হোক বা না হোক –
কবিতা নিয়ে মনে জাগে শত ভাবনা!
কবি জানে না; কতটা লিখলে তা শুয়োপোকা থেকে প্রজাপতি হয়ে আকাশে ডানা মেলবে। কবিতার ছায়ায় তাই হাতির পাঁচ-পা দেখি। দুঃসাহসের আকাশ টেনে নামাই গোধূলির আভায়। হাজার তারায় সাজাতে চাই কবিতার জমিন। মুক্ত গবাক্ষে যতই তাকাই, দেখি – ধূ-ধূ মরীচিকা তবু ছুটে যাই কবিতার পিছু পিছু, পাড়ি দিই গোবী সাহারা... অসহায় আমি তবু কবিতায় সান্ত্বনার বাণী খুঁজি...

দ্বিধা সংকট না-ই কাটে যদি
যাই তবু গড়ে জীবনের কাব্য
ঘুমঘোরে থাক স্বপ্নের ভরানদী
দেখি না তা নাব্য কি অনাব্য।

শুরুতেই বলে নিতে চাই, আমি কোন সুলেখিয়ে কবি নই। ভাল কাব্য-পাঠক বা সমঝদার; তেমন দাবিও বুকে হাত রেখে করতে পারি না। কবিতার নিয়ম-কানুন বা ব্যাকরণ যেমন বুঝি কম, মানি তারও চেয়ে কম। আমার ভাবনা একান্তই আমার ব্যক্তিগত... আমার বক্তব্যে কোন কবিবন্ধুর দ্বিমত থাকতেই পারে। তাঁর মতকেও আমি সমীহ করি।


কবিতা ব্লগে অবাধ লেখার সুবিধার সুবাদে অনেক শিক্ষিত ও শীলিত কবির ভিড়ে আমি কাব্যচর্চার এক নবিশী মাত্র। ব্লগে সবার লেখা পড়ে আনন্দ নিই, কখনো ভাবের ঘোরে একটু-আধটু লিখে ফেলি, সেসবের কতটা কবিতা হয়ে উঠে সেই সন্দেহ কখনো ঘুচাতে পারি না। এ কথা জানি ও মানি; কোন কবিতার সব কথাই যেমন সব পাঠকের কাছে সমান কাব্য মর্যাদা পায় না তেমনি একজন কবির সব কবিতাই সব পাঠকের কাছে কবিতা হয়ে ধরা দেয় না। সুতরাং আমি কোন ছার, কোন লেখাটি কবিতা হয়ে উঠেছে কি হয়নি সে মূল্যায়ন করে রায় দেয়া মনে হয় বড় কবির পক্ষেও দুরূহ কাজ।

আধুনিককালে কবিতার ব্যাকরণ অনুসরণ করা হয় না বলেই আমার মত লেখিয়েও দু’চরণ লিখে ফেলি। কিন্তু ছন্দে ফেলে কবিতা গাঁথা বেশ কঠিন কাজ। ভাবুক মনের প্রকাশের স্বাধীনতাকে অবাধ করে দিয়েছে অধুনা মুক্তগদ্যের কবিতা। সবার দেখাদেখি আমিও তাই, মাঝেমাঝে দু একটা লিখি। সত্যই তা কবিতা হয়েছে কি-না সে সংশয় আমারো থাকে। চেষ্টা করি; ভাবের অন্তর্গত ভাষায় ছন্দের টোন ধরে রেখে কিছু অর্থপূর্ণ সুসামঞ্জস্য কথামালায় যথাসম্ভব নিপুণ গ্রন্থনা পাঠককে উপহার দেয়ার।

চিরাচরিত ছন্দের কবিতা লেখায় মুন্সিয়ানা আছে, কিছু নিয়ম-কানুন মানতে হয় তবে, মুক্তগদ্যে লেখার সুবিধা এই –

“মানে না শাসন, নিষেধ বারণ
যথা খুশি যাও চায় যা এ মন।“

কী মজা! এখানে তেমন কোন নিয়ম-কানুনের বেড়াজাল নেই! মুক্তগদ্যের প্রকাশে ছন্দের শৃঙ্খলের বাধ্যবাধকতা নেই! তবে একেবারে শৃঙ্খলমুক্ত বা উশৃঙ্খল হলেও কাব্য-রেলের বগী লাইনচ্চুত হবার সম্ভাবনা প্রবল। ‘উশৃঙ্খল’ শব্দটি
যথেচ্ছাচার বা অনাচারের পর্যায়েই পড়ে। আসলে জীবনের সব কিছুর মতই এখানেও পরিমিতিবোধের বিষয় রয়েছে। কতটা বন্ধনমুক্ত হলে কবি তাঁর লেখনীর গতিকে আয়ত্বে রেখে সসম্মানে লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারবেন - তা কবিকেই নির্ধারণ করতে হবে।


কবি হলেন দ্রষ্টা। যিনি দেখেন তিনিই দ্রষ্টা কিন্তু কবি দেখেন - তৃতীয় নয়নের নিবিড় অনুভূতির দর্শন দিয়ে আর সেভাবেই প্রকাশও করেন। এখানেই সাধারণ দ্রষ্টার সাথে কবির পার্থক্য। একটি সাধারণ অনুভূতি ঘটনা বা ভাবনাকে কবি উপমা উৎপ্রেক্ষায় সাজিয়ে নানান রূপকের নান্দনিক ব্যঞ্জনায় উপস্থাপন করে পাঠকের কাছে মনোগ্রাহী করে তোলেন। কবি মূলত শব্দশিল্পী, শব্দের কারুময় বিন্যাসে তিনি মনের ভাবকে সাজিয়ে পরিবেশন করেন। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান থেকে যা বুঝি তা হল; বাস্তব কিংবা কল্পনার আবেগাশ্রিত ভাবনা – শৈল্পিক বিন্যাসে স্ফুরিত চারুময় নান্দনিক রূপটিই কবিতা। এখানে কবি হলেন সেই শিল্পের চারুকার।


অপরাপর শিল্পে যেমন বস্তুজাত কাঁচামাল ব্যবহার করা হয় কাব্যশিল্পে কিন্তু তা নয়। এখানে রয়েছে ‘শব্দ’ নামের কাঁচামাল। সেই শব্দের সুনিপুণ বিন্যাসেই কাব্যশিল্পের চারুময় চিত্রটি মূর্ত হয়ে উঠে। কারুশিল্পের মতই বিভিন্ন আকৃতির ‘শব্দ’ সন্নিহিত করে এ শিল্পের কারুকার্য ফুটিয়ে তুলতে হয়। সুতরাং পাঠকের চাহিদা ও তৃপ্তির কথা মাথায় রেখে মনের ভাবের নান্দনিক প্রকাশই একজন কবির সাধনা হওয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি।

কোন এক প্রিয় কবির কবিতার ভাললাগা অংশ থেকে উধৃত করছি - "ঋতু বদলে যায় ঋতুচক্রে জলের গোপন সংকেতে/বদলে যায় বাতাসেরও দিক-ভাষা শব্দে-নৈঃশব্দ্যে”। আমি বলি; তা হল সময়ের বাস্তবতা। প্রকৃতি বদলায়। বদলায় সময়েরও চেহারা। কালের ঘর্ষণে-আবর্তে কখন যে জীবন ও প্রকৃতি আজকের পরিচিত দর্শন থেকে এক ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করবে তা ক্ষুদ্র এই মানবজীবনের প্রক্ষাপটে কল্পনা করা কঠিন। তবে সবকিছুরই পরিবর্তন একটা শাশ্বত ধারা। কেউ চাক বা না চাক - একে মেনে নিতেই হয়, ধারণ করতে হয়। কবিতাও তা-ই, সময়ের ঘূর্ণিচক্রে এর বিবর্তনও অবশ্যম্ভাবী। কোন কোন কবিকে কখনো বেশ জোর করে পরিবর্তনের সাধনা করতে দেখি। এটা যেমন ঠিক নয় তেমনি পরিবর্তন বিষয়ে কোন কবিকে উদাসীন থাকাও বা বাধ সাধাও কাম্য নয়।

জীবনের প্রতি পর্বে রয়েছে কবিতা। কাব্যরসে ভিজিয়ে নানামুখী ভাবনার নান্দনিক উপস্থাপনাই কবিতা। শুধু লেখাতেই কবিতা হয় না, কবিতা আছে জীবনের নানা কর্মে, নানা পর্বে। নিত্য জীবনের যেখানেই ছন্দ-বর্ণের উপস্থিতি সেখানেই কবিতা খুঁজে পাই। সুতরাং কাব্যময়তাই জীবনের স্পন্দিত প্রতিরূপ।