ছাত্র ও যেকোনো বইপ্রেমিকের কাছে  কলেজ স্ট্রিট একটি রোমান্টিক জায়গা। মুশকিলের ব্যাপার হলো , বাংলা সাহিত্য নিয়ে আলোচনাতে যে কোনোভাবে এই দুই ভদ্রলোক অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ অথবা নজরুল কোনোভাবে হাজির থাকবেনই। তাই আগে ভাগে জানিয়ে রাখি কলেজ স্ট্রিটের ‘ফেভারিট কেবিন’ এর কথা । এখানেই ছিল কবি নজরুলের আড্ডাখানা। ১৯১৮-তে প্রতিষ্ঠিত এই কেবিনে আড্ডা দিতে আসতেন নজরুল ও তাঁর বন্ধুরা। কেবিনটি এখনো চালু আছে। তবে তা যথেষ্ট জরাজীর্ণ।
"যেদিন আমি থাকব না ক,
থাকবে আমার গান
বলবে সবাই,
‘কে সে কবির কাঁদিয়েছিল প্রাণ’
সত্যি তোমরা দুজনেই মহাকবি আর তোমাদের দুজনার জন্যেই আমাদের প্রাণ সর্বদা কাঁদে।


কলেজ স্ট্রিট কলকাতার প্রধান বই প্রকাশনা ও বিক্রয় কেন্দ্র। ছোটবেলা থেকে এর ডাকনাম তাই জানি বইপাড়া। আনন্দ পাবলিশার্স,দে'জ পাবলিশিং,রুপা এন্ড কোম্পানি. দেব সাহিত্য কুঠির প্রভৃতি প্রধান বাংলা প্রকাশনা সংস্থাগুলোর প্রধান কার্যালয় কলেজ স্ট্রিট এ ।রাস্তার দুধারে অসংখ্য ছোট ছোট বইয়ের দোকান। এখানে পাবেন অনেক দুষ্প্রাপ্য বই। ভাগ্য ভালো থাকলে পেলেও পেতে পারেন হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়ানো আপনার কোনো প্রিয় আউট অফ প্রিন্ট বই। বিখ্যাত স্মিথসোনিয়াম ম্যাগাজিন সাময়িকীতে কোনো একসময়ে একটি গবেষণার  প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় আধ কিলোমিটার লম্বা বইয়ের দোকানে ভরা এই রাস্তা।দুপাশের ফুটপাথে প্রত্যেকটি ভারতীয় ভাষায় প্রকাশিত বই পাওয়া যায়।এমনকি ফ্রান্স,জার্মানি,রাশিয়া ও ইংল্যান্ড এ আউট অফ প্রিন্ট হয়ে যাওয়া অনেক বই পাওয়া যায় এই বইপাড়ায়।
বই ও আড্ডা এই দুটি আমাদের বাঙালিদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। এমনকি প্রেমিকা বললেও অতিরিক্ত বলা হবেনা। দুশো বছরের পুরোনো এই বইপাড়া। নতুন ও পুরোনো বইয়ের সমাহার । ভারতের সর্ববৃহৎ বইয়ের বাজার এটা। আর পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম বইয়ের বাজার । শুধু বই নয়, শতাব্দী প্রাচীন এই বইপাড়াকে কেন্দ্র করে অবস্থান করছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়,প্রেসিডেন্সি কলেজ, ও সঙ্গে বিখ্যাত সাহিত্যিকদের পদধূলায় ধন্য কফিহাউস। এককালে প্রথিতযশা কবি,সাহিত্যিক ও শিল্পীদের আড্ডা ছিল বইপাড়া ও কফিহাউস। এখন সে পুরোনো ঐতিহ্যের হাত ধরে অব্যাহত রয়েছে বইপ্রেমীদের ভিড় , ও কলেজ পড়ুয়াদের আড্ডা ।


'গল্প হচ্ছে মনের ম্যাসাজ,চিত্তের দলাই মলাই,পড়লে মেজাজ হয় চাঙ্গা' - এরকম একটা ধারণা ছিল প্রখ্যাত সাহিত্যিক রাজশেখর বসুর। আর গল্প আর গল্পের বই মনে এলেই মন নিয়ে যায় কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায়।এক ফরাসি সাহিত্য প্রেমী একবার কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায় ঘুরতে এসে মন্তব্য করেছিলেন 'মাইন্ ডি লিভার' বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় বইয়ের খনি।  


চলুন একটু পুরোনো ইতিহাস ঘেটে দেখা যাক।জায়গাটা যেহেতু ভালো ভালো কলেজে ভরা তাই এটার নাম হয়েছিল কলেজ স্ট্রিট। আজকের এই কলেজ স্ট্রিট বা বইপাড়া গড়ে উঠতে শুরু করে ১৯৩০-৪০ সালের কাছাকাছি সময় থেকে।প্রথম বইয়ের দোকানের মালিকের নাম গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়। হিন্দু হোস্টেলের সিঁড়িতে বসে বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় ও একটা বইয়ের দোকান খুলেছিলেন বলে কথিত আছে।যার নাম ছিল সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটরি। তারপর ধীরে ধীরে একের পর এক বইয়ের দোকান বাড়তে থাকে। যদিও আজ অনলাইন দুনিয়া বইয়ের বাজার গ্রাস করেছে কিছুটা কিন্তু আজ ও অনেকের কাছে পুজোর জামার খরচ বাঁচিয়ে গল্পের বই কেনার আগ্রহ বিন্দুমাত্র কমেনি। তার সঙ্গে কফি হাউসের আড্ডাটা ও যেন বই কেনার অঙ্গ হিসেবে আড্ডার আসর হয়ে উঠেছে। আরো একটি কলেজ স্ট্রিটের বিখ্যাত কেবিন নাম 'বসন্ত কেবিন'। যেখানে বসত আড্ডা তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় , মানিক বন্দোপাধ্যায় ,সত্যজিৎ রায়,প্রেমেন্দ্র মিত্রের মতো সেলেব্রিটি দের। আজ যতই নতুন প্রজন্ম শীততাপনিয়ন্ত্রিত রেস্তোরার দিকে ঝুকুক না কেন কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ার ও কফিহাউসের আড্ডা যেখানে ছিল সেখানেই আছে।


তাই চেঁচিয়ে বলি যুগ যুগ জিও তুমি আমাদের প্রাণের বইপাড়া তোমার দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সম্ভার নিয়ে ।আমরা কবিতা ও সাহিত্য প্রেমীরা তোমাকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসি।