ভালোবাসো নিজেকে? কবিতার কাছে এসো
কবিতার বুদবুদ মাথায় ফুসকুঁড়ি ভাঙে?
তবে তুমি কবি! সাধুবাদ জানাই তোমাকে!!
তুমি কবি, চিনতে চাও নিজেকে?
ফিরে এসো কবিদের কাছে
কবিতা তোমায় দিবে জীবনের গান
কবিগণ করবে হরণ নিশ্চিত মনঃপ্রাণ।


হ্যাঁ, বাংলা-কবিতা আসরের ভারতীয় কবিবন্ধুরা এবার মনপ্রাণই হরণ করেছেন। ১৫ জানুয়ারি ২০১৯ কবিবন্ধু সৌমেন বন্দোপাধ্যায়ের পোষ্টে ঘোষণা আসে - ৭ এপ্রিল রবিবার দুই বাংলার কবিদের যৌথ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যগত সীমাবদ্ধতা এবং পূর্ব থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না থাকায় গতবছর যেতে পারিনি তাই এবার কোমর বেঁধেই নেমেছিলাম। কোলকাতা সম্মেলনের প্রায় আড়াই মাস আগে পাসপোর্ট নবায়ন করতে দিয়েও অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই আমলাতান্ত্রিক মুৎসুদ্দিদের কাছে জিম্মি হয়ে যাই। কিন্তু যেকোন  মূল্যে এবার কোলকাতা যেতেই হবে। তাই বাধ্য হয়ে অন্যায়ের সাথে সমঝোতা করে পাসপোর্ট নবায়ন করি। ভিসা প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা ছাড়াও নানাবিধ সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে অবশেষে আমরা পাঁচজন উপস্থিত হতে পেরেছিলাম। স্মর্তব্য, আমার অপর দুই সফরসঙ্গী সকল প্রস্তুতি সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত ভিসা জটিলতায় বাদ পড়ে যান। সেদিক থেকে আমি খুব ভাগ্যবান যে, নির্বিঘ্নে যেতে পেরেছি।


কাল-বোশেখীর ঘূর্ণিঝড় মাথায় করে সবার আগে ৫ এপ্রিল আমি কোলকাতায় পৌঁছাই। কবিবন্ধু বিভূতি দাস ও সৌমেন বন্দোপাধ্যায় চিৎপুর থেকে আমাকে বরণ করে হোটেলে নিয়ে আসনে। যদিও পূর্বাহ্নেই কবিবন্ধু চিত্তরঞ্জন সরকার, সমীর প্রামাণিক, বিভূতি দাস প্রমুখ বারবার ফোন করে হোটেলে না উঠে তাঁদের বাড়িতে আতিথেয়তা প্রহণের অনুরোধ জানাতে থাকেন। কিন্তু আমার সঙ্গে অপর বন্ধুরাও রয়েছেন সেই বাস্তবতায় কারোর অনুরোধই রক্ষা করা না গেলেও কথা দিয়েছিলাম যে, সময় সুযোগমত তাঁদের আথিতেয়তার অনুরোধ রক্ষা করবো। এবং অনুষ্ঠান শেষে কদিন ধরেই বন্ধুদের ভ্রাতৃসুলভ মমতাময় আতিথেয়তার স্বাদ গ্রহণ করে ধন্য হয়েছি। তাই সবাই চলে এলেও একসপ্তাহ ধরে দুর্লভ আপ্যায়ন ও সাহচর্যে স্মৃতির ঝাঁপি ভরে তবে ফিরেছি অনেক পরে। স্বভাবতই সম্মেলনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে আমার বেশ দেরি হলো। ইতোমধ্যেই সম্মেলনের আদ্যোপান্ত বর্ণনা করে অনেক বন্ধুই পোস্ট দিয়েছেন তাই আমি বলবো ভিন্ন কথা - আমার অর্জিত অভিজ্ঞতা আর অভিব্যাক্তির কথা।


