শ্রুতি কাব্য নিয়ে ভাবলেও লেখা হয়ে উঠছিল না। বন্ধুদের জন্য তবুও ক্ষুদ্র প্রয়াস...  


রাত্রিও থাকে গভীর ঘুমে
-পলক রহমান।


এখন রাত্রি দুটো বেজে ত্রিশ মিনিট। এমন সময় কেউ
জেগে থাকলেও রাত্রি ঠিকই সময়ের কোলে মাথা রেখে
নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে। অথচ দেখি এক দল পথশিশুদের চোখে
এখনও ঘুম নেই।


আজ আমিও যেন ওদের দলে। তফাত এই যে, আমার একটা  
আশ্রয় আছে, একটা গন্তব্য আছে। সাথে আছে রাত জাগার
জন্য একটা অনুকূল উদ্দেশ্য। তবুও কিছুক্ষনের জন্য আমার
ইচ্ছে হল ওদের সাথে এমন রত্রিতে আলগা কথায় গা ভাসাতে।


গত রাতে ওদের সাথে ঘুমহীন কথোপকথনটা ছিল এমনঃ


- তোমাদের সাথে কিছুক্ষন কথা বলা যাবে?
- স্যার, ট্যাকা দিবেন?
- টাকা চাও, কিন্তু মাথার চুলে যে রঙ করেছ সেটার
টাকা কোথায় পাও।
স্যার এইডা ডাই করছি। ফ্যাশন লইছি। হের ট্যাকা
ভূতে জুগায়। (বলেই এক গাল হাসতে থাকে)।
- স্যার দশটা ট্যাহা দিবেন?
- দিব। তার আগে বল- আচ্ছা বাঁ দিক থেকে শুনি। তোমার নাম কি?
- প্রথম জন বলেঃ “আমার নাম বাপ্পি।“
- তারপর?
- আমার নাম বাপি। (আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। তাই বলিঃ)
- তোমার নামও বাপ্পি?
- জ্বী না স্যার, বাপ্পি না, আমার নাম বাপি।
- স্যার দশটা ট্যাহা দিবেন?( প্রথম জন পুনরায় )
- তারপর?
- আমার নাম নীরব, আমার নাম অনিক।
- পরের জন?
- আমার নাম, আমার নাম বলতে বলতে
সে তার নিজের নাম বাপ্পি বলতে গেলে
পাশের জন বলেঃ এই তোর নাম তো এইডা না।
আশ্চর্য্য হোই নিজের নাম কি কেউ ভুলে যায়!
থমকে যাই আমি। থমকে থাকে রাত।
কিন্তু সাবজেক্ট থমকায় না। সে প্রথম জনকে
জিজ্ঞেস করেঃ ওই ব্যাডা কস না আমার নামডা
কি যেন?
- স্যার দশটা ট্যাহা দিবেন?  (প্রথন জন)


আসলে এদের নাম কখনও তার বাবা বা মা বা খালা দিয়েছিল
কি না তা তাদের মনে নেই। আর মনে থাকলেও সেটা তাদের
পছন্দের নয়। তবে বুঝা যায় তাদের মধ্যে “বাপ্পি” নামটা এখন
বেশ পছন্দের। তাই বাপ্পির কাছাকাছি বাপি হলেও চলবে। নয়ত
বাপ্পি। কিন্তু নামও যে নিয়ন্ত্রিত হয় তাদের মধ্যে তা আমাকে বেশ
ভাবনায় ফেলে। ওদের সবার মাঝে যে একটু লিডার টাইপের
সেই লিডার একরকম রাতের নীরবতা ভেংগে রাগতঃ স্বরে বলেঃ

- তোরে না কইছি তোর নাম সালমান?
স্যার এত প্যাঁচাল পাড়েন ক্যান? দশটা
ট্যাহা দিবেন কিনা হেইডা কন?


