এই শোননা-

সেটা ছিল বোশেখ মাসের শুরু। যেদিন তোর পাশে
এসে দাঁড়ালাম, আমার ভেতরে আমি অনুভব করলাম
আর এক আমিকে। নিজেকে চিনতে বড্ড কষ্ট হচ্ছিল
আমার। হল ঘরে অনেক মানুষ। তবু মনে হচ্ছিল
শুধু তুই আর আমি, কোন ছায়া ঘেরা পার্কের
বেঞ্চিতে বসে আছি তোর হাত ধরে, চারিদিকে ফুলের
বাগান, গাছে গাছে ছিল কিছু অচেনা পাখির ডাক,
সামনে লেকের স্বচ্ছ জলে ভেসে ছিল তোর আর আমার
বাকরুদ্ধ মুখ। সেটা অবশ্য ক্ষনিকের জন্য। এর পর
প্রতিদিন তোকে এক নজর দেখার জন্য কেমন একটা
অপেক্ষা, তার পর কি হল জানিস!


এই শোননা-

আমার বুকের ভেতরে এক অজানা শিহরণ খেলে
যেতে লাগল। কোন অনুষ্ঠানে এমন তো মঞ্চে এসে
অনেকের পাশেই দাঁড়িয়েছি কত দিন কত সন্ধ্যায়।
কিন্তু তোর পাশে দাঁড়ানোটা কেন এমন? মনে হয়
কি যেন এক জ্যাতির্ময় আকর্ষণ তোর ভেতর থেকে
ধেয়ে আসে আমার দিকে। আমি আবেশিত হোই,
আমি আচ্ছন্ন হোই অন্য কোন জগতে। সে জগতে
তোকে নিয়ে ভেসে বেড়াতে ইচ্ছে করে। কেন এমন
হয় বলত! একেই কি বলে ভালবাসা! তোর সাড়ার
অপেক্ষায় প্রেম তো তখনও ফেলে যায়নি কোন শিক্ত
আগমনী ছায়া। তবুও তোকেই মনের সাথে বাঁধতে
ইচ্ছে হল বলে ভুলে গেলাম প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের
ঐশ্বর্য্য টান মুহুর্তে, যা বিচলিত করত আমায়  
একাকিত্বে- দিনের পর দিন, রাতের পর রাত।    


আর তুই বলতিস-


আমি বড্ড ব্যাস্ত মানুষ। কাউকে নিয়ে ভাব্ব সেটাই
হয় না। আর গান কবিতা নিয়ে ভাব্ব কখন।
এক সময় গানটান, কবিতাটবিতা নিয়ে খুব মেতে
থাকতাম বৈকি। তখন বুঝতাম কি করে বুকের মধ্যে
একটা শীতল নদীর জন্ম হয়, কি করে রাতের আকাশে
মত্ত চাঁদ শিয়রে এসে দাঁড়ায় প্রেয়সীর মুখ হয়ে, কি
করে রাতের শিউলী ঝরা ফুল প্রিয়ার বুকের গন্ধ
ছড়ায়। তার পর একটু ঘুম, একটা স্বপ্ন, একটা রাত,
একটা সকাল আবার একটা দিন। কিন্তু একটা মুখ
বার বার দেখা দিয়ে যায় অদৃশ্য চোখের সীমানায়।
সে টুকুই ভেতরে ভেতরে বেড়ে উঠে কবিতা আর গান
হয়ে। আজ সে টুকুই নিবেদন করি অনেক আগ্রহে যদি
ভাল লাগে কোন মুখ। বুঝেছেন, আমি কি বলছি?  


এই শোননা-

তুই কিন্তু আমাকে আপনি করে বলতিস। আমার
নাম ধরে ডাকলেও নামের শেষে বিশেষ কোন ব্যাক্তির
সম্পর্ক জুড়িয়ে দিতিস। আমার দিকে ভাল করে
তাকিয়েও দেখতিস না। আমার বড্ড অভিমান হত।
কত দিন আয়নার সামনে এসে দাঁড়িয়ে দেখেছি আমার
আমিকে, আমি সুন্দর কিনা দেখতে! ঠোঁটের নীচে
একটা কালো তিল হলে কি  ভাল হত, তুই কি তিল
পছন্দ করিস, এলো চুল না বীনুনি, চোখে কাজল না
মাশকারা, গলায় কোন ধরণের গহনা তোর পছন্দ?
শাড়ি না স্যালোয়ার কামিজ- কি পড়লে তোর দৃষ্টি
থাকবে আমার দিকে? এ সব ভেবে ভেবে অস্থির হত
রাত। আলো ভেজানো নিঃসংগ রাত! তার পর কি
হল জানিস!


এই শোননা-


আমি কখন যে তোর ভেতরে ঢুকে গেলাম, হৃদয়ে
খোঁড়া ভালবাসার মস্ত দিঘীর জলে ডুবে গেলাম।
কখনও ভাবিওনি আমি সাঁতার জানি কিনা, ডুবে
মরব কিনা! শুধু তোকে নিয়ে তখন একটাই ভাবনা-
তোকে জড়িয়ে আছি কতটুকু, তোকে ভরিয়ে দিয়েছি
কতটুকু, তোকে হারিয়ে দিয়েছি কতটুকু আমার প্রেমের
উন্মত্ত উঠোনে। তারপর কি যে হল, দেখি একদিন  
হঠাত আপনি থেকে তুই “তুই” হয়ে গেলি। তখন
বুকের দিঘীতে একটা মস্ত বড় পদ্মফুল ফুটেছিল, সে
ফুল আজও দিঘীতে বাতাস আর জল নিয়ে খেলা করে।
প্রজাপতিরা লজ্জ্বায় বিমুখ হয় তোর প্রেম, জড়াজড়ি
আর উড়াউড়ি দেখে। আর আমি, প্রতিদিন ঐ পদ্মের
সাথে নির্ভার হয়ে প্রেমের আনন্দ ধারায় চোখ মুদি
তোর পুরুষোচিত স্পর্শে।
  
আর তুই বলতিস-


তোকে নিয়ে এখন কবিতা লিখতে, গান গাইতে
খুব ভাল লাগে। আমার যে গান আর কবিতার
একটা জীবন ছিল,  ভাললাগা ছিল, তা প্রায়
হারিয়েই যাচ্ছিল। তুই কেমন করে আমার হারিয়ে
যাওয়া জীবনটাকে ভালবাসার নোংগর দিয়ে এমন
ভাবে এঁটে তুললি যেন আমি ফিরে পেলাম আর
এক জীবন যখন আমার শুক্লাদশী চাঁদ পশ্চিম
দীগন্তের দিকে ঝুলে ছিল। আর এখন নিজেকে
চাঁদের কাছে আর চাঁদ মুখের মাঝখানে বসিয়ে
দিয়ে জোস্না বৃষ্টির ছাঁট পেতে  প্রতি রাতে হয়ে
যাই রোমান্টিক যুবক পুরুষ। এখন আমি গান গাই,
কবিতা লিখি, আড্ডা দিই, যেন এ ভাবেই কেটেছিল
আমার বিগত শৈশব জীবন তোর সাথেই। মনে হয়
তোর কিশোরী আংগুলটাকে তালুতে পুরে আদিগন্ত
সুর্যের দিকে আজও দূরন্ত কিশোর আমি ছুটে
যাচ্ছি একটা নতুন সকাল ধরব বলে।


ভেতরে ভেতরে অনেক ঘনিষ্টতায় সেদিন
তুই লজ্জ্বাকে বুকের এক পাশে রেখে বললি-


তোর জন্য এখন অনেক কবিতা লিখছি। রোমান্টিক
কবিতা। কেমন হয়েছে তা ভাব্বার বিষয় না।
বিষয়টা হল “তুই”, তোর ভালবাসা, তোর প্রেম,
তোর কাছে আসা, তোর যত্ন, স্বপ্ন, আশা, কষ্ট, মান-
অভিমান আর বার্ধক্যে এসেও কৃষ্ণের ছেলে মানুষী!
সব কবিতা না পড়ি, শিরোনামগুলো শোনঃ দরোজা,
মনের উঠোন, জানিস? কি করে হয় মরুর শুন্যতা,
তুই চাইলে, ডাক নাম, প্রেম খঁজো না কেবল ওষ্ঠে
ইত্যাদি। “ভালবাসা অনন্ত কাল” কবিতায় তোকে
নিয়ে কি লেখেছি শুনবিঃ আমার শেষ ভালবাসা,
শেষ প্রেম, আমার শেষ অস্তিত্ব, আমার বুকের মধ্যে
শিহরণের শেষ চিহ্ন কেবল তুই। তাই তোকে ধারণ
করি, লালন করি, আরাধনা করি এই বুকের মধ্যে।
যেখানে লুকিয়ে রাখা যায় হাজার অভিমানের পাহাড়,
হাজার ভালবাসার সাগর, হাজার মরুভূমির যন্ত্রনা,
লাখো আকাশের কান্না আর অগনিত তারার দেশ।
এমন অনেক কিছু...  


