মৃত ব্যাক্তিও কথা বলে।
কথা বলে তাঁর ছেড়ে যাওয়া পরিচ্ছদ, আংটি, চোখের চশমা
কখনও খসড়া খাতায় ছেঁড়া ছেঁড়া লেখা, কলমের আঁচর,
যত্নে অথবা অযত্নে লেখা ডায়েরী, নোট বই, খাতা
আর সব কিছুই কথা বলে। যদিও আমরা ভুলে যাই মৃত
ব্যক্তিটিকে। শুধু বছরান্তে কবরে গিয়ে এক তোড়া ফুল,
মিছকীনদের কিছু খাবারের প্যাকেট। তাওবা কত শতাংশ
লোকের ভাগ্যে জোটে? সেটাও একদিন কালের বিবর্তনে
হারিয়ে যায়। সব আবেগীয় সৃষ্টাচার হয় রোহিত।  


সেদিন এক মৃতু ব্যক্তির ছেড়ে যাওয়া পড়ার ঘরে বসে
অনেক কথা ভাবছিলাম। সম্মুখে আশে পাশে যেদিকেই তাকাই
দেখি  শেলফের তাকে  থাকে থাকে কত ইংরেজি বাংলা
মোটা চিকন বই সাজানো।
কোনোটার মলাট ছিঁড়ে গেছে, কোনটা পুরাতন,
কোনটা নতুন, কোনটা বান্ডেলের থেকে মুক্তিই পায়নি এখনও।
কোনটা মোড়োকে সাজানো। আর হয়ত সময় হয়ে ওঠেনি
সে সব বই খুলে দেখার। তবুও বই যেন তাকিয়ে থাকে অপেক্ষায়!


আমি বইয়ের দিকে চোখ রাখতে রাখতে কথা বলছিলাম
মৃত ব্যাক্তিটির সাথে। কেমন কষ্ট হোচ্ছিল বুকের মধ্যে।
বইয়ের ধরণ দেখলে বুঝা যায়  ভদ্রলোক কোন ঘরণার
গবেষোণা পছন্দ করতেন। তিনি কেমন আবেগের ,
কেমন ভাবনার, কেমন ভয়ংকর, কেমন প্রেমিক,
কেমন চালাক, কেমন ধূর্ত, কেমন রাগি অথবা
কতটুকু স্নেহ পরায়ন আর কঠিন কিংবা নরম মনের মানুষ ছিল।
বইয়ের দিকে চোখ রেখে এমন অনেক কিছু মনে পড়ছিল ।  


ইতস্ততঃ একটা নোট বই হাতে তুলে নিই। তাতে কিছু অক্ষর,
কিছু শব্দ, কিছু লাইন লিখা ছিল বিভিন্ন পাতায়। অর্থ খুঁজিঃ


-স। এমন স দিয়ে কি সত্যের খোঁজে সাহসী হতে চেয়েছিল?
নিশ্চই তাতে হয়ত স্বার্থপরতা  ছিল না বিন্দু মাত্র। তেমন  
হলে কি এত কবিতা গল্পের বই শোভা পায় কোন পড়ার ঘরে?  
ভাবি তাহলে কি কোন সলতে জীবন নিয়ে ছিল সকাল বিকাল
ভয়ংকর হতাসা!


-ভ। ভ মানেই তো এমন নয় যে ভালোবাসাই শুধু হবে। কি
ভয়ে কাটত জীবন? ভয়ংকর সে যন্ত্রণা! হয়ত কখনও কাউকে
ভালোবেসে বলতেই পারেনি পরকীয়ার সামাজিক অনুশাসনে।
হায়রে সমাজ, বিবাহিতদের যেন আর কাউকে ভালোবাসার
কোন ধিকারই নেই! সে যেন সংসারের গন্ডিতে বাঁধা
কোন এক ছাপোষা কলুর জীব!


-একদিন মাকে... কি লিখতে চেয়েছিল মাকে নিয়ে? মাকে কে না
ভালোবাসে। তার পরও মায়ের সাথে মান অভিমান করে মাকে
কষ্ট দেয়নি কোন দিনও এমন ইনসান পাওয়া একেবারেই কঠিন!
আমারও মনে পড়ে মাকে নিয়ে মনমালিন্যের কথা। এখন কত
কাঁদি, কত কষ্ট পাই আর নিজের প্রতি নিজেকে ঘৃণা করি। তাতে  
কি আর মা ফিরে আসবে? তাই মষ্ট আর লাঘব হওয়ার নয়,
আফসোস্‌! বেঁচে থাকতে মাকে কেন আরও ভালোবাসতে পারিনি?


-দেশ, বাংলাদেশ। জানা হয়নি ভদ্রলোক মুক্তি যোদ্ধা ছিল কিনা।
আর মুক্তি যোদ্ধা না হলেই বা কি? দেশকে ভালোবাসার
অধিকার যেন মুক্তি যোদ্ধাদের, আর কারও নয়। দেশ, মুক্তি যুদ্ধ,
স্বাধীনতা, পতাকা যেন আর এস দাগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আর কেউ জানবে না। তাহলে নতুন প্রজন্মের দেশ প্রেম কোথা
থেকে জন্ম নেবে, কোথা থেকে শিখবে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার
জন্য রক্ত দান!


-আমি তাই সেই মৃ ব্যক্তির জন্য নীরবে কিছুক্ষন বসে ভাবি, ভাবি
তাঁর বিদেহী আত্মার কথা, ভাবি তাঁর ফেলে যাওয়া কর্ম, স্বপ্ন, চাওয়া,
পাওয়া নাপাওয়া আর সুখ দুঃখের কথা। আর এমন ভাবনা হয়
এ জন্যই যে আমিও একদিন গত হব। আমার জন্য “ইন্নালিল্লাহিওয়া
ইন্নাইলাইহি রাজেউন” পড়ার মতও কেউ থাকবে কিনা। জানি না
আমার মৃত্যুতে ক’জন ফেলবে চোখের জল। অথবা আমার ব্যাবহৃত
পরিচ্ছদ, চশমা, বই, খতা, ডায়েরী নিয়ে ভাববে। ভাবলেও তারা কতজন  
যারা আমার দোষ গুলোকে বড় করে না দেখে আমার গুনের জন্য
স্রস্টার কাছে বলবেঃ বড্ড ভালো লোক ছিল।    


০৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০।