সংস্কৃতির প্রধান প্রবাহটির নাম লোকসংস্কৃতি। পৃথিবীতে যেকোনো জাতির সংস্কৃতির মূল মেরুদন্ড গ্রাম্য সংস্কৃতি। লোকসংস্কৃতির বস্তুগত ও অবস্তুগত উপকরণগুলি জীবনের নানা অংশে পরিণত হয়ে মনুষ্য সমাজকে সমাজের নানা কিছু দিয়ে বেঁধে রাখে। লোকসংস্কৃতিতে থাকে না কোনো কৃত্তিমতা , থাকে জীবনবোধের সহজ ও সরল সুর।
গ্রামীণ সংস্কৃতিতে আছে এক শক্তিশালী সোঁদা মাটির গন্ধ ভরা স্বকীয় সংস্কৃতি৷ গ্রামীণ জীবনের আনন্দ-বেদনার কাব্য, জীবনবোধ , সংগ্রাম, দ্বন্দ্ব, বিরহ – এ সবই লোকসংস্কৃতিকে রূপ দেয়৷ লোকসংস্কৃতির মাধ্যমে তার সামগ্রিক প্রকাশ ঘটে লোকগানে, কবিতায়, সাহিত্যে, উৎসবে। কিছু বস্তুসামগ্রী দৈনন্দিন জীবনে গ্রামীণ মানুষের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে এছাড়া গ্রামীণ জীবন অচল৷  


কিছু উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার হবে ...


পল্লীর একটি গৃহের পরিচয় কি ?
দেউড়ি, শোয়ার ঘর, হেঁসেল ঘর, গোলা ঘর,গোয়াল ঘর ইত্যাদি ৷ এ গৃহ তৈরী হয়  মাটির দেয়াল ও খড়ের বেড়া দিয়ে৷ সাধারণ জিনিসপত্রগুলো কি থাকে একটি পারিবারিক গৃহে ? খাট, কাঠের বাক্স, মাটির হাঁড়ি, কাঁসার থালাবাসন , শীতলপাটি, মোড়া, পিঁড়ি, হুঁকো,হাতা- খুনতি, দা-কাঁচি, কোদাল ইত্যাদি৷ চাষির ঘরে আছে লাঙ্গল, জোয়াল, মই, দড়ি, দেউলী ইত্যাদি ৷ জেলের ঘরে থাকে বিচিত্র রকমের জাল, বানা , হোঁচ, কোচ, পলই, বিন্তি, ছিপ, তেকাঠি ইত্যাদি৷  তাঁতির আছে তাঁত, মাকু চরকা, ইত্যাদি৷  কামারের আছে হাপর, হাতুড়ি, ছিলকা ,বাটালি ইত্যাদি৷  


নজরুলের কবিতায় লোকজ-উপাদানের ব্যবহার লক্ষ করার আগে আসুন আমরা জেনে নিই তাঁর চিন্তাধারা কেমন ছিল? নজরুল লৌকিক জীবনাচারের কবি, যিনি বৃহত্তর জনমানুষের পক্ষে আমরণ সংগ্রাম করে গেছেন৷ যেমনভাবে তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামি, সামাজিক অন্যায়-অবিচার, নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী ছিলেন, তেমনি বৃহত্তর লোক জীবনাচারের অন্তর গাঁথা উপকরণ-উপাদান ব্যবহার করে সমৃদ্ধ করেছেন তাঁর কবিতা গান সহ তাঁর সাহিত্য ভান্ডার৷ কবির কবিতায় স্থান পেয়েছে নিত্যদিন ব্যবহার্য লোকজ উপকরণাদি৷


চৈতি হাওয়া(ছায়ানট)  


"পিয়াল-বনায় পলাশ ফুলের গেলাস-ভরা মউ
ক্ষেত বঁধুর জড়িয়ে গলা সাঁওতালিয়া বউ
লুকিয়ে তুমি দেখতে তাই
বলতে আমি অমনি চাই
খোঁপায় দিতাম চাঁপা গুঁজে, ঠোঁটে দিতাম মউ!
হিজল শাখায় ডাকত পাখি "বউ গো কথা কও!"  


