আশি দশকের কথা বলছি।চলছে তখন বেঁচে থাকার জীবনযুদ্ধ।রোজ কলকাতা থেকে চুঁচুড়া, আবার চুঁচুড়া থেকে কলকাতা বাড়ি ফেরা।লোকাল ট্রেনে মোট সময় লাগতো এক ঘন্টা।সময়টা কাটবে কেমন করে? আমার নেশা ছিল বই পড়া।কোথা থেকে ওই এক ঘন্টা কেটে যেত নিজেই জানিনা।নেশা ছিল জেমস হেডলি চেস এর ডিটেক্টিভ বইগুলো গোগ্রাসে গেলা।একদিন এক হকার উঠলো আমার কামরাতে।হাতে হরেক রকমের বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করা রাশিয়ান বই।জলের দামে পাওয়া যেত ওই বইগুলো।সব বিষয়ের বই–ই মিলত।বিজ্ঞান অনুবাদ থেকে শুরু করে শিশুদের জন্যে লিখিত বই ও বিশ্ববিখ্যাত সব রাশিয়ান বই -- যেমন দাদুর দস্তানা, নীল দস্তানা,  সিভকা–বুর্কা, নেকড়ে আর ছাগলছানা ইত্যাদি। লিও তলস্তয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’, ‘অ্যানা ক্যারিনিনা’,; ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মাদার’, বরিস পাস্তেরনাকের ‘ডাঃ জিভাগো’, ইত্যাদি বাঙালি গোগ্রাসে পড়েছে।পাস্তেরনাককে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল ‘ডাঃ জিভাগো’র জন্য, উনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সত্তর দশকে মিখাইল সলোকভের ‘অ্যান্ড কোয়াইট ফ্লোজ দ্য ডন’–এর কথা উল্লেখ করতে হয়। যার বাংলা হয়েছিল ‘ধীরে বহো ডন’। আর ‘ভার্জিন সয়েল আপরুটেড’ বইটির ভারী সুন্দর বাংলা নাম ‘কুমারী মাটির ঘুম ভাঙল।’ আরও কত কত ছিল!বিখ্যাত সেই ‘গোল রুটি’র গল্প। একেবারে আমাদের রূপকথার ঢঙেই শুরু হয়েছে—
‘এক ছিল বুড়ো আর এক বুড়ি। একদিন বুড়িকে বুড়ো ডেকে বলল: ‘ও বুড়ি একবার হাঁড়িটা চেঁছে, ময়দার টিন ঝেড়ে দেখ না, একটু ময়দা পাস কিনা। একটা গোল রুটি করে দিবি?’
বুড়ি তখনই একটা মোরগের পাখনা নিয়ে বসে গেল। হাঁড়ি চেঁছে, ময়দার টিন ঝেড়ে, কোনরকমে দু মুঠো ময়দা বের করল। ময়ান দিয়ে বুড়ি ময়দাটুকু ঠাসল। তারপর সুন্দর গোল একটা রুটি তৈরি করে, ঘিয়ে ভেজে, রেখে দিল জানলার ওপরে জুড়বার জন্যে।’
এখান থেকেই গল্পের শুরু। গোল রুটি গড়াতে গড়াতে বেরিয়ে পড়ে। পথে খরগোশ, নেকড়ে, ভালুক তাকে খেতে চায়। কিন্তু রুটি তাদের গান শুনিয়ে ফাঁকি দিয়ে পালায়।
ছোট্ট গোল রুটি,
চলছি গুটিগুটি,..
