আসরের শ্রদ্ধেয় কবি যাদব চৌধুরী'র 'ফেসবুক ও কবিতার চর্চা' রচনাটিতে একটি লাইনের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু আলোচনা করতে এই লেখার প্রেরণা পেলাম।  
লাইনটি এইরকম :-
"কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতাকে সজনীকান্ত দাস "শনিবারের চিঠি" পত্রিকায় কঠোর বিরূপ সমালোচনা করেছেন l কিন্তু জীবনানন্দ দাশকে আটকানো যায় নি "।


হ্যাঁ জীবনানন্দের 'ক্যাম্পে' কবিতাটি নিয়ে কবিকে অশ্লীলতা ইত্যাদি নেতিবাচক কঠোর সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। প্রথম দুটি স্তবক এখানে তুলে ধরছি যাতে পাঠকের বুঝতে সুবিধা হয়।  


"এখানে বনের কাছে ক্যাম্প আমি ফেলিয়াছি;
সারারাত দখিনা বাতাসে
আকাশের চাঁদের আলোয়
এক ঘাইহরিণীর ডাকে শুনি –
কাহারে সে ডাকে!


কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;
বনের ভিতরে আজ শিকারীরা আসিয়াছে,
আমিও তাদের ঘ্রাণ পাই যেন,
এইখানে বিছানায় শুয়ে শুয়ে
ঘুম আর আসে নাকো
বসন্তের রাতে।"


বিতর্কের সূত্রপাত ওই একটি শব্দকে নিয়ে ---"ঘাইহরিণী"।


'ঘাই' শব্দটি একটি আসামি শব্দ।জীবনানন্দের "বনলতা সেন" যেমন সর্বাধিক পঠিত ও আলোচিত কবিতা ঠিক "ক্যাম্পে" কবিতাটি ততোধিক ভাবে সমালোচিত কবিতা।


আসলে "ক্যাম্পে" শিকার বিষয়ক কবিতা হলেও এর মূল বিষয়টি উনি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন এই কবিতার মাধ্যমে যা হলো কিনা মানুষের আন্তঃসম্পর্ক।


শনিবারের চিঠি ছিল আজন্ম আধুনিক সাহিত্যের বিরোধী। এর সম্পাদক সজনীকান্ত দাস (১৯০০-১৯৬২) জীবনানন্দের অনেকগুলো কবিতার ব্যঙ্গ করেছেন। সবচেয়ে বেশি ব্যঙ্গ করেছিলেন তাঁর  'ক্যাম্পে',কবিতা নিয়ে। কবিতাটি শুরু হয়েছে যদিও বনে মৃগয়া গমনের পরে ক্যাম্প ফেলবার কথা থেকে, তথাপি ক্যাম্পে যাওয়া এবং শিকার এই কবিতার মূল বিষয় নয়। ঘাই হরিনী বলতে এখানে বোঝানো হচ্ছে জ্যান্ত হরিণ, যাকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কবিতাটি নিয়ে রূঢ় সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন কবি। কবিতার সমালোচনা করতে এসে সজনীকান্ত দাস সকল ভব্যতা এবং সাহিত্যিক শ্লীলতাকে অতিক্রম করে জীবনানন্দের সমালোচনা করেন। ক্যাম্পে কবিতাটি তার মতে অশ্লীলতা চর্চার চূড়ান্ত নমুনা। তার পত্রিকায় জীবাননন্দের নাম বিকৃত করে ছাপতেন, লিখতেন জীবানন্দ। জীবনানন্দকে কবি গন্ডার বলে ডাকতেন। এমনকি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ও এই কবিতার সমালোচনা করেছিলেন। চিরকালনীন রোম্যান্টিসিজম ও আধ্যাত্ববাদের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনানন্দ দাশের মানবের চিরন্তন বিপন্নতা এবং না পাওয়ার বোধে পরাবাস্তবতা অথবা  স্যুরিয়ালিস্টিক কবিতাটি ভাল লাগেনি । তিনি একবার বলেছিলেন জীবনানন্দ দাশের কবিতায় কোন স্টাইল নেই, আছে পাঁচমিশেলি ভাব। যদিও পরবর্তীকালে তিনি ওনার অনেক কবিতার প্রশংসা করেছিলেন ।


বিরূপ সমালোচনায় অতিষ্ঠ হয়ে জীবনানন্দ প্রথম বারের মত তার কবিতার সমালোচনা বিষয়ে কলম ধরলেন। যদিও এই প্রতিক্রিয়াটি জীবনানন্দের স্বভাব সুলভ আচরণের কারণেই প্রকাশ পায়নি তার জীবদ্দশায়।


"আমার ক্যাম্পে কবিতাটি সম্বন্ধে দু একটা কথা বলা দরকার বলে মনে করি। কবিতাটি যখন শেষ হয় তখন মনে হয়েছিল সহজ শব্দে-শাদা ভাষায় লিখেছি বটে, কিন্তু তবুও কবিতাটি অনেকে বুঝবে না। বাস্তবিকই ক্যাম্পে কবিতাটির মানে অনেকের কাছে এতই দুর্বোধ্য রয়ে গেছে যে এ কবিতাটিকে তার নির্বিবাদে অশ্লীল বলে মনে করেছেন। কিন্তু তবুও ক্যাম্পে কবিতাটি অশ্লীল নয়। যদি কোন একমাত্র স্থির নিষ্কম্প সুর এই কবিতাটিতে থেকে থাকে তবে তা জীবনের-মানুষের-কীট-ফড়িঙের সবার জীবনেরই নি:সঙ্গতার সুর। সৃষ্টির হাতে আমরা ঢের নি:সহায়- ক্যাম্পে কবিতাটির ইঙ্গিত এই; এইমাত্র।"


নিচে "ক্যাম্পে" কবিতাটির লিংক টি দিলাম:-


http://bangla-kobita.com/jibanananda/campey/


যারা আগ্রহী তারা সরাসরি পুরো কবিতাটি পড়ে নিতে পারেন এই আসরের ওপরের লিংকটি তে গিয়ে যাতে যদি কেও এ ব্যাপারে আরকিছু সংযোজন করে লেখাটিকে আরো সমৃদ্ধ করতে চান ।


সবাইকে জানাই আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।