পূর্বে থেকেই স্টেশনে অপেক্ষা করা কবিবন্ধু সৌমেন বন্দোপাধ্যায় এবং বিভূতিদা’ আমাকে বুকে জড়িয়ে বরণ করেই নিয়ে গেলেন জল-খাবারের জন্য রেস্তোরায়। সেখানেই বন্ধু বিভূতি দাস যথেচ্ছ কল এবং ডেটা খরচের সুবিধা সম্বলিত একটি ‘সিম’ ঢুকিয়ে দেন আমার মোবাইল সেটে। যথারীতি আমার কোলকাতা পদার্পনের ছবিসহ যোগাযোগের নম্বরটি দিয়ে কবি সৌমেন বন্দোপাধ্যায় ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে দেন। আর যাই কোথায় - গভীর রাত অব্দি আমার আগমনকে স্বাগত জানিয়ে ক্রমাগত কবিদের কাছ থেকে একের পর এক ফোন আসতে থাকে। একে একে ফোনে কথা হলো অনেক কবির সাথে - অজিতেশ নাগ, গায়ত্রী শংকর মিমি, চিত্তরঞ্জন সরকার, অজিত কুমার কর দম্পতি, তমাল ব্যানার্জী দম্পতি, গৌরাঙ্গ পাত্র, অসিত কুমার রায় (রক্তিম), প্রবীর দে, পরিতোষ ভৌমিক, যাদব চৌধুরী, অচিন্ত্য সরকার প্রমুখ। ইতোমধ্যে কবি সমীর প্রামাণিক এবং অনন্ত গোস্বামীও সশরীরে এসে হাজির, যোগ দিয়েছেন আমাদের সাথে। গল্প-আড্ডা শেষে পরদিন দেখা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অনেক রাতে একে একে বিদায় নিলেন।


পরদিন একে একে বাংলাদেশ থেকে অপর বন্ধুরা এসে তাঁদের জন্যে পূর্বাহ্নে বুক করে রাখা হোটেলে উঠেন। কবি আফরিনা নাজনীন মিলির আব্দার; ‘মেয়েদের নিয়ে কোলকাতায় প্রথম এলাম, আমাদের হোটেলে বসিয়ে রাখবেন’। অগত্যা কবি বিভূতি দাসের সহায়তায় তাঁদের নিয়ে বাইরে যেতে হলো। জাদবপুরে তখন চলছিল বছরান্তের বিশেষ ছাড়ের বেচাকেনার ধুম। স্বভাবতই কবি মিলি একটা কাজের মত কাজ পেয়ে খুশি হয়ে গেলেন কিন্তু প্রকৃতি খুশি হতে পারেনি। বিপুল ক্রোধে ঝড়বৃষ্টি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমাদের উপর। ঝড়জলের রুদ্ররোষ থেকে বাঁচতে রেলস্টেশনে কোনরকম আশ্রয় নিয়ে সবাই আধভেজা হয়ে সারা। এই ঝড়-জলের ভিতর মাটির ভাঁড়ে চা খেয়ে কবি মিলি তো ভীষণভাবে আপ্লুত! বায়না ধরলেন মাটির ভাঁড় কিনে দেশে নিয়ে যাবেন। অগত্যা তাকে কিছু ভাঁড়ও কিনে দেয়া হলো। বৃষ্টি একটু ধরে এলে হোটেলে ফিরার উদ্যোগ করলাম, কবি বিভূতি দাসকেও যেতে হবে অনেক দূর। বেচারা বিভূতিদা’ আমাদের টেক্সিস্ট্যান্ডে নিরাপদে রেখে একমাত্র ছাতাটি আমাদের ধরিয়ে দিয়ে বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে বাস-অটো-টেক্সির জন্যে সমানে দাপাদাপি করছিলেন। বৃষ্টিতে ভিজে আধ ঘন্টারও বেশি কসরতের পর একটা Ola Taxi ডেকে তাতে আমাদের উঠিয়ে দিয়ে বহুদূরে নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন।