লক্ষ করুন শব্দের সঙ্গে অবলীলায় সংস্কৃত শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে৷ যেমন --গেলাস, মউ, বউ ৷


আমার কৈফিয়ত(সর্বহারা)


গুরু কন, তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছা
প্রতি শনিবার চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন, 'তুই হাঁড়ি চাঁচা!'
আমি বলি প্রিয়ে হাটে ভাঙি হাঁড়ি!
অমনি বন্ধ চিঠি তাড়াতাড়ি!
সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে, হিন্দুরা কন, 'আড়ি চাচা'!
যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি নাড়ি কাছা!


এখানে সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার হয়েছে --  চাঁছা ,  যবন,কাফের, কাছা ইত্যাদি  ৷


গ্রামীণ জীবনে রূপকথা খুবই জনপ্রিয়।রাজার কন্যার সঙ্গে ঘুটে কুড়ানির ছেলের মধ্যেকার প্রেম, কিংবা রাজার ছেলের সঙ্গে পরীস্থানের রাজকন্যার প্রেম ইত্যাদি নিয়ে শিশুরা রূপকথা শুনতে চায় তাদের দাদি-চাচিদের কাছে।
নজরুলের কবিতায় সেই লোকজীবনের কাহিনীকে রূপায়িত করেছে।
যেমন "খোকার গপ্পো বলা" (ঝিঙে ফুল)।
‘ঝিঙেফুল’-এ কাজী নজরুল ইসলাম খোলামেলা হাসি-তামাশা করেছেন। লৌকিক ছড়ায় যেমন বিষয়বস্তু নির্বাচনে তেমন কোনো বালাই নেই, রস-রসিকতা, আনন্দ-বিনোদনের মূল্যই সেখানে বেশি- কবি এ চিন্তা-চেতনা মাথায় রেখেই যেন ছড়াগুলো রচনা করেছেন। তবে এর পাশাপাশি শ্লেষের মাধ্যমে সমাজের অসঙ্গতির দিকের অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন তিনি।
‘খোকার গল্প বলা’ কবিতায় কবি শিশুর আশ্চর্যজনক কল্পনাশক্তি ফুটিয়ে তুলেছেন ।


“ একদিন না রাজা
ফড়িং শিকার করতে গেলেন খেয়ে পাঁপড় ভাজা ।
রানি গেলেন তুলতে কলমি শাক
বাজিয়ে বগল টাকডুমা ঢাক । ”


‘খোকার গল্প বলা’ কবিতায় আমরা লোক জীবনের সাধারণ জীবনচিত্র খুঁজে পাই ।  গাল্পিক খোকা রাজা রানীর গল্প করছে । রাজা ফড়িং শিকার করতে গেছেন পাঁপড় ভাজা খেয়ে, আর রাণী কলমি শাক তুলতে গেছেন ।  
এবারে নজরুলের চমকটা লক্ষ করুন এই স্তবক টিতে ।
এখানে সাধারণ গরিব মানুষের দৈনন্দিন জীবনচর্চা বর্ণিত হয়েছে কবিতায় ।
একটু ভেবে দেখুন কি অসাধারণ তাঁর কল্পনা শক্তি!!


উপসংহার :-
এ নিয়ে লিখতে গেলে পাতার পর পাতা লিখে যেতে হয় । তাই স্বল্প পরিসরে যতটা আমার ক্ষমতার মধ্যে কুলালো তাই লিখলাম । ভুল ভ্রান্তি থাকাও অসম্ভব নয় । তবে একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত যে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় লোকজ উপাদানের প্রয়োগ আমাকে ভীষণভাবে মনকে নাড়া দিয়েছে । তাই আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা । কবিতায় তাঁর লোকজ উপাদানের প্রয়োগের বিশিষ্টতা এবং তাঁর নান্দনিক সাফল্য সন্দেহাতীতভাবে অন্যন্য ।


আসরের সবাইকে জানাই আমার আগামী বছরের (২০১৯)আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা।


কৃতজ্ঞতা স্বীকার :-


'নজরুলের কবিতায় মিথ ও লোকজ উপাদান' -- মাহবুব হাসান।  
নজরুল ইনস্টিটিউট।