এইভাবে সবাইকে ফাঁকি দিয়েও গোল রুটি শেষে শিয়ালের কাছে বুদ্ধির দৌড়ে হার মানে। কানে কম শুনি, এই অজুহাত দেখিয়ে শেয়াল রুটিকে জিভের ওপর উঠে এসে গান শোনাতে বলে। তারপর যা হওয়ার তাই। গোল রুটি যায় শেয়ালের পেটে।
কেউ কেউ বলত, এসব বই নাকি আসলে ছিল কমিউনিস্টি প্রচার। যেমন এই গল্পে নাকি শেয়াল ‘‌বুর্জোয়া’‌ আর কারখানার মালিক ‘‌কর্পোরেট হাউস’–এর প্রতীক। এসব ছিল বড়দের ভাবনা। ছোটরা ওসব নিয়ে মাথা ঘামাত না। তারা মজত রূপকথার কল্পদৃৃশ্যে।
সত্তর দশক বাংলায় ‘‌মুক্তির দশক’‌ হতে চেয়েছিল। সেই সময় ৭০০ পাতার ঢাউস ‘বায়োগ্রাফি অফ কার্ল মার্কস’ পাওয়া যেত জলের দামে। মার্কস–এঙ্গেলসের সিলেকটেড ওয়ার্কসও পাওয়া যেত নামমাত্র দামে। ‘অ্যাবাউট লেনিন’ নামে একটি মোটা বাঁধানো বই  মাত্র ৬০–৬৫ পয়সায়।
বিজ্ঞানকে যারা ভালবাসত, বিজ্ঞানের বইয়ের ওপর দুর্বলতা ছিল তাদের। অথচ বাংলা বইয়ের বাইরে ইংরেজিতে যে সব বই ছাপা হত, তা কেনার মতো পয়সা পকেটে থাকত না। সেই অভাব পূরণ করে দিয়েছিল রাশিয়ান প্রকাশনা।
একটা সিরিজ ছিল ‘সায়েন্স ফর এভরিওয়ান’। বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার কি আন্তরিক উদ্‌যোগ ছিল এই বইগুলো। আকর্ষণ বাড়াতে এবং সহজবোধ্য করতে পাতায় পাতায় থাকত রঙিন ছবি, ইলাসট্রেশন। ‘হোয়াই আই অ্যাম লাইক ড্যাড’–এর বাংলা অনুবাদ ‘কেন আমি বাবার মতো’। জেনেটিক্সের জটিল বিষয় এখানে হয়ে উঠেছে গল্প। বিবর্তন নিয়ে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এই ধাঁচেই লিখেছিলেন ‘যে গল্পের শেষ নেই’। মানুষ তার বিজ্ঞান–প্রযুক্তি কীভাবে প্রাণীদের থেকে ধার করেছে তা নিয়েই লেখা ‘ম্যান অ্যান্ড অ্যানিম্যাল’। একটা গুবরে পোকা তার শরীরের চেয়ে বহুগুণ ভারী জিনিস ঠেলে নিয়ে যেতে পারে। তা দেখে কীভাবে মানুষ ক্রেনের নকশা  তৈরি করেছে তার সচিত্র বিবরণ ছোটদের বিজ্ঞানশিক্ষায় প্রাণিত করার আদর্শ উদাহরণ। অসাধারণ এই সহজ বইগুলো আমার কাছে আজ নস্টালজিয়া।
হতে পারে রাশিয়া বই পাঠাত প্রচারের জন্য।তাতে ক্ষতি কী?‌ শিশুসাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞানের বই ছাপিয়ে বিলি করার মতো প্রচার খারাপ তো নয়। কয়েক দশক আগে রাশিয়াকে বলা হত সোভিয়েত রাশিয়া। পুরো নাম ছিল ইউনিয়ন অফ সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক। ছোট করে ইউএসএসআর। এ হেন রাশিয়ার পতন হল। সোভিয়েত ভেঙে খান খান। সমাজতন্ত্রের পতনে অনেকে উল্লসিত। কারও চোখে জল। রাশিয়ার পতনের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ থিতিয়ে পড়ল রাশিয়ান বইয়ের বাজার। ওখান থেকে বই আসা বন্ধ হয়ে গেল। এখানকার দোকানগুলোয় যে বইগুলো ছিল সেগুলো কিছু দাম বাড়িয়ে বিক্রি হতে লাগল। তারপর একদিন ইতি। হারিয়ে গেল ফরেন ল্যাঙ্গোয়েজেস পাবলিশিং হাউস বা বিদেশী ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়, প্রগতি প্রকাশন বা প্রোগ্রেস পাবলিশার্স। পড়ুয়াদের জন্য তৈরি হল শূন্যতা। ছোটদের জন্য রাশিয়ার সেই সব অনবদ্য বইগুলো এলে এখনকার ছোটরাও নিশ্চয় পড়ত। দাদুর দস্তানা, গোলরুটির গল্প তাদের সেল্‌ফি এবং ফেসবুকের আত্মপ্রচার থেকে সরিয়ে নিয়ে যেত কল্পনার অন্য রাজ্যে।
বই তো মানুষের মন তৈরি করে। সঠিক পথ বেছে নেওয়ার মন। রাশিয়া বিশ্বজুড়ে ভাল ভাল বই ছড়াল। সস্তায়, দামি কাগজে। সবাই পড়ে মন ভরাল, শিখল কত কিছু!‌ কিন্তু নিজের দেশে কী হল ?‌ সে দেশের মানুষ কেন অন্য পথ বেছে নিল?‌
মাঝে মাঝে ভাবি আর বড় মনে কষ্ট পাই সেই ডেলি প্যাসেঞ্জারের দিনগুলোর কথা ভেবে।