একটি অত্যন্ত প্রশংসিত বই 'ক্লিনটন বি. সিলি-র' 'আ পোয়েট অ্যাপার্ট'। ক্লিনটন বি.সিলি ছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি র প্রাণিবিদ্যার স্নাতক । না তাঁর ছিল কোনো বাংলা সাহিত্যের জ্ঞান আর না চিনতেন কোনোদিন জীবনানন্দকে । এহেন এক ব্যক্তি করলেন  "মরণোত্তর জীবনানন্দ" কে নিয়ে দুই শতক ধরে গবেষণা এবং সঙ্গে জীবনানন্দ এর কবিতার বহু অনুবাদ। সৃষ্টি হলো  বাংলা সাহিত্যিক বিশ্বের একটি উজ্জ্বল ছবি 'আ পোয়েট অ্যাপার্ট'। বাঙালি কবির শিল্পসম্মত বিকাশ এবং সাহিত্যিক বিশ্বকে যেভাবে লিখেছেন সেটি অত্যন্ত নিবিড়ভাবে অনুসন্ধান করে এই অসাধারণ বইটি অতুলনীয় করে আমাদের উপহার দিলেন।
শুরু করার আগে আরো একজনকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা না জানালে আমার বিবেক দংশিত হবে ।তাঁর নাম
শ্রদ্ধেয় প্রবীণ সাহিত্যিক ' ফারুক মঈনউদ্দীন' যিনি 'আ পোয়েট অ্যাপার্ট' এর অনুবাদ করলেন  "অনন্য জীবনানন্দ"  নামে '। (প্রথম প্রকাশ : আষাঢ় ১৪১৮, জুলাই ২০১১, প্রথমা প্রকাশন - কারওয়ান বাজার, ঢাকা ১২১৫, বাংলাদেশ, পৃষ্ঠাঃ ৩৫৬ )।
'আ পোয়েট অ্যাপার্ট' এর প্রথম প্রকাশক ১৯৯০ সালে ইউনিভার্সিটি অফ ডিলাওয়ার প্রেস , মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
পৃষ্ঠা - ৩৪১ ।    
শুরু করার আগে একটু পশ্চাদপট জেনে নেয়া জরুরি যে কিভাবে তিনি আকৃষ্ট হলেন বাংলা সাহিত্যের প্রতি । কারণ যে-সব মানুষ গড়পড়তা সাধারণ জনতার একজন, এই পরিচয় ছাপিয়ে কোনও না কোনও দিকে উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠেন, কেমনভাবে গড়ে ওঠে  তাঁদের মননের স্বরূপ সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কৌতূহল থাকা খুব স্বাভাবিক।  উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের জীবনীচর্চা পৃথিবীর সর্বত্র যথেষ্টই চাহিদা মেটায়।আগেই বলেছি তিনি প্রাণিবিদ্যার স্নাতক । স্নাতক হবার পরে তিনি যোগ দেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জনপ্রিয় জন এফ কেনেডি (যিনি ২২শে নভেম্বর ,১৯৬৯ এ আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারান) প্রতিষ্ঠিত শান্তি বাহিনী (পিস্ কোর) এ । তাঁকে পাঠানো হলো বাংলাদেশে বরিশাল জেলা স্কুলে পিস্ কোরের কর্মী হিসেবে। এই মুহূর্তটাই হয়ে গেলো তাঁর জীবনের সন্ধিক্ষণ। তাঁকে পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল হাতে কলমে স্কুলের শিক্ষকদের বিজ্ঞান শিক্ষা দেয়া। সেই সঙ্গে শুরু হলো বাংলা শেখা। শুরু করলেন যেতে ওরিয়েন্টাল মিশনারি স্কুলে সপ্তাহে চার পাঁচদিন করে।যেটুকু জেনেছি তিনি নাকি বরিশালি টানে বেশ ভালো বাংলা বলতে পারতেন পরের দিকে। দু বছরের চুক্তি শেষ হলো তাই এবারে ঘরে ফেরার পালা। মস্তিষ্কের অন্তরে রয়ে গেলো বাংলা সাহিত্যের ওপরে কিছু গবেষণা করার চিন্তা। দেশে ফিরে স্নাতোকত্তোর শিক্ষার জন্যে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় এ ভর্তি হলেন। বিভাগ -"দক্ষিণ এশিয়া ভাষা ও সভ্যতা"। বিষয় - 'বাংলা ভাষা ও সাহিত্য'। বাংলা সাহিত্যে নিমজ্জন শুরু হলো এভাবেই।


