বাংলা সাহিত্যে মানসীদের উজ্জ্বল অবস্থান। সে বনলতা সেন, সুরঞ্জনা, রুবি রায়, নিরা, নীলাঞ্জনা, অনামিকা, তোমাকে চাই, তুমি কে।
এই মানসীদের মধ্যে কার উপস্থিতি সবচেয়ে জোরালো? বনলতা সেন। কারণটা কি? বাকি মানসীরা অনেক জীবন্ত। তাদের একটা স্পষ্ট রূপরেখা পাওয়া যায়। এক মূর্ত কল্পনা। কিন্তু বনলতা সেন? সে বিমূর্ত, তাকে স্পষ্ট করা যায় না, ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, তবু তার চুলে বিদিশার নিশা, মুখে শ্রাবস্তীর কারুকার্য। শুধু মুখোমুখি বসা যায়। আর তার মুখোমুখি বসতে ঘুরে আসতে হয় হাজার বছর।
মানসীদের বৈশিষ্ট্য কি? তারা সুমন্দভাষীনি, তাদের হাসিতে বসন্ত আসে, তারা কুসুম বিলাসী.....
আর কোন উপমায় তাদের ধরা যায় না, "তোমার তুলনা আমি খুঁজি না কখনো"।
কিন্তু তারা থাকেন আড়ালে, "কেন দূরে থাক, শুধু আড়াল কর"।
তারা সৌরভময়ী এবং তারা নিশীথিনী, "ভরিবে সৌরভে, নিশীথিনী সম"।
তারা মাঝ রাতে কড়া নাড়েন, "অবনি বাড়ী আছ?"
অনেক ঘুরে এসে তবে তার খোঁজ মেলে, "ভুবন ভ্রমিয়া শেষে, আমি এসেছি তোমারি দেশে"।
তিনি মাঝরাতে এসে মোমবাতি জ্বেলে আমায় বলেন, "আমার ছবি আঁকুন"।
তুমি বললেই ফিদা হোসেন কে দিয়ে আঁকাব তোমার ছবি......
কিন্তু ইনি কে? কি ছবি আঁকব তার।
মানসরা উপেক্ষিত কেন? তারা কি দোষ করলেন।
একজন বললেন, পুরুষের ওই মতি। যা পেয়েছি তাতে কিছুতেই তৃপ্ত নই। তাই এত মানসী। অর্থাৎ অতৃপ্তি থেকে তৃপ্ত হবার প্রয়াস। অপূর্ণতা থেকে পূর্ণতায় যাবার প্রয়াস। কিন্তু নারীও খুঁজছেন, "আমি খুঁজছি আমি খুঁজছি............তুমি কোথায় থাক অনন্য"। এবং আশা একদিন ঠিক তাকে পেয়ে যাব, "দুষ্ট ছেলে, কোথায় ছিলে, লুকিয়ে এতকাল"। আসলে এই খোঁজা কাকে খোঁজা?
রবীন্দ্রনাথের বিদেশিনী, নজরুলের দারুচিনি দেশের বিদেশিনী, জীবনানন্দের দারুচিনি দ্বীপের ভেতরে যেমনি দেখার সে, আর মাঝ রাতে যিনি শক্তির দরজায় কড়া নাড়েন, তারা সব একই জন।
কেউ কেউ বনলতা সেন কে বলেছেন এ আসলে ওই হেলেন বা ভেনাসের মত কেউই। আমার মনে হল না।
নানা চিত্রকর বনলতা সেনের ছবি আঁকলেন। সেখানে তিনি মানবী বা মানবী আর মানসী মিলিয়ে। শুধু একজন ছাড়া। তিনি ধীরাজ চৌধুরী। শিল্পী গনেশ পাইন, বনলতার যে ছবি আঁকলেন, সেখানে বনলতার সমাহিত চোখ, মুখে অনেক ধ্যানলিনতা। বনলতার পরিচয় প্রকাশ করলেন তিনি ইঙ্গিতে। ধীরাজ চৌধুরী করলেন সরাসরি। বনলতার কপালে তিনি বসিয়ে দিলেন এক তৃতীয় চক্ষু।
বনলতা সেনের সাথে রুবি রায়, নীলাঞ্জনা, নীরা, অনামিকা এদের পার্থক্য আছে। এরা মানবী, বনলতা তা নন। জাগতিক থেকে মানুষের চেতনা যে অতি জাগতিককে ছুঁতে চায়, চেতনাকে যে অতিচেতনা ডাক পাঠায়, সেইই বনলতা। তবে বাকিদের ওই বনলতার অংশ হিসাবে ভাবা যায়।
রক্ত মাংসের যে বনলতা আছেন সারা জীবন ধরে সব সংগ্রামে, তিনি তবে কে? আসলে তিনি আর এই মানসী একই। তার ভেতর দিয়ে জানতে, অজান্তে, ভ্রান্তে যাকে যায়না ছোঁয়া সহজে তাকে ছোঁয়ার চেষ্টা। তাই  গায়ক গাইলেন তার গানে, "মানসী বিদায়, তোমাকে বিদায়, ফুলের মালা চন্দনেতে সাজিয়ে দিলাম চিতায়"।
কিন্তু এইটি স্বীকার করতে এত দেরি কেন, সেই চিতা পর্যন্ত অপেক্ষা করিয়ে রাখা।
সব কথা মুখে বলা হয়ে ওঠে না, কিছু কথা বুঝে নিতে হয়। সেখানেই তার সৌন্দর্য।
এখন চলি, টেবিলে মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে আছেন বনলতা সেন। তার সাথে কথা বলে আসি। তার ইচ্ছে আমি তার ছবি আঁকি।
বি: দ্র: ছবিটি ধীরাজ চৌধুরীর আঁকা।