্থ দাঁড়ায় দেখুন -  'এখানে প্রশ্রাব করবেন, না করলে দণ্ডিত হবেন।'  যতিচিহ্নের ভুল প্রয়োগে কেমন বিপত্তি ঘটাতে পারে দেখলেন তো!


ঙ) কবিতার ছন্দ ও তান: অনেকেই মনে করি – অন্তমিলে দোলে দোলে পড়তে পারাটাই বুঝি ছন্দ। আসলে তা নয়; গদ্য কবিতা কিংবা পয়ার ছন্দের কবিতা যা-ই লিখি না কেন, সব ক্ষেত্রেই ছন্দ থাকলে কবিতাটি বেশী শ্রুতিমধুর ও চিত্তকর্ষক লাগে। সে কারণে ছন্দের ধারণা থাকা ভাল। বিধি-বিধানের ছন্দ যদি না-ও মানি কবিতার অন্তস্থিত তানটি যেন গানের তানের মতই একটা অভ্যন্তরীন সুরের মূর্ছনা জাগায় – অন্ত-সলিলা স্রোতের মত।


চ) আকর্ষণীয় শিরোনাম ও আকার: আমি মনে করি; যুগ বাস্তবতায় অনেকেরই হাতে সময় কম। অল্প সময়ে একটা কবিতা পড়ে তার নির্যাস থেকে নিজেকে আনন্দ রসে সিক্ত করার ইচ্ছা অনেকেরই আছে। কবিতাটি বেশি বড় হলে তা অনেক সময় আনন্দ আহরণের চেয়ে বিরক্তির উদ্রেকই বেশি করে। যদিও বিষয়টা অবশ্য পালনীয় নয়, তবু পাঠক অনুভূতি বিবেচনায় রেখে বড় কবিতা প্রয়োজনে পর্বে ভাগ করে পোস্ট দিলে ভাল হয়। এ ছাড়া অনেকেই চার থেকে ছয় আট এমন কি দশ শব্দের শিরোনামও দিয়ে থাকেন। এটা দেখতে যেমন দৃষ্টিকটু তেমনি কবির রুচি-বোধের বিষয়ে পাঠকের বিরূপ মনোভাব জাগতে পারে। কাজেই, সুন্দর কবিতার জন্যে একটি মনোগ্রাহী শিরোনামের বিষয়টাও মাথায় রাখতে হবে।


আমার কৈফিয়ত: সবশেষে বলবো; লেখাটি কোন তাত্ত্বিক আলোচনা বা নিয়ম নির্দেশক নয়। আমি নিজে উল্লেখিত বিষয়সমূহ মাথায় রেখেই লিখি – তার কতটা কবিতা হয়, না হয় তা আপনারাই বিবেচনা করবেন। কষ্ট স্বীকার করে লেখাটি পড়ার জন্যে বন্ধুদের ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানাই। সবাই ভাল থাকুন।