আসুন প্রথমে পরিচয় করিয়ে দিই কবি "এড্রিয়েন রিচ" এর সঙ্গে।


জন্ম : আমেরিকার মেরিল্যান্‌ড রাজ্যের বাল্‌টিমোর শহরে মে ১৬, ১৯২৯ সালে।
মৃত্যু : মার্চ ২৭, ২০১২ (aged 82)  সান্তাক্রূজ ,ক্যালিফোর্নিয়া।


নারীবাদ তত্ত্ব কি সেটা প্রথমে বোঝা দরকার।
নারীবাদী তত্ত্ব হলো প্রথাগতভাবে নারীদের পক্ষে তাত্ত্বিক এবং দার্শনিক রূপ দেয়ার প্রয়াস। যে সব কবি বা সাহিত্যিক নারীদের প্রথাগত সংস্কারবিরোধিতা নিয়ে কবিতা বা সাহিত্যচর্চা করেন তাদের নারীবাদী লেখক হিসেবে গণ্য করা হয়। যাঁদের বহুমাত্রিক লেখাতে মৌলবাদ, যৌনতা, নারীবাদ ও রাজনীতি বিষয়ে যাঁরা পাঠকগোষ্ঠীর দৃষ্টি আর্কষণ করতে সক্ষম হন তাঁদের নারীবাদী কবি হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়।


উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের দুজন কবির নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে।


'হুমায়ুন আজাদ' এবং 'সুফিয়া কামাল'।


এই দুজন কবি  প্রথাগত ধ্যানধারা সচেতনভাবে পরিহার করতেন।তাঁদের সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য পল্লীপ্রেম, নর-নারীরপ্রেম, প্রগতিবাদিতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা, সামরিক শাসন ও একনায়কতন্ত্রের বিরোধিতা এবং নারীবাদের জন্য পরিচিত।


ঠিক একই ধারার কবি ছিলেন এই নারীবাদের প্রতীক মার্কিন কবি "এড্রিয়েন রিচ".


তাঁর উচ্চাভিলাষী কবিতায় সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য তার অব্যাহত অনুসন্ধান, যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে তার ভূমিকা এবং তাঁর উগ্র নারীবাদ প্রতিফলিত হয়েছে। দৈনন্দিন বক্তৃতা, অনিয়মিত লাইন এবং স্তবকের দৈর্ঘ্য ব্যবহার করে, রিচের খোলা ফর্মগুলি কবিতায় স্পষ্টতই "অ-কাব্যিক" ভাষা অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেছে।


কবিতার নাম “চল্লিশ পেরিয়ে মৃত এক নারী”,


বিষয়--স্তনের ক্যানসারে মৃত এক নারীর স্মৃতি।


তোমার স্তনদুটো কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে
ক্ষতগুলো নিষ্প্রভ হয়ে আসে
কয়েক বছর পরে যেমন হয়


যে নারীদের সঙ্গে আমি মেয়েবেলা কাটিয়েছি
তারা সবাই অর্ধনগ্ন
সূর্যালোকিত টিলার ওপরে বসে
আমরা একে অন্যের পানে তাকাই
লজ্জাহীনা


আর তুমিও খুলে ফেললে ব্লাউজ
নিজের থেকে তুমিও চাওনি


তোমার কাটা-ছেঁড়া, অসম্পূর্ণ
মুছে দেওয়া শরীরকে মেলে ধরতে


আমি তাকাতেও পারি না
আমার দৃষ্টি পড়লে ঝলসাবে তোমার বুক
যদিও আমি চিরদিন ভালোবাসবো তোমায়


যেখানে তোমার স্তনদুটো বিরাজ করত একদিন
আঙুল বোলাতে খুব ইচ্ছে করে সেখানে
কিন্তু তা করে উঠতে পারিনি কোনওদিন


