রবীন্দ্রনাথ শয্যাশায়ী। রোগ যন্ত্রণার চেয়ে তার বেশি কষ্ট ছিল প্রতিদিন কত মানুষের আনাগোনা, সামান্য লোকের সামান্য সুখ দুঃখ যার চিন্তাকে সর্বদা স্পর্শ করতো, কত লোকের জীবন ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলতো তাঁর চিন্তায় আনন্দে, সেই জীবনযাত্রা থেকে যে তাকে দূরে সরে যেতে হচ্ছিলো এই ভাবনাই তাঁকে বড়ো বিচলিত করতো।
নাহলে পরম দুঃখে তিনি কি এই কথা বলতে পারেন "Reduced Price Sale এ উঠেছি, এখন আর আমি ইন্টারেস্টিং নই" । প্রায় অস্তমিত রবির বর্ণচ্ছটা মধ্যাহ্নের ভাস্করের চেয়ে কম মনোরম ছিলোনা। রুগীর ঘরখানির  মধ্যেও যেন মহাকালের পদক্ষেপের তালে তালে তিনি বাজাচ্ছেন উৎসবের রাগিনী।সামান্য লোকের প্রতিদিনের জীবনতরঙ্গের স্রোত থেকে সরে যেতে লাগলো দূর থেকে দূরে, শয্যাতে তিনি বন্দি, রোগের কষ্টে বন্দি, কানের অশক্তিতে বন্দি, চারপাশের জীবনের সঙ্গে এই বিচ্ছেদে তাঁর পূর্ণ প্রাণের উৎসরণের পথ গেলো হারিয়ে ।
অপারেশনের পরে ধীরে ধীরে তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, জ্ঞান নেই তাঁর। সকলেই যখন বুঝতে পারছে কী ঘটতে চলেছে, তখনই গিরিডি থেকে খবর দিয়ে আনানো হয় কবির সুহৃদ ও বিশিষ্ট চিকিৎসক নীলরতন সরকারকে। তিনি এসে নাড়ি দেখলেন, পরম মমতায় কপালে হাত বুলিয়ে দিলেন, তারপরে উঠে দাঁড়ালেন। হেঁটে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে ডা. সরকারের দু'চোখে ছিল জল।


কবির অবস্থার তখন দ্রুত অবনতি ঘটছে।  ৫ ও ৬ অগাস্টের দিনপঞ্জিতে লেখা আছে সেই দিনের ঘটনা পরম্পরা জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে ।আর রয়েছে ৭ই অগাস্টের বর্ণনা অর্থাৎ ২২শে শ্রাবণ । বেলা ন'টায় দেওয়া হল অক্সিজেন। শেষবারের মতো দেখে গেলেন বিধান রায় ও ললিত বন্দ্যোপাধ্যায়। কানের কাছে অবিরাম পড়া হচ্ছিল তাঁর জীবনের বীজমন্ত্র 'শান্তম, শিবম্, অদ্বৈত্যম'। খুলে দেওয়া হল অক্সিজেনের নল। ধীরে ধীরে কমে এল পায়ের উষ্ণতা, তারপরে একসময়ে থেমে গেল হৃদয়ের স্পন্দন। ঘড়িতে তখন বাজে ১২টা ১০ মিনিট।শেষমুহুর্ত উপস্থিত হওয়ার আগেই জোড়াসাঁকোতে হাজির হাজারে হাজারে মানুষ। কবি নিজে এই ভাবে নিজের শেষটা চাননি। তাঁর ইচ্ছা ছিল কোনও জয়ধ্বনি ছাড়া সাধারণভাবে শান্তিনিকেতনে প্রকৃতির কোলেই তিনি যেন মিশে যেতে পারেন। তাঁর শেষ ইচ্ছাটা আর রাখা যায়নি।


যে মানুষটি দরদ দিয়ে মানুষের অন্তস্তলে পাঠিয়ে দিতেন  তাঁর স্নেহময় অন্তর্দৃষ্টি কত সহজে, সেই প্রতিভাদীপ্ত আবির্ভাবকে স্মরণ করে আসুন আমরা তার পুন্যপাদস্পর্শে বিরহ বেদনার্ত হৃদয়ের প্রণাম নিবেদন করি বাইশে শ্রাবনের এই পুন্য দিনে।


""যাহা মরণীয় যাক মরে
জাগো অবিস্মরণীয় মূর্তি ধরে"।


সবাইকে জানাই আমার প্রীতি ও শুভেচ্ছা।


উৎস সূত্র :-
"মংপুতে রবীন্দ্রনাথ"--- মৈত্রেয়ী দেবী
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির প্যানেল এ যা লেখা আছে ।