ভূমিকা:-
১৯২১ সাল, ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে একটি মোমবাতির আলোয় কলকাতার তালতলা লেনের একটি ছোট্ট আঁতুড়ঘরে জন্ম হয়েছিল 'বিদ্রোহী' কবিতাটির। না,জন্মের সময় সেই শিশুটি কেঁদে ওঠেনি। জন্মেই বাঙালির চেতনাকে অগ্নিবীণায় ঝংকৃত করেছিল। আমাদের মতো পথহারাকে টেনে তুলে আনলো, আর দিলো নতুন  কিরণধারা বাঙালি হৃদয়ে। কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি মনীষার এক মহত্তম বিকাশ, বাঙালি সৃষ্টিশীলতার এক তুঙ্গীয় নিদর্শন।


'বিদ্রোহী' কবিতায় মিথ (পুরান) প্রয়োগ:-
বিজ্ঞান যেমন মানুষের ধারণাকে বিশ্বাসে স্থাপন করে, কবিতায় মিথের ব্যবহার চেতনাকে প্রোনোদিত করে , উৎসাহিত করে, অনুপ্রেরণা যোগায়। এই মনীষীর ছিল অগাধ গ্রীক ও ভারতীয় পুরানের জ্ঞান।  আর সেই  জ্ঞানকে বিদ্রোহী কবিতায় প্রয়োগ করে অপূর্ব  ছন্দ অলংকারে আলোড়িত করলেন বাংলা কাব্যজগৎ। অনুপ্রাস, রূপক, উপমা প্রয়োগে অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রাখলেন এই মহান কবি কাজী নজরুল তাঁর বিদ্রোহী কবিতায়। নজরুল এই কবিতাটিতে মিথ প্রয়োগ করে অতীত জীবনসত্যের সঙ্গে বর্তমানের সত্যকে প্রতীকিত করে পাঠকের হৃদয়ে পৌঁছে দিয়েছেন এক অনাঘ্রাত সৌরভ।
বিদ্রোহী কবিতায় মিথোলজি'র সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ:-


কবিতায় তিনি প্রতিটি ছত্রে পৌরাণিক রূপকের ব্যবহার করে আমাদের চমৎকৃত করেছেন। নটরাজ শিবই আসলে  নজরুলের এই কবিতার কেন্দ্রবিন্দু। কিছু উধৃতির মাধ্যমে দেখানো যাক।
১) মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ্ রাজটিকা দীপ্ত জয়শ্রীর
২) মহা-প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস
৩) আমি      ধূর্জটি , আমি এলোকেশে ঝড় .......
৪) আমি       নৃত্য পাগল ছন্দ  
     আমি       আপনার তালে নেচে যাই আমি মুক্ত জীবনানন্দ
৫) আমি       ব্যোমকেশ ,ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর
৬) আমি       পিনাক পানির ডমরু ত্রিশূল .....
৭) আমি        আকুল-নিদাঘ তিয়াসা, আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি


শিবের নানান রূপের তিনি বর্ণনা দিয়েছেন ওপরের উধৃতি গুলোতে। 'আমি' শব্দের বিপুল ব্যবহারের দ্বারা সহজেই বোঝা যায় যে নটরাজ শিব যেহেতু ধ্বংস ও সৃজনের দেবতা এবং শক্তির প্রতীক, তাই নজরুলের মানস-প্রতীক পুরুষ হয়ে উঠেছে শিব। এই আমিত্বকে প্রকাশের জন্যেই তাঁর এই বিশাল আয়োজন। কবিতার মূল সুরে তাই কবির মনের ভেতর এক প্রচন্ড বিদ্রোহের আগুন প্রকাশ পেয়েছে। কবি এক নতুন টেকনিক নির্মাণ করে সময়কে ব্যবহার করেছেন মুক্তির পথ হিসেবে। আমি'র প্রকৃত পরিচয়কে আবিষ্কার করে অনন্তে উত্থিত হয়েছেন, যা কেবল নব-সৃষ্টি নয় , নজরুলের চেতনাকে বীর পুরুষের চিত্রকল্পময় উত্থান কে রূপায়িত করেছেন।
অসত্য, অমঙ্গল , এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ তিনি  সাহসী, শক্তিমান পুরাণ প্রতীক ভারতীয় মিথ থেকেই  শুধু সংগ্রহ করেননি, বিদেশি ইতিহাসের বীরপুরুষ কিংবা নিষ্ঠূর শ্রেণীর নৃশংসতার প্রতীক পুরুষদের তিনি বিদ্রোহী কবিতায় 'আমি'র বিপরীতে ব্যবহার করেছেন ।
'আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস,
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ ।'
মুক্ত প্রাণ বেদুইন চরিত্র এবং প্রবল দুর্ধর্ষ মোঙ্গল চেঙ্গিস খান এর নৃশংসতা কবি নিজের সমান্তরালে এনে দাঁড় করিয়েছেন। তিনি যাদের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহের বাণী উচ্চারণ করেছেন, তারা ছিল শত্রু অর্থাৎ ব্রিটিশ সরকার ।
নটরাজ শিবকে তিনি ব্যবহার করেছেন একদিকে প্রলয় পাগল হিসেবে আবার অন্যদিকে নব উন্মেষের প্রতীক সৃষ্টির রক্ষক হিসেবে ।নতুন সমাজ গড়ার জন্যে যুবশক্তি কে জাগ্রত হতে বলেছেন । ধ্বংস করতে বলেছেন জীর্ণ পুরাতন ভয় শাসিত উৎকণ্ঠা ব্যাকুল পৌরুষহীন সমকালীন সমাজকে ।
দেখুন আরো কতভাবে তিনি মিথের ব্যবহার করেছেন কবিতায় ।
** আমি হোম শিখা, আমি সাগ্নিক জমদগ্নি
    আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত,আমি অগ্নি ।
** আমি ইন্দ্রানী সুত,হাতে চাঁদ ভাল সূর্য্য
** আমি খ্যাপা দুর্বাশা,বিশ্বামিত্র শিষ্য
**  তাজী বোররাক আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার হিম্মত হ্রেষা হেঁকে চলে !
(বোররাক : দ্রুতগতির স্বর্গীয় বাহন।)
(উচ্চৈঃশ্রবা :  ইন্দ্রের বাহন, যা সমুদ্রমন্থনের সময় জন্ম নেয় এবং অশ্বশ্রেষ্ঠ।)  
বোররাক আর উচ্চৈঃশ্রবা কে বাহন করে দৃপ্ত তেজে সেই ঘোড়াকে আগুনের ওপর দিয়ে ছন্দকে লাফ দিয়ে পার করতে পারেনএকমাত্র নজরুল, আর কেউ নয় !


উপসংহার:-
নজরুল কেবল নটরাজ শিবের মাইথোলজি প্রকল্পনায়ই তুষ্ট ছিলেন না, চেঙ্গিস সভত্যার ধ্বংসকারী নজরুল ও হতে চেয়েছিলেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সভ্যতা ধ্বংস করতে! এই অভীপ্সার আলোকবর্তিকাই তিনি নির্মাণ করেছেন বিদ্রোহী কবিতায়!


টিকা :-  তাঁর এই কবিতায় কোনো ভনিতা নেই,আছে শুধু  সাহসী উচ্চারণের দ্বারা মানব চেতনাকে জাগ্রত করার প্রয়াস! আরবি , ফারসি, হিন্দি, তুর্কি শব্দ প্রয়োগে তাঁর দক্ষতা চমৎকার ভাবে কাজে লাগিয়েছেন এই কবিতায় ।


***উৎস সূত্র :-
"নজরুলের কবিতায় মিথ ও লোকজ উপাদান" -- মাহবুব হাসান