আমরা যেখানে এই বিশেষ কথোপকথন নিয়ে ব্যস্ত ঠিক
সেখানেই একটা পায়ে চলা উড়াল সেতু। সেতুর নীচে স্বভাবগত
কিছু পান বিড়ি, চা বিস্কুটের দোকান। তখনও কিছু খদ্দেরের ভীড়।  
জায়গাটা যাত্রিবাহী বাস থামার স্থান। যত্র তত্র ময়লা আবর্জনা।
পানের পিকের গন্ধের সাথে ব্যবহৃত ভেজা চা পাতার দলা মিশে  
এমন এক উৎকট গন্ধের আয়োজন হয়েছে তা সকলের কাছে
ভাল না লাগতে পারে। পথকলি শিশুদের যে প্রতি রাতে বেশ
চাংগা রাখে তা বুঝাই গেল।
দোকানে দাঁড়ানো কোন এক যুবক কি যেন ইশারায় বাপ্পিকে কাছে
ডেকে বেশ কিছু বিস্কুট, পানি আর পেপসির একটা বড় বোতল
তার হাতে গলিয়ে দিল। কে এই যুবক? ইচ্ছে করেই কাছে গেলাম।
দেখি বিপদ সংকেত প্রাপ্ত আবহাওয়ার পুর্বাভাসের মতই তার মুখ
ভার। মনে হল ঐ অপরিচিত যুবকটি খুব একটা খুশি না যে আমি
ছেলে গুলোর সাথে কেন এত কথা বলছি।


পিছন ফিরে দেখি আরও কিছু সমবয়সি পথকলি শিশু সেতুর
রেলিং ধরে বানরের ন্যায় ঝুলছে! তারা বাপ্পির হাতে খাবারের
জোগাড় দেখে তড়িঘড়ি করে নেমে এলো। অবাক হয়ে দেখলাম
সামান্য খাবারই সকলেই কি ভাবে ভাগ যোগ করে খেতে ব্যস্ত হল।
আর ঐ অপরিচিত যুবকটির মধ্যে এমন ভাব যেন নাম ঠিকানাহীন  
বেগানা মানব সন্তান গুলো তার পরম পোষ্য। আর খাবার গুলো তার
ভবিষ্যত বিনিয়োগ। আমি কি যেন এক শংকায় কোন আলাপচারিতা  
ছাড়াই আবার ফিরে এলাম।

- তোমরা এত রাতে এখানে কেন? তোমাদের মা-বাবা,
বাড়ি-ঘর নেই?
- বাবা আছিল? কি জানি। মা কই আছে কইবার পারি না! কেউ
জানাল মা তার আর এক ব্যাডার লগে গেছে গা!


ভাবি আমাদের সমাজেও কোন একটা স্তরে বা ক্লাসে ওয়েস্টার্ণ বা
পাশ্চাত্যের উচ্চ মার্গীয় কালচার নিভৃতেই বেশ জায়গা দখল করে
আছে। এই যেমন কে কার সাথে সহ অবস্থান করছে, কে কাকে ছেড়ে
দিয়ে আর একজনের সাথে চলে যাচ্ছে, সন্তানদের এত খোঁজ খবর
নেয়ার কি আছে, যে যার মত দুঃশ্চিন্তাহীন, ঝামেলাবিহীন বেশ সাচ্ছন্দ
জীবন কাটাচ্ছে। স্ত্রী প্রতি স্বমীর, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর, বাবা- মায়ের প্রতি
সন্তানের কোন অভিযোগ নেই। তাইত সে এত রাতে অবলীলায়
জবাবদিহিতার অনুশাসন মুক্ত কন্ঠে বলতে পারে মা তার আর এক
ব্যাডার লগে গেছে গা। পাশ্চাত্যের সাথে তফাত এই যে একটা স্বীকৃত
পরম্পরা আর একটা অস্বীকৃত নীরব দখলি স্বাধীনতা যেন! ভাবি এই নীরব
বিপ্লবের শেষ পরিনতিটা কি? আমরা কোন দিকে যাচ্ছি। আমি বলিঃ


- এত রাত হল তোমরা ঘুমাবে না?
- কয়ডা বাজে স্যার?
- আড়াইটা।
- তার মানে দুইডা সাথে আরও ত্রিশ মিনিট, তাই না স্যার?
আচ্ছা স্যার দশটা ট্যাহা দিবেন, নাকি ফুইটা যামু?
আমগো আবার রাইত দিন আছেনি স্যার। আমরা ঘুমানোর
আগের রাইতই ঘুম শেষ করে। আমাগর ঘর বাড়ি এইডাই।
আসলে আমগোর যেহানে রাইত সেহানেই ক্কাইত।
- এত রাত হল তোমাদের মা চিন্তায় থাকবে না?
- ক্ষুধা লাগছে, দশটা ট্যাহা দিবেন স্যার?


আমার স্বভাব্জাত ভাবনা হিসেবে ইচ্ছে ছিল তাদের মাঝে সমসাময়িক
শিক্ষার একটু আলো ছড়াই। বলি তারা যেন একটু লেখা পড়া করে,
সময় পেলে গোসল করে। যে পোষাক টুকু পড়ে আছে তা যেন পরিস্কার
থাকে। নইলে বাংলাদেশ যে গার্মেন্ট শিল্পে বিশ্বে এক নম্বর আর সে দেশে
শিশুদের গায়ে পোষাকের এ কি বেহাল অবস্থা। ঠিক যেন মানায় না।
মানায় না মানে বাংলাদেশের এই পোষাক শিল্পকে যেন ব্যাংগ করা হয়! ,
কিন্তু আমার কথা তাদের মোটেই আগ্রহী করে তুলছিল না। বরং
সে অপরিচিত রাশ গম্ভীর যুবকের দিকেই তাদের মনযোগ ছিল দায়িত্বের।


আবার কি এক ইশারায় তারা এক যোগে ঐ যুবকের দিকে দৌড় দেয়।
শুধু একজন যেতে যেতে থেমে যায়। পিছন ফিরে আমাকে বলছিলঃ


- মা আর বাপের খোঁজ লয়ার কি দরকার স্যার? আমাগোর খোঁজই তো
কুনো বেডায় লয় না। আমরা কি খাই, কুনহানে থাহি, কি পড়ি,
আমাগো ইস্কুল কুনডা? আচ্ছা স্যার, আমাগো ইস্কুল নাই?
- সেটাই তো তোমাদেরকে জানাতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু...
- স্যার জানার দরকার নাই! আমি অহন যাই।
- দশ টাকা চেয়েছিলে নিবে না?
- নিমু না স্যার। হেই ট্যাহা কোন বুইড়া বেটা বা বেটিরে দিয়া দিবেন।
হইতেও পারে তারাই আমাগোর কাউরো মা-বাবা।
- তোমরা ভবিষ্যতে মানুষ হবে সে স্বপ্নও দেখাতে চেয়েছিলাম।
- দরকার নাই স্যার আমগো ওস্তাদ অনেক স্বপ্ন দেহায়।
- কি রকম স্বপ্ন দেখায় তোমাদের ওস্তাদে?
- কমু ক্যান্‌? কমু না স্যার। ওস্তাদের মানা আছে। বড় হইলে তহন
এমনিতেই স্বপ্ন ভালা লাগে।
- লেখা পড়া করবা না?
- না স্যার লেহা পড়া কইরা কি অইব। এমতেই ভালা আছি। শিক্ষিত মানষের
লাহান চোর হবার চাই না।
- দশ টাকা চেয়েছিলে নিবে না?
- জ্বী না স্যার। হেই ট্যাহা সরকারের ঘরে ট্যাক্সো দিয়া দিয়েন। আর একটা  
পদ্মা ব্রীজ অইব। তহন দেশে গাঁও গেরামে কাম কাইজ থাকব। হুনছি সেই কথা।  
একবার মা’য় কুন বেডারে জানি কইছিল।
- আজ আর ঘুমাবে না?
- অহন রাইত ঘুমাইছে। হেরে ঘুম থিকা তুলোনের দরকার নাই।
হেরে ঘুমাইতে দেন। আর আপনিও ঘুমান। আপনি বুঝি কবিতা
আর গান লেহেন তাই না স্যার?
- কি করে বুঝলে?
- আমরা বুঝি স্যার। কত কবি বেডায় এহানে আইছে। কত কথা কইছে,
মাগর ট্যাহা দিবার চায় না। খালি প্যাঁচাল পাড়ে। আইচ্ছা স্যার, কবিরা
কি আমাগো লাহান গরীব? ( কথাটা বলেই এক গাল হাসি দিয়ে পালাতে চায়)
- দশ টাকা চেয়েছিলে নিবে না?
- ট্যাহা নিমু না স্যার। আপনি কবি মানুষ। তয় পারলে হেই ট্যাহায়
একটা গান লেইখ্যা সুর দিয়েন। আমরা ব্যাকতেই গামু। যেতে যেতে বলে অহন  
আমরা যেমুন গাইঃ

“অতীতের কথা গুলো
পুরনো স্মৃতি গুলো
মনে মনে রাইখো
আমি তো ভালা না
ভালা লইয়াই থাইকো”


আমি ওদের যাত্রা পথে অবাক হয়ে চেয়ে রই। আর ভাবি কারা প্রকৃত মানুষ!