পরদিন অনুষ্ঠান অথচ ঝড়জলের দাপটে শারীরিকভাবে আমি আক্রান্ত হয়ে পড়েছি। বিভূতিদা’ আমার অবস্থা বুঝতে পেরে যেতে যেতে ফোন করে বারবার আমার খবর নিচ্ছিলেন আর অষূধ বাতলিয়ে দিচ্ছিলেন যেন কোন ফার্মাসি থেকে কিনে নিয়ে হোটেলে ফিরি। প্রাণের বন্ধুর এই পরামর্শ পালন করেছিলাম বলেই পরদিন কষ্ট হলেও অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পেরেছি নয়তো কাঁথামুড়ি দিয়ে হোটেলেই পড়ে থাকতে হতো। বিদেশ বিভূঁইয়ে এমন আপনজন না থাকলে যে কত বিপদ হতে পারে পরবর্তী কদিন আমার চিকিৎসা নিয়ে দৌড়ঝাঁপে তা আরো বেশি করে উপলব্ধি করেছি। বিভূতিদা’ ও সমীর প্রামাণিক - কেউবা নিজেদের কাজকর্ম ফেলে কেউবা অফিস থেকে ছুটি নিয়ে সারাক্ষণ আমাকে শিশুর মত আগলে রেখেছেন। সেইসাথে সৌমেন বন্দোপাধ্যায় অনন্ত গোস্বামীসহ অপর বন্ধুরা তো ঘন্টায় ঘন্টায় খোঁজ-খবর রাখছিলেনই।


যারা দূর-দূরান্তে আছেন বা কর্মব্যস্ত তারা দুবেলা ফোন করে খবর রাখছিলেন এবং আসতে না পারার জন্য বারবার নিজেদের সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করে আফসোস করছিলেন। ৪শ ৫শ কি.মি. দূরে অবস্থান করা কবি মোহাঃ সানারুল মমিন, যাদব চৌধুরী, গৌরাঙ্গ সুন্দর পাত্র এবং বারাসাতে অবস্থান করা (অসুস্থতাজনিত কারণে আসতে না পারা) কবি চিত্তরঞ্জন সরকার বারবার ফোন করে তাঁদের আন্তরিক উপস্থিতির জানান দিচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত মোটামুটি কাছে (বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি বারাসাতে) কবি চিত্তরঞ্জন সরকারের বাড়ি গিয়ে তাঁর সাথে দেখা না করে যাবার উপায় ছিল না। আর সেই দেখা করার অভিজ্ঞতায় যে কী হৃদয়ছেঁড়া আত্মীয়তার ছোঁয়া; গোটা পরিবারে আবেগ আনন্দের রেশ তা একমাত্র অনুভবের বিষয়, অল্প কথার বর্ণনায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বা ধন্যবাদ দিয়ে প্রাণের বন্ধুদের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার দাম পরিশোধ করবো না, শুধু বলবো বন্ধুদের অকৃত্রিম দানে আমার হৃদয় পূর্ণ। তোমরা কবি; আমার ভাই, আত্মার আত্মীয়।


বিভূতিদা’র ভালোবাসার পীড়ন-পেষণের কথা তো বলেছিই এবার কবিপত্নী (বৌদিমণির আদর আপ্যায়নের কথা না বললে আমার বলা অপূর্ণ থেকে যাবে। একদিন দুপুর পর্যন্ত খালিপেটে থেকে ডাক্তারী পরীক্ষা করিয়ে ক্লান্ত আমাকে বিভূতিদা’ টেনে নিয়ে গেলেন দূরান্তে তাঁর সোনারপুরের বাড়িতে। বিকেলে বৌদি অফিস থেকে ফিরে এসে আমাকে দেখে বিভূতিদা’র প্রতি অনুযোগ; তাঁকে আগেই জানানো হয়নি কেন? সুতরাং আরেকদিন আসার কড়ার করতেই হলো। সেদিন বৌদি অফিস থেকে ছুটি নিয়েছেন আমার প্রিয় ’এঁচড়-চিংড়ির চচ্চড়ি’সহ পছন্দের সব খাবার তৈরি করে খাওয়াবেন বলে। চিত্তদা’ আর বিভিূতিদা’র বাড়ি থেকে বিদায়কালে নাছোড়বান্দা ভাই-বৌদিরা ঐতিহ্যের স্মারক - নানান উপঢৌকন গছিয়ে তবেই বিদায় দিলেন।