এই শোননা-


তোকে নিয়ে আমারও কবিতা লিখতে বড্ড ইচ্ছে করে।
তোর মত করে পারি না। তুই অসাধারণ, কি নেই
তোর ভেতর! কত গান, কত কথা, কত সুর, কত
কবিতা। তাই কবিতা লেখতে গিয়ে মনে হয় তুই তো
সব লেখে ফেলেছিস, আমি আর কি লেখব? কি নেই
তোর উপর! কত রুপ, কত মায়া, কত চাহনী, কত
আকর্ষনীয় আবেদন। তোকে নিয়ে সব কিছু ভেবে দেখতে
হাজার বছর কেটে যাবে, তবুও যত্নের অভাব হবে। এ
জন্যই কি তোকে নিয়ে তোর যত্ন নেয়াটা কম হয়েছে!
আমিও যত্ন নিতে চাই- পারি না, আমিও তোর সাথে
থাকতে চাই- পারি না, আমিও তোর মাথার চুল
এলোমেলো করে দিয়ে হাত ধরে হাঁটতে চাই-
পারি না। তোকে নিয়ে কত সাধ জাগে, কখনও
মনে হয় তোকে নিয়ে হারিয়ে যাই আমাজনের কোন
জংগলে। বুকের মধ্যে সেই বন মাটি আঁকড়ে ধরে।
ভাবি সেখানে তোকে লুকিয়ে রাখি আজীবন। কিন্তু
সময় অপেক্ষা করে না। তার পর কি হয় জানিস!  

এই শোননা-


এ জন্যই বোধ হয় এত অনিচ্ছার পরও আমিও
কবিতা লেখছি আজকাল। সে সব কবিতায় তোকে নিয়ে
অনেক ভাবনায় বলেছিঃ তুই যখন আমার নাম ধরে
ডাকিস তখন মনে হয় এত দিন আমি যেন নামহীন
ছিলাম, এই প্রথম কেউ আমাকে নাম ধরে ডাকল,
কারও মুখে নাম ডাকাটাও শুনতে যে এত ভাল লাগে  
তা তুই আমার নাম ধরে না ডাকলে কোন দিন
বুঝতেই পারতাম না অথবা ...চোখের তারায় আগুন
জ্বলে, চমকে উঠি, পুজার ফুলেও দেখি পাপ...
সাদা কালো কৈশোর আর সন্তানদের মুখ দেখি,
আবারও বাঁচার সাধ হয়। মলিন ছবির সেই রঙীন
কিশোরকে বলি আয় না আর একবার স্বপ্ন দেখা যাক্!
পুরনো আকাশে জেগেছে নতুব চাঁদ হাতে যদি থাকে
তোর অনেক কাজ, সেরে আয়। বেশিদূর যাবো না,
পাঁচিলের ওপারেই তো আমাদের চিরচেনা সেই
সোনালী শহর!  


আর তুই বলতিস-


তুই এত ভাল কেনরে! তুই আমাকে প্রতিটি মুহুর্তে,
প্রতিটি চাওয়ায় যে ভাবে আদর করিস সত্যিই আমি
ছেলে মানুষ হয়ে যাই তোর কাছে। তুই নারী। আর
নারীরা নাকি কন্যা, জায়া, জননী। কিন্তু তোকে
নিয়ে তার চেয়েও বুকের অনেক গভীরে কি যেন এক
পরিচিত অপরিচিত ধাক্কা লাগে! কন্যা, জায়া, জননী-
এই তিনটি শব্দ তো কোন কবির লিখে দেয়া
শব্দচরণ মাত্র। কিন্তু তার পরও তোকে নিয়ে যে
আরও কত ভালোলাগা, ভালোবাসা, সম্পর্ক,  
অনুভূতি, মায়া, প্রেম, স্নেহ, আকর্ষণ, টান আর
মন পুড়া থাকে তা কেবল জানে সেইই পুরুষ যে
তোর মত কাউকে গভীর করে ভালবাসতে জানে।
জানি না তোকে নিয়ে আর কেউ এমন করে ভাবে
কিনা, ভালবাসে কিনা। তবে আমি প্রতিদিন,
প্রতিরাত, প্রতিটা ক্ষন অনুভব করি একটা
অন্যরকম জগতের প্রান আর টানের ভালবাসা।
সে ভালবাসা যেন কন্যা, জায়া, জননীরও উর্দ্ধে!  


এই শোননা-


এত কিছু জানি না, আর জানতেও চাই না।      
এখন ছোট্ট একটু চাওয়া, সে কেবল একটাই  
শুধু আমাকেই ভালবাসবি আর কাউকে না।  
এই শোননা---