কবি এড্রিয়েন যেন সর্বদা নিজের সঙ্গে যুদ্ধরত। নারীবাদের প্রতীক এড্রিয়েন রিচ।


উত্তাল ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় থেকে তার রাজনৈতিকভাবে জড়িত শ্লোকের জন্য সর্বাধিক পরিচিত, রিচের সংগ্রহ ডাইভিং ইন দ্য রেক: পোয়েমস  (1973) "গাড়ি চালিয়ে ধ্বংসের দিকে” কাব্যগ্রন্থটি “জাতীয় বই পুরস্কার জিতেছে। রিচ সহ-মনোনীত অড্রে লর্ড এবং এলিস ওয়াকারের সাথে সমস্ত মহিলাদের পক্ষে এটি গ্রহণ করেছিলেন।রিচ কিন্তু নিজের পুরস্কারের টাকাটি ভাগ করে নিলেন দুই ভগিনী কবির সঙ্গে এবং পুরস্কারটি গ্রহণ করলেন আমেরিকার সব নারীদের পক্ষ থেকে--“পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যাদের কন্ঠরুদ্ধ করে রাখা হ’ত এবং এখনও রাখা হয়”। অনেক সমালোচকের মতে এটিই তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার বই--অত্যাচারিতের ভাষায় লেখা যে কথাগুলো -------
এসেছি আমি এই ধ্বংসাবশেষের
পর্যবক্ষণে।
শব্দগুলোর আমার যাত্রাপথের মানচিত্র।
দেখতে এসেছি ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ
আর যা যা সম্পদ রক্ষা পেয়েছে।
উশকে দিই হাতের প্রদীপ
ধীরে ধীরে দেখতে পাই দুপাশে।
বেশ স্থায়ী একটা অস্তিত্ব গড়ে ওঠে
ধ্বংসভূমির বেড় ধরে ধরে।


আমি দেখতে এসেছি ধ্বংসের ভূমিকে
শুনতে চাই না তার করুণ কাহিনী।


ধ্বংসভূমি সরেজমিনে দেখে কবি ফিরে আসেন, কিন্তু তিনি তখন আর একা নন--সর্বনামের পরিবর্তনে এক নতুন মাত্রা যোগ হয় কবিতার গায়ে। একবচন ও বহুবচনে কবি পুরুষতন্ত্রকে ভেঙে ফেলেন, নারীতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আশায়--


আমরা, মানে আমি, মানে তুমি
ভীরুতা অথবা সাহস--যা নিয়েই হোক
আবার খুঁজে খুঁজে ফেরত আসবো
এই ধ্বংসভূমিতে
সঙ্গে থাকবে ছুরি, ক্যামেরা
আর প্রাচীন এক পুরাণগ্রন্থ, যাতে
আমাদের সকলের নামই অনুপস্থিত।


অ্যা হিউম্যান আই: অ্যাসেজ অন আর্ট ইন সোসাইটি (2009) সহ তাঁর প্রবন্ধগুলো আমেরিকার বিশিষ্ট নারীবাদী চিন্তাবিদদের একজন হিসাবে তার স্থান সুরক্ষিত করেছে। ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড ছাড়াও, রিচ তার কাজের জন্য রুথ লিলি কবিতা পুরস্কার, ল্যান্নান লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড, বলিঞ্জেন পুরস্কার, অ্যাকাডেমি অফ আমেরিকান পোয়েটস ফেলোশিপ এবং ম্যাকআর্থার "জিনিয়াস" পুরস্কার সহ অনেক পুরস্কার এবং প্রশংসা পেয়েছেন।
তিনি 1997 সালে তিনি রাজনৈতিক কারণে জাতীয় শিল্পকলা পদক প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। "আমি রাষ্ট্রপতি ক্লিনটন বা এই হোয়াইট হাউসের কাছ থেকে এই জাতীয় পুরস্কার গ্রহণ করতে পারিনি," তিনি নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত একটি চিঠিতে লিখেছেন, "কারণ শিল্পের অর্থ যেমন আমি বুঝতে পারি, এটি এই প্রশাসনের ধূর্ত রাজনীতির সাথে বেমানান। "