প্রসঙ্গত একটা কথা না বললেই নয়, বন্ধুদের এই আন্তরিকতা যে শুধুই ঠোঁটের নয়, কতটা হৃদয় নিঃসৃত তার প্রমাণ - প্যাথলজিতে যাবার আগে মুদ্রা বিনিময়ের সুযোগ পাইনি বলে আমার কাছে পর্যাপ্ত রুপী ছিল না অথচ প্যাথলজির বিল এসেছে প্রায় বিশ হাজার রুপী। ততক্ষণে আমার হোটেল বিলও জমে আছে প্রায় ছয় হাজার রুপী! রাত থেকে শূন্য উদরে আমি, বিভূতিদা’ প্যাথলজিতে পৌঁছার আগেই চার ঘন্টার জন্যে প্যাথলজি পরীক্ষার প্রস্তুতিপর্বে আর পরীক্ষার মেশিনে বন্দি। বিভূতিদা’ এসে আমার জন্য অপেক্ষা না করেই নিজের কার্ড পাঞ্চ করে বিল মিটিয়ে দিলেন! প্যাথলজি পরীক্ষা শেষে বের হয়ে এসে তাঁর কাণ্ড দেখে আমি বিস্ময়ে ‘থ’ - তিনি জানেনও না যে, এই পরিমাণ টাকা আমার কাছে আছে কি নেই! আত্মীক টান না থাকলে শ্রেফ কবি পরিচয়ের এক অদেখা অজানা বিদেশীকে কী করে এতটা বিশ্বাস করা যায়? টাকার ঋণ হয়তো শোধ করেছি কিন্তু এই আত্মীক দায়িত্ববোধের ঋণ আমি শোধ করি কী করে? তাঁর কাছে আমি কৃতজ্ঞ ও ঋণী। কোন ধন্যবাদ নয় - শুধু বলি; পরম প্রভু তাঁর এই আত্মীক মর্মবোধের জন্য যেন তাঁকে উত্তম পুরস্কার দান করেন।


এই অবসরে অনুষ্ঠানের কথাও একটু বলে নিই, নয়তো অন্যায় হবে! পরে নাহয় ভাতৃসঙ্গ উপভোগের কথা আরো বলা যাবে! ৭ এপ্রিল ঠিক সকাল ১১টায় বেশিরভাগ অভ্যাগত কবি ও অতিথিবৃন্দের উপস্থিতি ও কলকাকলীতে শহীদ সূর্যসেন হল যখন আলো ঝলোমল হয়ে উঠেছিল; শঙ্খধ্বনি সহযোগে মঙ্গলদীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে শুরু হয় ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী কবি সম্মেলন-২০১৯’। কবি সৌমেন বন্দোপাধ্যায় আর তাঁর সহযোগী বন্ধুদের সুচারু আয়োজনে যে এমন একটা অনুষ্ঠান এত সুন্দরভাবে সুসম্পন্ন হতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাসই হতো না। সবকিছু নিখুঁত, পরিপাট্য আর সময়মাপা। যথেষ্ট পরিশীলন আর আন্তরিক নিষ্ঠা ছাড়া যে এ কখনোই সম্ভব নয়! এমন এক ঐতিহাসিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করার দায়িত্ব দিয়ে আমাকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করার জন্য আয়োজক বন্ধুদের ধন্যবাদ ও হৃদয়ের ভালোবাসা জানাই। এই অভিজ্ঞতা আমার জীবনের দুর্লভ স্মৃতি হয়ে থাকবে।


আসরের বরেণ্য কবি বিভূতি দাস আর তাঁর সুযোগ্য সাথী অনন্ত গোস্বামীর সাবলীল সঞ্চালনায় ছিল মনোমুগ্ধকর আবেশ। শুরুতেই সমবেত কণ্ঠে গাওয়া কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের “ধনধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা” আবহ সঙ্গীতটি এক আবেগভরা পরিবেশের সৃষ্টি করে। তারপরই বাংলা-কবিতার মাননীয় এডমিনের কণ্ঠে ধারণকৃত অডিও বাণীটি পরিবেশিত হয়। যথানিয়মেই সভাপতির বক্তব্যের মাধমে সম্মেলনের কার্যক্রম শুরু করতে হয় আমাকে। সর্বদা মাইক আর বক্তব্য এড়িয়ে চলা অপটু এই আমি অবশেষে ‘আমার সোনার বাংলা গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হয়ে উঠা’ শির্ষক পূর্ব নির্ধারিত বক্তব্য দিয়ে সম্মেলনের কার্যক্রম শুরু করি। এরই ধারাবাহিকতায় আমাদের শিল্পীকবি পলক রহমানের নেতৃত্বে সমবেত কন্ঠে সবাই দাঁড়িয়ে যথাযথ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতে অংশগ্রহণ করেন। এবং সবশেষে সুন্দর ভাবগম্ভীর পরিবেশে ভারতীয় জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন এবং সভাপতির ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মা্ধ্যমে কাঁটায় কাঁটায় ঠিক পাঁচটায় অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি ঘটে।


অবাক করা ব্যাপার যে, একশ’রও বেশি কবি অতিথির এই সমাগমে সকল কবিকেই মঞ্চে ডেকে নিয়ে পরিচয় করিয়ে ফুল, বাংলা-কবিতার ব্যাজ, কবিনাম খচিত মোমেন্টো আর উত্তরীয় দিয়ে বরণ করা হয়। প্রায় সবাই যে যার মত কবিতা, গান, শ্রুতি-নাটক ইত্যাদি পরিবেশন করেন। পূর্বাহ্নে মঞ্চে কবিদের মাঝে আসরের মৈত্রেয়ী কবি খ্যাত রীনা বিশ্বাস-হাসি বিশিষ্ট কবিদেরকে তাঁর স্বহস্তে বানানো নান্দনিক সব নজরকাড়া ফুলের সাজি উপহার দেন। অভ্যাগত অতিথিদের আপ্যায়নের জন্যে সকালের জল-খাবার থেকে শুরু করে দুপুরের লাঞ্চবক্স আর এয়ারপটে গরম চা সাথে বিস্কুট জল - কোনকিছুরই খামতি ছিল না। এক কথায় সমস্ত আয়োজনটি ছিল অসাধারণ পরিপাটী ও উপভোগ্য।


এতদিন যেসব কবিবন্ধুদের কেবল পাতার মাধ্যমেই চিনতাম স্বচোক্ষে দেখিনি, এই সম্মেলনের কল্যাণে তাঁদের সাথে চাক্ষুষ দেখা হলো। ভাব বিনিময়সহ হৃদয়ের ছোঁয়া নিতে পেরে ধন্য হয়েছি। কেউবা পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ চাইছেন তো কেউবা স্মৃতি ধরে রাখতে একসঙ্গে ফটো তোলার অনুরোধ করছেন আর কেউবা আমার দেয়া বইটিতে অটোগ্রাফ নিয়ে রাখছেন। এত অল্পসময়ে শত কবির সবার সাথে ব্যক্তিগত আলাপ পরিচয় হয়তো হয়ে উঠেনি। তবে মঞ্চে হোক গ্যালারিতে হোক সবাই সবাইকে একনজর দেখেছি ঠিকই। ভার্চুয়াল বন্ধুদের এই যে চর্মচোখে ছুঁয়ে দেখা - এটাই বা কম কিসে?


বিশেষ করে কবিবন্ধু মিমি, পারমিতা, তমাল'দা, অজিত কর'দা শারীরিক সমস্যাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে ছুটে এসেছেন কেবল আমাদের একনজর দেখবেন, একটু কথা বলবেন বলেই। ওদিকে স্বাস্থ্যগত সমস্যা ও দূরত্বকে অতিক্রম করে না আসতে পারা কবি গৌরাঙ্গ সুন্দর পাত্র এবং কবি চিত্তরঞ্জন সরকারের তো আক্ষেপের সীমা নেই। চিত্তদা'র সেই আক্ষেপের খানিকটা আমি নিজে গিয়ে দেখা করে পূরণ করে এসেছি বটে কিন্তু সুদূর উড়িষ্যায় অবস্থান করা গৌরাঙ্গদা'র আক্ষেপ পরবর্তী কোন একসময় পূরণ না হওয়া পর্যন্ত থেকেই গেল। এতকাল জানা আমার প্রিয় কবি সংহিতা যে এত তরুণ একজন গুণী স্থপতি এবং শিল্পী আর নাম তাঁর মৌমিতা জানা তা সত্যি আমার জানা ছিল না। তিনি চটপটে তরুণ অথচ লাজুক স্বামীকে সাথে নিয়ে এসেছেন। আমার আশীর্বাদ চাইলেন।


শ্রবণ সমস্যাকে অতিক্রম করা আরেক বিশেষ গুণী - একাধারে কারুকার, শিল্পী ও কবি রীনা বিশ্বাস-হাসিও তাঁর জীবনের বুলবুলকে সাথে করে আরেক বুলবুলের আশীর্বাদ নিতে এসেছেন। কোলাহল এড়িয়ে নিভৃতে একটু গান শোনাবেন তাই সিঁড়ির কাছে ডেকে নিলেন। অমর কবি নজরুলের "বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল" গেয়ে তাঁর প্রিয় কবিকে শোনালেন এবং মনের মাধুরী মিশিয়ে অনেক যত্নে গড়া কারুময় এক সাজি কাগজের ফুল উপহার দিলেন। স্বামীর সাথে আলাপ করিয়ে দিতে পেরে বিশেষ তৃপ্ত হলেন। দেখলাম তাঁর স্বামীও যুগপৎ আমার এবং তদীয় স্ত্রীর গুণমুগ্ধ!


ভারতীয় বন্ধুদের জন্য আমি ৬০ কপি আলোর মিছিল সাহিত্যপত্র ও ৬০ কপি নিজের প্রকাশিত বই নিয়ে গিয়েছিলাম। সেসব বিলি করার পাশাপাশি বহু কবির স্ব-স্ব প্রকাশিত বই ও সংকলন উপহার পেয়েছি। সেইসব বন্ধুদেরকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। আমাদের সব প্রকাশনার ঈর্ষণীয় মান এবং অর্ক প্রকাশনী আর আলোর মিছিল সাহিত্যপত্রের বিশেষ চমক - এর সবই ভারতীয় কবিবন্ধুদের কাছে বিশেষ আগ্রহের বিষয় ছিল। অনেকেই অর্ক প্রকাশনী থেকে তাঁদের বই প্রকাশের সম্ভাব্য সুবিধা অসুবিধা নিয়ে আলোচনা করেন। ভারতীয় বন্ধুরা প্রকাশনায় আগ্রহী হলে সম্ভাব্য অসুবিধাসমূহ দূরীকরণে সম্ভাব্য এবং যথাসাধ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবো বলে তাঁদের কথাও দিয়েছি। বন্ধুদের আবারো আশ্বস্ত করছি; এব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে আমার এবং অর্ক প্রকাশনীর সহযোগিতার হাত সতত প্রসারিতই থাকবে।  


১২ এপ্রিল, আমার কোলকাতা ত্যাগের পূর্বদিবস; ‘এক সপ্তাহ ধরে হৈচৈ করা বন্ধুদের আগামীকাল ছেড়ে যেতে হবে’ - ভাবতেই যেমন আমার হৃদয়টা কেমন মোচড় দিয়ে উঠছিলো বন্ধুদেরও হয়তো তেমনটিই হচ্ছিলো। তাই দূর-দূরান্ত থেকে সারাদিনের কর্মব্যস্ততার ক্লান্তি ভুলে একে একে এসে জড়ো হলেন: দিলখোলা কবি বিভূতি দাস, অমৃতভাষী কবি সৌমেন বন্দোপাধ্যায়, নিষ্ঠাবান ও অম্বরীষ কবি সমীর প্রামাণিক, সজ্জন কবি অনন্ত গোস্বামী মাস্টারমশাই কবি প্রবীর দে প্রমুখ। হোটেল কক্ষের আনন্দঘন দীর্ঘ আড্ডায় চক্রাকারে চলছিলো কবিতার আবৃত্তি আর গান। দেখতে দেখতে রাত বেড়ে যাচ্ছিলো সবাইকেই দুর-দূরান্তে যেতে হবে। সমীর প্রামাণিক জোর করে ধরে সবাইকে গাড়িতে ভরে নিয়ে গেলেন অভিজাত রেস্তোরা ’আর্সলানে’। আনন্দঘন পরিবেশে চিকেন কাবাব ও মোঘলাই বিরিয়ানিতে আপ্যায়িত করে আমাকে হোটেলে পৌঁছিয়ে দিয়ে কাল আর দেখা হচ্ছে না ভেবে সবাই অশ্রুসজল চোখে বিদায় নিলেন।


পরদিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় আমার রিপোর্টিং, চারটায় গাড়ি মজুত, কম করে সাড়ে চারটায় আমাকে রওয়ানা দিতে হবে। সময়মত উঠতে পার কি না সেই সন্দেহে ভাতৃপ্রতীম বিভূতিদা’ উদ্বিগ্ন ছিলেন তাই যথাসময়ে কল দিয়ে জাগিয়ে দিলেন। যতক্ষণ না পশ্চিমবঙ্গের মাটি ছেড়েছি, চিত্তদা’সহ বিভূতিদা’ সমীর প্রামাণিক, সৌমেন বন্দোপাধ্যায়, অনন্ত গোস্বামী, প্রবীর দে, অজিত কুমার কর প্রমুখ বন্ধুরা বার বার ফোন করে খোঁজ-খবর নিচ্ছিলেন যেন; তাঁদের বাড়ির আদরের খোকাটি প্রথমবারের মত একা একা ঘর থেকে বেরিয়েছে! এর বেশি আত্মীয়তা আর কাকে বলে আমি জানি না। তাঁদের আন্তরিকতার কাছে আমার মাথা নত হয়ে আসে। আর এর সবই পেয়েছি - চল্লিশ বছর দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানো এই ‘আমি’ আজ এখানে কবি পরিচয়ে এসেছিলাম বলেই। তাই বলি; আমার কবি পরিচয় আজ ধন্য ও পূর্ণ। কবিসত্ত্বা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন।


ওদিকে জাদবপুরে অনুষ্ঠানের শেষাংশে কবি অজিতেশদা’র সুযোগ্যা পত্নী (বৌদি সুমিতা নাগ) গাড়ি নিয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করছিলেন কখন অনুষ্ঠান শেষ হবে। বৌদি তো আলটিমেটামই দিয়ে বসলেন; তাঁদের সাথে এখনই না গেলে আমাদের সম্পর্কই নাকি নষ্ট হয়ে যাবে! ওরেব্বাস্! অগত্যা আমার ঝিমানো শরীরকেও ঝাড়া দিয়ে চাঙা করে কবি পলক রহমানকে সাথে করে গাড়িতে উঠে বসতে হলো। রাত এগারটা পর্যন্ত কোলকাতা মহানগরীর অলিগলি চষে-ফিরে সেন্ট্রাল রোডে রাঁধুনী রেস্তোরায় নিয়ে আমাদের পছন্দের খাবার খাইয়ে, উপহার উপঢৌকনসহ হোটেলে পৌঁছিয়ে দিয়ে তবে বিদায় নিলেন। পরমাত্মীয়দের এই যে হৃদয়ছেঁড়া আদর ভালোবাসা তা একমাত্র দূরদেশে অবস্থান করা বহুদিন না-দেখা ভাই-বোনদের আবেগের সাথেই তুলনা চলে মাত্র!


গত চল্লিশ বছরে ভারতের নানান জায়গাসহ কোলকাতায় তো কত বারই গিয়েছি কিন্তু আধুনিকতার কৃত্রিমতায় মোড়ানো এই যান্ত্রিক যুগেও যে অমন ভালোবাসা আজো টিকে আছে তা কোলকাতার ওই কবি সম্মেলনে না গেলে কোনদিনই বুঝতে পারতাম না। কবিতাকে ভালোবাসি বলেই আজ আমার মত অকবিও ’কবি’র পরিচয় পেয়েছি। আর ’কবি’ পরিচয়ের সুবাদেই আজ এইভাবে শত কবির ভালোবাসা লুটে নিয়ে ধন্য হয়েছি। সর্বোপরি বাংলা-কবিতার আসরে ছিলাম বলেই হৃদয়ের প্রতিবেশী অমন আত্মীয়দের দেখা পেয়েছি, ভালোবাসা পেয়েছি যা - এজীবনে ভুলবার নয়।


সুতরাং; জয়তুঃ কবিতা! জয়তুঃ কবিজীবন!! জয়তুঃ বাংলা-কবিতার আসর!!!