এবারে গ্রন্থটি সম্বন্ধে ক্লিনটন সাহেবের নিজের মুখ থেকে কিছু শোনা যাক।
"১৯৬০ এর দশকে যদিও আমি পিস্ কোর এর সেচ্ছাসেবক হিসেবে জীবনানন্দের নিজের শহর বরিশাল এ কাজ করেছি, কিন্তু তখন তাঁর সম্বন্ধে কিছুই  জানতাম না।জানতে পারলাম অনেক পরে তাঁর কবিতার মাধ্যমে।  শিকাগো ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং লেকচারার জ্যোতির্ময় দত্ত আমাকে জীবনানন্দের বিস্ময়কর ভুবনের সাথে প্রথম পরিচয় করান। গত দুই দশকে আরও অনেকে আমাকে ভালোভাবে  বাংলা সাহিত্য শিখতে সাহায্য করেছেন। কলকাতায় সাহিত্যিক বন্ধু বুদ্ধদেব বসুর ঘরে চায়ের দাম থেকে শুরু করে সাহিত্য, রাজনীতি অনেক আলোচনা হতো। বিশেষ করে কবিতা নিয়ে আলোচনার সন্ধ্যেগুলো ছিল দুর্মূল্য। যদিও এই জীবনীগ্রন্থের মূল চরিত্রটিকে ব্যক্তিগতভাবে আমার জানার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর বিধবা পত্নী লাবণ্য দাস, দুই সন্তান মেয়ে মনজুশ্রী ও ছেলে সমরানন্দ এবং ভাই অশোকানন্দ ও বোন সুচরিতার সঙ্গে সাক্ষাৎকার। তাদের সবাই বিভিন্ন ভাবে আমাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।বর্ণনাতীত ভাবে অসংখ্য ব্যক্তি আমাকে সহায়তা করেছেন আমাকে অনেক কিছুর দৃষ্টি আকর্ষণ করে যা আমার গবেষণার কাজটাকে করে তুলেছেন আরো রোমাঞ্চকর ও সম্পূর্ণ।"


উপসংহার :-
ক্লিনটন বি সিলির স্বীকারোক্তি -------------
বাংলা ভাষা জানেন না তাদের জন্যে আজ নিশ্চয় সময় এসেছে তিনি যে কবিতা এঁকেছেন সেসব দেখা।অন্যভাবে উল্লেখ করা না হয়ে থাকলে এই গ্রন্থের সব অনুবাদ আমার , যেমন সব অনিচ্ছাকৃত ভুল ব্যাখ্যাও নিশ্চিতভাবে আমার।  


আলোচনা শেষ করার আগে  ক্লিনটন বি সিলির জীবনানন্দের গুটিকতক কবিতার কিছু অংশের অনুবাদ উল্লেখ করলাম।


কমলালেবু
একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব
আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে?
আবার যেন ফিরে আসি
কোনো এক শীতের রাতে
একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে
কোনো এক পরিচিত মূমূর্ষুর বিছানার কিনারে।
  
Tangerine
Jibanananda Das
Translated from the Bangla by
Clinton B. Seely
When once I leave this body
Shall I not come back to the world?
If only I might return
Upon a winter's evening
Taking on the compassionate flesh of a cold tangerine
At the bedside of some dying acquaintance.


ভিখিরী


একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি আহিরীটোলায়,
একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি বাদুড়বাগানে,
একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো—
তবে আমি হেঁটে চ'লে যাবো মানে-মানে।
—ব'লে সে বাড়ায়ে দিলো অন্ধকারে হাত।
আগাগোড়া শরীরটা নিয়ে এক কানা যেন বুনে যেতে চেয়েছিলো তাঁত;
তবুও তা নুলো শাঁখারীর হাতে হয়েছে করাত।


একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি মাঠকোটা ঘুরে,
একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি পাথুরিয়াঘাটা,
একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো—
তা হ'লে ঢেঁকির চাল হবে কলে ছাঁটা।
—ব'লে সে বাড়ায়ে দিলো হাত গ্যাসলাইটে মুখ।
ভিড়ের ভিতরে তবু—হ্যারিসন রোডে—আরো এক গভীর অসুখ,
এক পৃথিবীর ভুল; ভিখিরীর ভুলে: এক পৃথিবীর ভুলচুক।


Beggar
Jibanananda Das
Translated from the Bangla by
Clinton B. Seely


I got one pice at Ahiritola,
I got one pice at Badur Bagan.
If I could just get one more,
I'd walk away with dignity
—he said, stretching out his hand in the dark.
It was as if a blind man yearned with all his being to weave cloth,
But his efforts become as the conch-shell craftsman's saw in crippled hands.


I got one pice while roaming through the parks,
I got one pice at Pathuria Ghata.
If I could just get one more,
I'd have some rice husked
—he said, extending his neck till the light from the gas lamp fell upon his face.
But in the crowd—on Harrison Road—was a deeper sadness.
A world's mistake: a beggar ignored. A failure of the world.


বনলতা সেন
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।


চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের 'পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, 'এতদিন কোথায় ছিলেন?'
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।


সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে—সব নদী—ফুরায় এ-জীবনের সব লেন দেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।


Banalata Sen
Jibanananda Das


Translated from the Bangla by
Clinton B. Seely
For thousands of years I roamed the paths of this earth,
From waters round Sri Lanka, in dead of night, to seas up the Malabar Coast.
Much have I wandered. I was there in the gray world of Ashoka
And of Bimbisara, pressed on through darkness to the city of Vidarbha.
I am a weary heart surrounded by life's frothy ocean.
To me she gave a moment's peace—Banalata Sen from Natore.


Her hair was like an ancient darkling night in Vidisha,
Her face, the craftsmanship of Sravasti. As the helmsman when,
His rudder broken, far out upon the sea adrift,
Sees the grass-green land of a cinnamon isle, just so
Through the darkness I saw her. Said she, "Where have you been so long?"
And raised her bird's-nest-like eyes—Banalata Sen from Natore.


At day's end, like hush of dew
Comes evening. A hawk wipes the scent of sunlight from its wings.
When earth's colors fade and some pale design is sketched,
Then glimmering fireflies paint in the story.
All birds come home, all rivers, all of life's tasks finished.
Only darkness remains, as I sit there face to face with Banalata Sen.


পাঠকদের অগ্রিম ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানাই।