দেবু'দা-
তুমি আমার কিশোর বেলার
গল্পের সাথী। তখন কী গল্প হত তা
বেশ মনে পড়ছে। না- একেবারেই না-
গোপাল ভাঁড়ের গল্প নয়। বরং গোপালের
বোনের কথা, তাকে ভালো লাগার গল্প,
তার সাথে প্রেম করার গল্প, প্রেমে পড়ার গল্প। তুমি প্রচন্ড ভালোবাসতে সন্ধ্যাকে।


ইন্টার মিডিয়েট প্রথম বর্ষ। প্রেম করা আর
প্রেমে পড়ার যেন উত্তেজিত বয়স। বিকেলে
দিনাজপুর রাজবাড়ির ইট ভাঙা রঙ যেন
রঙধনুর রঙ হয়ে মনের আকাশে দোল খেত।
সেখানে সন্ধ্যা যখন সন্ধ্যা বেলায় মিলিয়ে যেত
তোমার চোখে দেখতাম হেমন্তের শিশির।
কি করে এত ভালোবাসা যায় কাউকে।


দেবু'দা-
তোমার এ ভালোবাসা ছিল এক তরফা।
কতদিন বলেছি- মনের বাতায়ন খুলে
এক পশলা রোদ্দুর গায়ে মেখে তুমি
আরও উষ্ম হও, প্রেমের পৃষ্ঠায় লিখা 'আমি
তোমাকে ভালোবাসি' বল সে কথা নির্দ্বিধায়।
অথচ তামাম গ্রীষ্মের তাপদাহ তোমার
গলকন্ঠে এসে জমত। তুমি শুকনো কন্ঠ
নিয়ে ফিরে আসতে। প্রেম তাই চিরকালই
ছিল একতরফা। কি ভয়ংকর। তোমার
চোখের দিকে তাকাতেও কষ্ট হত।


তাহলে কি হবে এ প্রেমের পরিনতি,
কি ভাবে বাঁচাব তোমার শিক্ষা জীবন,
তোমার ভবিষ্যৎ?


সন্ধ্যা দেখতে যেন ডানাকাটা পরীর মত ছিল।
মাইরি বলছি দেবু 'দা। তুমি কেন? যে কেউ
তার প্রেমে পড়বেই পড়বে। আমারও ইচ্ছে
হয়েছিল। কিন্তু সব সর্বনাশটা তুমি আগেই
করে ফেলেছ। নিজে তো নিজেই প্রেমের বলি
হচ্ছ আবার আমাদেরকেও করেছ বঞ্চিত।
কতবার বলেছি তোমার হয়ে সন্ধ্যাকে নাহয়
আমিই তোমার প্রেমের কথা বলি।


কি যেন একটা ভয় কাজ করত। সেটা আমার
ভুল ধারণা। আসলে দেবু'দা তুমি ছিলে স্বার্থপর।
ভাবতে কথা বলতে গিয়ে যদি সে আমার প্রেমে পড়ে যায়?


সেকি হয়? আবার হয়ও শুনেছি। আকাশ
হোকনা একটা, চাঁদ হোকনা একটা। কিন্তু
চন্দ্রমুখীর চাঁদের মতই যে অনেক ভক্ত।
কার আকাশে সে অস্ত যাবে কে জানে। সে
তো ভালোবাসে চাঁড়াল থেকে চন্ডী। তাই
এ নিয়ে তোমার বিরাগ ভাজন হতে চাইনি
আর কোনদিন।


তুমি ক্লাসরুমে ঘুমিয়ে পড়েছ কতদিন।
পাশে থেকে চিমটি দিয়ে তোমাকে জাগিয়ে
রাখতাম। সারারাত কি ছবি আঁকতে সেই
প্রেয়সীকে নিয়ে, কি কবিতা লিখতে তার
চুলের ডগায় যে বাতাস খেলত, পায়ে পায়ে
হেঁটে যাওয়ার ছন্দে যে পায়েল ঘায়েল হত,
উন্নত বক্ষে যে ওড়না হাওয়ায় ভাসত,
চোখের কাজলে যে মেঘ থমকে দাঁড়াত
তাকে নিয়ে।


দেবু'দা
এখন তুমি কোথায় আছো? বড় হতে হতে
আমরা কেমন করে যেন চারিদিকে ছড়িয়ে
ছিটিয়ে পড়লাম। শুনেছি সন্ধ্যা বিয়ে করে
চলে গেছে ওপারে। যাওয়ার আগের দিন তোমাকে বলে গেছিল- তুমি ভিতু, স্বার্থপর,
তোমার ভেতরে প্রেম আছে কিন্তু তার প্রকাশ
এতটুকু নান্দনিক নয়, এ যেন মোমের ভেতরে
আটকে থাকা সুতোর আলো। কি হবে সে
প্রেম যে প্রেম আলো ছড়াতে জানে না,
কথা বলতে জানে না, যে প্রেম ছুঁয়ে দেখতে জানে না!


এর পর তোমার সাথে অনেক যুগ পরে একবার
দেখা হয়েছিল পারবতীপুর রেল জংশনের
প্লাটফর্মে। খোঁচা খোঁচা দাড়ি, জটা চুল, পরনে
চেঁড়া ময়লা টিশার্ট, ট্রাউজার, পায়ে সুতলী দিয়ে জীর্ণসংস্কার করা খুবলে খাওয়া চামড়ার স্যান্ডেল 'সু। বিধ্বস্থ লাগছিল। সিগারেট ধরেছ যে অনেক বছর তা তোমার গোঁফের হলুদ রঙ দেখেই বুঝেছিলাম। আমায় চিনতে পেরে তুমি এড়িয়ে গেছ মানুষের ভিড়ে।


দেবু'দা-
কি হল এমন অপেক্ষা করে? অপেক্ষা গুলো তো দীর্ঘই হয়। ধৈর্যহারা হতে হতে নিজের ভেতরে জন্ম নেয় মনুষ্যত্বহীন প্রতিজ্ঞা, চোখের তারায় নামে তপ্ত সূর্যের ছটা, ভাবনারা হয় একমূখী ভোতা, হাসি মিলিয়ে যায় কষ্টকে আলিংগন
করে, আর রাত হয় নির্ঘুম কুকুরী নিঃশ্বাসের।


তবুও দুর্বল প্রতিক্ষা!
এখনও ভাবি তুমি সব কিছু ভুলে, দাড়ি গোঁফ কামিয়ে, চুলে কদম ছাঁট দিয়ে, পরনে অক্সফোর্ড সু'য়ের চমকানির সাথে ট্রাউজারে শার্ট টাগ-ইন
করে দাঁড়াচ্ছ কবিদের সভার মঞ্চে। পান্ডুলিপি নিয়ে মগ্ন তোমার শেষ কবিতা আবৃত্তি নিয়ে। যেখানে বনলতা সেনের মত নয় বরং সন্ধ্যা'র মত রমনী এসে আজীবন শান্তিতে ভাসাবে বলে তোমার কাব্যিক মন।