যারা কবিতা লিখেন বা কাব্যচর্চা করেন অনেকের মনেই কবিতাকেন্দ্রিক নানান ভাবনা কাজ করে। আমিও তেমনি একজন; সীমিত জ্ঞানে ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও কবিতা নিয়ে ভাবনা আসে মনে। সেই ভাবনা থেকে উদ্ভুত কিছু বিষয় আজ সম্মানীত কবি পাঠকমণ্ডলীর সাথে শেয়ার করতে চাই।


আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে ও বাংলা কবিতা আসরের উন্মুক্ত সুবিধার সুবাদে চাইলেই যে কেউ কবিতার নামে কিছু লিখতে পারছি বটে, কিন্তু সবই কি আর কবিতা হয়ে উঠে না কবিত্বের বাথানে স্থান পাবার যোগ্য? এই কবিতা আসরের কথাই বলি; প্রতিদিন যে কবিতা পোস্ট হয় এখানে, তার কত শতাংশই বা যথার্থ কবিতা? সৌখিন কবিরা তবু তো চেষ্টা করছি, শিখছি, কিছু লিখছিও। এভাবেই হয়তো ক্রমে পরিশীলিত হয়ে আমাদের মাঝেও কবিত্ব বোধ জাগ্রত হবে। এসবের মাঝ থেকেও হয়তো একদিন কিছু কালজয়ী লেখনীর সৃষ্টি হয়েও যেতে পারে।


অনেককেই বলতে শুনি; যে কবিতাটি আজ কবিতার মর্যাদা পাচ্ছে না বা বোধগম্য বলে মনে হচ্ছে না – কালের বিবেচনায় তা ই একদিন কবিত্বের মর্যাদা পেতেও পারে। কথাটা ঢালাও ভাবে সবার জন্য প্রযুজ্য নয়। বস্তুত কথাটি হল; যথার্থ কাব্যবোধ ও পুষ্ট কাব্য ভাবনায় সিদ্ধ কোন বিদগ্ধ কবি যদি কোন বিশেষ ধারা বা স্বতন্ত্র বোধের প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পান যা হালের কাব্যবোধ বা চিরাচরিত রীতি-ধারা মোতাবেক অগৌণ বলে মনে হতে পারে, সেসব কবিতা হয়তো কালের বিচারে কোন এক সময় বিশেষত্বের মর্যাদাও পেতে পারে। যেমন কবি জীবনানন্দ দাশের জীবনকালে তিনি তাঁর রচনার জন্য তেমন স্বীকৃতি পাননি বরং সমালোচিত হয়েছেন ঢের অথচ মরণোত্তর দুই দশকেরও কম সময়ে তাঁর লেখনী বাংলার কাব্যজগতে একআকাশ উচ্চতা নিয়ে প্রতিভাত হচ্ছে। এমন কি তাঁকে আজ আধুনিক বাংলা কবিতার জনক হিসাবেও সম্মান দেখানো হচ্ছে।

আসলে কবিতা বোধের বিষয়, চাইলেই কবিতা লিখা যায় কিন্তু কবি হওয়া যায় না। কবি হওয়ার জন্য বিশেষ মননচর্চার পাশাপাশি যে আশীর্বাদটি দরকার তা হল; ঐশ্বরিক প্রতিভা, যা – অনেকেরই থাকে না। আবার বিশেষ আগ্রহ ও চর্চার মাধ্যমে দিনে দিনে কাব্যবোধ শাণিত হয়ে সে অভাবটি কিছুটা হলেও দূরীভুত হতে পারে। মূল কথা যত চর্চা তত সাফল্য।


আসরে বেশ কিছু গুণী কবি আছেন – প্রকৃতই স্বভাব কবি। তাঁরা যে কোন বিষয়কেই বিশেষ দক্ষতায় কাব্যিকতায় রূপ দিতে পারেন। এই বিশেষ গুণের জন্যে তাঁরা স্বকীয় বৈশিষ্ঠ্যে সমুজ্জ্বল। পাতায় বেশ কিছু কবির লেখা আমার খুব প্রিয় (নামোচ্চারণ করা ঠিক হবে না, তাই বিরত থাকলাম)। কতক ক্ষেত্রে তাদের লেখা আমার কাছে বিশিষ্ট্য কবিদের তুলনায় মোটেও দুর্বল বলে মনে হয় না। তাই পারতপক্ষে তাঁদের লেখা মিস করতে চাই না। কেন না এমন ধারার লেখা পড়ে যেমন আনন্দ মিলে তেমনি অনেক কাব্যস্পৃহা তৈরী হয়, কিছু শেখাও যায়। তাদের লেখায় প্রাণিত হয়ে লেখা আমার অজস্র কবিতা এই পাতাতেই আছে।  