তাঁর পিতা একজন বিখ্যাত প্যাথলজিস্ট এবং জনস হপকিন্সের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর  মা একজন প্রাক্তন কনসার্ট পিয়ানোবাদক ছিলেন। বাবার জন্য তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল এবং  Radcliffe ইউনিভার্সিটি থেকে  ডিগ্রী অর্জন করে একাডেমিক্সে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। 1953 সালে তিনি হার্ভার্ডের অর্থনীতির অধ্যাপক আলফ্রেড কনরাডকে বিয়ে করেন। তার সাথে তাঁর তিনটি সন্তান ছিল, কিন্তু 1960-এর দশকে তাদের সম্পর্ক বিপর্যস্ত হতে শুরু করে।  তিনি পরে বলেছিলেন যে "মাতৃত্বের অভিজ্ঞতা শেষ পর্যন্ত আমাকে উগ্রপন্থী করে তুলেছিল।" 'কনরাড' 1970 সালে মারা যান এবং ছয় বছর পরে 'রিচ' তার দীর্ঘমেয়াদী অংশীদার মিশেল ক্লিফের সাথে চলে আসেন।
একই বছর তিনি তার বিতর্কিত, প্রভাবশালী প্রবন্ধের সংগ্রহ প্রকাশ করেন নারীর জন্ম: মাদারহুড অ্যাজ ইনস্টিটিউশন অ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স (1976)। ভলিউম, তার মাস্টারপিস 'ডাইভিং ইন দ্য রেক' নারীবাদী কবি হিসেবে রিচের স্থান নিশ্চিত করেছে। রিচ পুরুষদের তার কঠোর বর্ণনার জন্য সমালোচিত হয়েছিলেন।


রিচ এড্রিয়ানের দশটি শ্রেষ্ঠ কবিতা


1 Tonight No Poetry Will Serve
2 Living in Sin
3 Planetarium
4 Dreamwood
5 Aunt Jennifer’s Tigers
6 Amends
7 Diving into the Wreck
8 Power
9 Peeling Onions
10 A Mark of Resistance


Tonight, No Poetry Will Serve


আজ রাতে কোন কবিতা পরিবেশন করা হবে না


তোমাকে খালি পায়ে হাঁটতে দেখেছি
একটি দীর্ঘ চেহারা
নতুন চাঁদের চোখের পাতায়


পরে ছড়িয়ে পড়ে
ঘুমন্ত, তোমার কালো চুলে নগ্ন
ঘুমিয়ে আছো কিন্তু বিস্মৃত নয়
ঘুম না ঘুমানো


আমি মনে করি
আজ রাতে কোন কবিতা পরিবেশন করা হবে না।


এড্রিয়েন ভালবেসেছেন দুই নারীকে--একজন শ্বেতাঙ্গী হার্ভার্ডের অর্থনীতির অধ্যাপক আলফ্রেড কনরাড আর অন্যজন কৃষ্ণাঙ্গী জ্যামাইকান-আমেরিকান কথা সাহিত্যিক মিশেল ক্লিফ (১৯৪৫-২০১৬) .মিশেলের মৃত্যু এড্রিয়েনের মৃত্যুর চার বছর পরে জুন ১২, ২০১৬।। তাঁদের কন্ঠে তিনি শুনেছেন প্রথম প্রেমের গান, প্রথম মাধুর্যের কাহিনীগুলি। তাঁদের হাতে অনুভব করেছেন কোমলতা আর আবেগের প্রাথমিক জ্ঞান। যে অনুভূতি তিনি প্রায় দু দশকের দাম্পত্য জীবনে অথবা তিনটি সন্তানের জন্ম দিয়ে পাননি।


এই প্রবন্ধ টি লেখার জন্যে যাদের কাছে ঋণী হয়ে রইলাম।.......


১) পোয়েট্রি ফাউন্ডেশন
২) 'এড্রিয়েন রিচ-এর কবিতায় যুদ্ধ পরিস্থিতি' ----অংকুর সাহা।