বলাই বাহুল্য প্রায়ই কবিতা, গীতি কবিতা, সংগীত, তাল, বেতাল, সুর, বেসুর নিয়ে আমাদের পরিচিত গায়ক, গায়িকা, সঙ্গীতজ্ঞ, বদ্ধাজন এবং ফেবু  বন্ধুদের মধ্যে তর্ক বিতর্কের পাশাপাশি কখনও কখনও বেশ কলম চালাচালি দেখি। আর সে কারনেই তার রেশ ধরেই বোধ করি একটু লেখার প্রয়াস খুঁজছিলাম। আর সেটা আরও উসকে উঠেছিল যখন পাড়ায় নতুন করে সংগীত অনুরাগীদের নিয়ে  একটা গানের দল তৈরী করা কথা চলছিল। যার একটা নামও ইতিমধ্যেই দেয়া হয়েছিল -“ছন্দে-আনন্দে”। আমরা কোন বাক্য ব্যয় না করে এই “ছন্দে-আনন্দের” ছন্দের তালে তালে তখন স্বপ্নে ভাসছিলাম। সকলকে  নিয়ে গান আর ছন্দের আবহতে সপ্তাহে ,পাক্ষিকে কিংবা মাসে একত্রে বসে গানে আর কবিতার ছন্দে হারিয়ে যাব তা নিয়ে ঘোরের মধ্যেই ছিলাম। যেন কিছুক্ষনের জন্য হলেও আমরা সকলেই জাগতিক যান্ত্রিক যাঁতা কলে পিষ্ট হওয়া যন্ত্রনার প্রাত্যহিক জীবনকে ভুলে যেতে পারি। ডুবে থাকতে পারি ভিন্ন জগতে অনন্য ধ্যান আর এবাদতে নিজেকে খুঁজে নিতে- আমি কে, কোথায় আমার গন্তব্য, আমি কতটুকু পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে মানুষকে ভালবাসতে পেরেছি তার খন্ড কালিন অথচ গভীর অনুভূতির অনুরণন ছিল বুকের মধ্যে।


কেননা সংগীত এবং এর সুরই দিতে পারে  জীবনের একক গন্তব্যের ঠিকানা, দিতে পারে অজানা সীমানার ওপারে অপেক্ষায় জেগে থাকা সুখের আবাস অনুভুতি। আর এই সংগীতকে যে বোদ্ধা শ্রোতা কন্ঠে সুর- বেসুর (!) আর ছন্দ নিয়ে ডুবে থাকলেও  তাল হারা না হয়ে আত্মহারা ছন্দে দুলে উঠে অথবা কোন সাধক গায়কের অসাধারণ কন্ঠের গানে হারিয়ে যেতে  পারে সে-ই বুঝে জীবনের আসল মানে, সে-ই বুঝে কেন চোখের সংগীতজল তাকে এত আনন্দে ভাসায়। আসলে বেসুর(!)ও একটা সুর। যেমন আমি বলে থাকি দূর্ঘটনাও তো একটা ঘটনাই। কিন্তু এ ঘটনার গল্প হয়ত দুঃখ দিয়ে রচিত। তেমনি বেসুরও একটা সুর বৈ কি। আসলে বেসুর মানে কি? কোন একটা গান যে সুরে সাধারনতঃ গীত হয় সেই একই সুরে গীত না হয়ে হয়ত তার ন্যুড্‌, রীড অথবা পর্দা অন্য সুরে লাগছে। গানটা শোনা না থাকলে এটাকেই হয়ত আসল সুরই ধরা হত। আর এ সুরের মধ্যেও মন শিরশির করে না উঠলেও, তাল আছে বলে মনে ঢেউ তোলে, ধ্যান আছে বলে অসীমে মন হারায়। তাইত সকল কান্নার সুর এক না হলেও ভাষা কিন্তু একই, হয় সুখের না হয় দুঃখের। সে আমরা এ জগতের যে প্রান্তেই থাকি না কেন। তেমনি সুরের ভাষাও শ্বাশ্বত।  


এ প্রসংগে আমি নিজেই এর ভুক্তভূগি। মনে পড়ে ভারত মহাসাগরের কোল ঘেঁষা মোজাম্বিকের পেম্বা সমুদ্র সৈকতের সাধারণ জনপদে  সন্ধ্যাকালিন সাগর  সংগমে কোন একদিন বন্ধুদের অনুরোধে বাংলার ঐতিহ্যবাহি ভাওয়াইয়া সগীতে– “ কি ও বন্ধু কাজল ভ্রমরা রে, কোন দিন আসিবেন বন্ধু  কয়া যান কয়া যান রে “ কন্ঠ দেয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই স্থানীয় মোজাম্বিকানরা প্রায় ৬০/৭০ জন আমাকে গোল করে ঘিরে ফেলে। তাদের কাছে এ গানের সুর কি আর বেসুর মনে হয়েছে? ইতি মধ্যে আমি মোজাম্বিক ভাষা বেশ রপ্ত করেছি। প্রত্যন্ত ওই জনপদে বাংলায় পল্লীর সুরের মূর্ছনা যে কিভাবে  আকৃষ্ট করেছিল তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। আমি আবেগে স্তম্ভিত হোয়ে যাই। ওদের কাছে ওদের ভাঙ্গা ভাঙ্গা ভাষায় জিজ্ঞাস করলাম কি এমন ছিল  এই গানে যা এত কাছে টানল তোমাদেরকে আমার কাছে এসে আমাকে ঘিরে গান শোনার জন্য। আমি তো বাংলায় গাইছি, তোমরা কি আমার গান, কথা এবং সে কথার মানে বুঝতে পারছ? তারা সকলেই এক সাথে বলল- না তারা কথার মানে হয়ত বুঝতে পারছে না। কিন্তু সুরের মধ্যে কি যেন প্রানের টান, আবেগ, আকর্ষণ অনুভূত হচ্ছে তা তোমার ভাষাকে ছাপিয়ে কাছে আসতে বাধ্য করছে আর আবেগে ভেসে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে সান্ধ্যকালিন এ নীল ঘন সাগর জলের উচ্ছাস উচ্ছল বাতাস গায়ে মেখে। আমাকে তারা আরও গান গাওয়ার দাওয়াত দিয়ে ফেলল। বলল- আমি যে ক’টা দিন এখানে আছি সে ক’টা দিন যেন এমন সুরে অনেক গান শুনিয়ে তাদের তৃপ্তি দিই। বিনিময়টা আমার উপর ন্যাস্ত হল।


সংগীতের সুর এবং বেসুর এতটাই শক্তিশালি যে এর সুরের আলো তারকালোকেও পৌঁছে যায়। কিছুদিন আগে তাই কোন এক কবিতায় আমি লিখেছিলাম-
  
“তারার দেশেও ভেসে বন্ধু থাকবে ছোট্ট চাওয়া
তোমার সুর আলো হয়ে জড়ায় যেন দেহ,
সুখের বন্যায় বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখব তোমায়
আমিই শুধু জানব সে প্রেম জানবে না আর কেহ।“
  
সংগীত নিয়ে গায়ক, গায়িকা, গীতিকার, সুরকারদের মনে এমন ছোট্ট দুই একটি এলোমেলো কথা থাকেই। এ ছাড়াও সঙ্গীত পিপাসু এবং অনুরাগীদের মনেও কিছু প্রশ্ন প্রায়ই খেলে যায়। আরও বলা বাহুল্য, আমরা যখন একটি কবিতা পড়ি তখন তাকে শুধুমাত্র কথার মালা বা ছন্দ হিসেবে দেখি না - কথার সাথে প্রেম, সুখ দুঃখ এবং ভাবের সম্বন্ধ বিচার করি। তবে সব কিছুর উর্ধে ভাব-ই মুখ্য লক্ষ্য। কবিতা নিয়ে কথা  হল ভাবের আশ্রয়স্বরূপ। তবে গান যেমন সুর আর বেসুরের খেলা, তেমনি কবিতা কিন্তু কবিতার মত করেই পাঠ করার খেলা। আসলে কবিতারও একটা সুর লয় আছে। সেটাকে ধরে, বুঝে বা দেহাভ্যন্তরে ঝুঁকে কবিতা পাঠ না করলে এবং এর শব্দদের ভেতর প্রবেশ না করলে কবিতাকে সঠিক ভাবে বুঝা যায় না এবং পক্ষান্তরে কবিতা তখন ভালো না লাগার সাহিত্য হয়ে দাঁড়ায়। আমরা সঙ্গীতকেও এ ভাবেই দেখার প্রয়াস পাই। তাই  সঙ্গীত ১০টি ঠাটের তান বিস্তার সহ  সুরের রাগ রাগিণীই কেবল নয়, সঙ্গীত ভাবের রাগ রাগিণী। আসল কথা,  কবিতা যেমন ভাবের ভাষা, সঙ্গীতও  ঠিক তেমনি ভাবের ভাষা। তাহলে, কবিতা ও সঙ্গীতে প্রভেদ কি?

সংগীত এক ধরনের শ্রবণযোগ্য কলা ,যা সুসংবদ্ধ শব্দ ও নৈশব্দের সমন্বয়ে মানব চিত্তে বিনোদন সৃষ্টি করতে সক্ষম। স্বর ও ধ্বনির সমন্বয়ে সঙ্গীতের সৃষ্টি। এই ধ্বনি হতে পারে মানুষের কণ্ঠ নিঃসৃত ধ্বনি, হতে পারে যন্ত্রর শব্দ অথবা উভয়ের সংমিশ্রণ। কিন্তু সকল ক্ষেত্রেই সুর বা বেসুর সংগীত ধ্বনির প্রধান বাহন। সুর ছাড়াও অন্য যে অনুষঙ্গ সঙ্গীতের নিয়ামক তা হলো তাল। বেসুর হয়ে সংগীত উতরিয়ে গেলেও আমার মনে হয় তাল হীন বা বেতালে সংগীতকে উতরান যায় না। অর্থাৎ একটা সম্পূর্ণ সঠিক সাংগীতিক সময়ের পূর্ণতাই সংগীতের নির্দিষ্ট তাল।
  
কিন্তু কোন কিছু বিশ্বাস করানো এক, আর উদ্রেক করানো হল একক এবং স্বতন্ত্র, যা আর এক অনুভূতি। বিশ্বাসের শিকড় যদি থাকে দেহের মাথায়, তা হলে বলতেই হয় উদ্রেকের শিকড় থাকে হৃদয়ে। এই জন্য, বিশ্বাস করানোর জন্য যে ভাষা উদ্রেক ঘটানোর জন্য সে ভাষা এক নয় কখনও। যুক্তির ভাষা গদ্য যা আমাদের বিশ্বাস করায় আর কবিতার ভাষা পদ্য যা আমাদের হৃদয়ে উদ্রেক ঘটায়। যুক্তি যে-সকল সত্যকে বুঝাতে পারে না বলেই হাল ছেড়ে দেয়,  কবিতা সে-সকল সত্যকে বুঝানোর জন্য তার পরিসরকে বিস্তৃত করে।
  
আমাদের ভাব প্রকাশের দুটি উপকরণ আছে- কথা ও সুর। কথা যতখানি ভাব প্রকাশ করে, সুরও প্রায় ততখানিই  ভাব প্রকাশ করে। এমন-কি, সুরের উপরেই কথার ভাব নির্ভর করে। একই কথা নানা সুরে নানা অর্থ প্রকাশ করে। অতএব ভাব প্রকাশের অঙ্গের মধ্যে কথা ও সুর উভয়কেই পাশাপাশি ধরা যেতে পারে। সেখানে সুর – বেসুর নিয়ে যাই থাকুক বা ঘটুক না কেন। ভাব সংগীতের মধ্যে আরাধনাই মূখ্য হোয়ে যায়। সংগীতকে অনেকে উপেক্ষা করে বসে থাকে ধর্মীয় অনুশাসনের আবেগ জড়িয়ে। কিন্তু এর গভীরতা কতটুকু বা এ আদৌ পরিহার্য্য কিনা তা এড়িয়ে চলে অথবা এড়িয়ে যেতে হয়। আমি এ প্রসংগ নিয়ে আর আগে বাড়তে চাই না। কেননা আমি মনে করি আমার বিবেক এবং আমার মন-ই হল সব চাইতে বড় কাবাঘর, মন্দির অথবা মসজিদ। এ জায়গাটুকু পরিস্কার থাকলে সকল সাধনাই শুদ্ধ হয়। এ নিয়ে ইসলামের অনুশাসন কি সে আর এক তর্ক- যুক্তি। সেখানে আমি যেতে চাই না।  তাই সকলকে আহবান করব চলুন আমরা সকলেই যারা সংগীতকে ভালবাসি তার সুর-বেসুর, তাল-বেতাল, ভাব- অভাব, বিশ্বাস-অনুভূতি নিয়ে জীবনের মানে খঁজতে একত্রে বসে হারিয়ে যাই মহা সৃষ্টির সুরের বলয়ের মধ্যে জীবনের মানে খুঁজতে। আর সে আলো এবং ভালবাসা নিয়ে জন্ম নিক আমাদের কবিতা (যদিও সকল কবিতাই সুর আরোপ যোগ্য নয়), গীতি কবিতা, গান, জীবনের সংগীত।


১৩ মে, ২০২০।