কিছু কবিতা আছে - 'স্বোৎসারিত'(self devoted)। কবির মনে আপনা থেকেই গুঞ্জরিত হয়ে উঠে। সৃষ্টির বুদবুদ কবিকে মাতোয়ারা করে তোলে। তাইতো শিশু বয়েসেই প্রিয় কবি নজরুল লেটুর দলের গান ও পালা রচনা করতে পারতেন। এটা স্রষ্টা প্রদত্ত গুণ, যা - সবার থাকে না। এ জাতীয় কবিতাগুলোতে প্রাণের ছোঁয়া মিলে। কবিতার বিষয় ও বোধের সাথে কবির স্বতঃস্ফূর্ত ভাবের মিলন ঘটে। পাঠককে চৌম্বকীয় আবেশে মুগ্ধ করে রাখে।    

আবার কিছু কবিতা কেবলই 'সৃজিত'(created)। কাব্যিকতার অলংকরণে অনেক সময় শ্রুতিমধুর কবিতা হয় বটে (আধুনিক ধারার কবিতাগুলো আমার কাছে তেমনই মনে হয়)। যেমন মহাকবি মাইকেলের ভাষায় - 'শব্দের সাথে শব্দের বিয়া দেওয়া'। এগুলো হল তেমন ধারার লেখনী। তাতে কবিত্ব থাকলেও প্রাণের স্ফুরণ কেমন যেন জলো জলো লাগে। সেসব কবিতা আমার কাছে ‘শব্দ নৈপুণ্যতার খেলা’ বলেই মনে হয়। তাই, সাহস করে মাঝে মাঝে আমিও কিছু খেলি।


কবিতা লিখার কোন আদর্শ নীতিমালা বা ব্যাকরণ নেই। তবে কবির রচনার সুন্দর ও সাবলীল বোধটি পাঠক হৃদয়ে গেঁথে দিতে কবিকে অবশ্যই যত্নশীল হতে হবে। মননে ও সৃজনে-বিন্যাসে কবি অবশ্যই কিছু রুচি ও শৈল্পিক বোধের পরিচয় দিবেন। কবিদের কাছ থেকে তেমনটি প্রত্যাশা। নয়তো অনেক সুন্দর রচনাও হ য ব র ল হয়ে উঠে। তাই সৌখিন কবি বন্ধুদের প্রতি আমার কিছু নিবেদন আছে। কবিতা আমরা যা ই লিখি না কেন নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি নজর দেয়ার জোর সুপারিশ রাখছি।


কেউ কেউ লেখায় দাঁড়ির পরিবর্তে (| )চিহ্নটি ব্যবহার করেন (কেউ আবার '~' চিহ্ন বা অকারণ কিছু 'dots' ব্যবহার করেন) এসব ভাষা, প্রেস কিংবা ব্যাকরণ সিদ্ধ নয়। বাক্যের অসম্পূর্ণতা তথা; আরো কিছু অষ্পষ্ট বা অপ্রকাশিত বক্তব্য বোঝাতে (three dots)এর ব্যবহার স্বীকৃত বটে। কিন্তু তা হতে হবে শব্দটির সাথে সাথেই মাত্র তিনটি 'dots' তার বেশি একটিও নয়। আবার একটি রচনায় বারবার এর প্রয়োগ ভাব প্রকাশে কবির অক্ষমতা/অযোগ্যতা বলেই বিবেচিত হয়ে থাকে। লেখার নান্দনিকতা বাড়তে কেউ এসব ব্যবহার করলেও সেসব বরং সৌন্দর্যই নষ্ট করে। তাই সেসবের ব্যাবহার অবশ্যই পরিত্যাজ্য।


অনেকে আবার যতি-চিহ্নগুলোর প্রয়োগের ক্ষেত্রে সেগুলোর ব্যবহারে ভীষণ উদাসীন। কেউ বা আবার আগে পরে কতটুকু স্পেস দিতে হয় তাও খেয়াল করেন না। 'কাব্য কৌমুদী' এবং বর্তমানে কবি শিমুল শুভ্র'এ শত কবির কবিতার সম্পাদনা করতে গিয়ে সমস্যাগুলো হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। সরাসরি এসব পাণ্ডুলিপি কম্পোজে প্রেস গ্রহণ করে না, তাই সেসব একটি একটি করে খুঁটে খুঁটে পরিবর্তন করতে হয়। কম্পোজ বা প্রুফে তা যেমন ঝামেলার কাজ তেমনি লেখার সৌন্দর্যও বিঘ্নিত হয়। এসব প্রকাশনার নীতিমালার বাইরে তাই সে সবকে পরিবর্তন করতে হয়, নয়তো লেখার সৌন্দর্য বিঘ্নিত হয়। সাইটে(punctuation)এর কোন নীতিমালা নেই বিধায় এখানে আমরা যথেচ্ছ ব্যবহার করে যাচ্ছি বটে, কিন্তু আসলে এগুলোর ব্যবহার সাহিত্য বা প্রেস সিদ্ধ নয়, দেখায়ও শোভন কিছু নয়।


দুঃখিত বন্ধুরা, এতক্ষণ 'ধান ভানতে শিবের গীত' গাইলাম খানিক। আমার বক্তব্য কোন শাশ্বত বাণী নয়, কেবল অভিজ্ঞতা প্রসুত। তাই ভুল-ত্রুটি মার্জনীয়।


ধৈর্য ধরে আমার লেখা পড়ার জন্য কবি/পাঠকদের আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানাই।