৭ ই মে আর ২৪ শে মে এই দুটি দিন বাঙালি ও বাংলা সাহিত্যের গর্বের দিন। মানবিকতার সাধক, ভালোবাসার সাধক, বিদ্রোহের সাধক  এই দুই মহাপুরুষের জন্ম একই মাসে - রবীন্দ্র-নজরুল । তোমাদের চরণ ছুঁয়ে শুরু করি গুরু শিষ্যের প্রতি আমার এই ক্ষুদ্র নিবেদন। তোমাদের দুজনের চরণ আমাদের প্রত্যেকটি বাঙালির হৃদয়ে পাতা।
হোকনা দুজনের বয়সের ব্যবধান ৩৮ বছরের। কি আসে যায় তাতে? তোমাদের দুজনের গভীর সখ্যতা, নির্মল গুরু-শিষ্য সম্পর্ক নিয়ে গেছে বাঙালি আর বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে। সারাজীবন করে গেলে মানবিকতার সাধনা।  সাহিত্যের মর্মমূলে প্রবেশ করার যোগ্যতা বা অধিকার যারা রাখেন না, তারা রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে বিচার করেছেন ধর্ম দিয়ে। তারা বুঝতে পারেননি মানবিকতার সাধনাই করে গেছেন চিরকাল এই দুই মহামানব। নাহলে কি কবিগুরু তার শিষ্যকে আশীর্বাদ করতে পারে এইভাবে ?
‘আয় চলে আয় রে ধূমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু
দুর্দিনের এই দুর্গাশিরে,
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা
জাগিয়ে দে রে চমক মেরে,
আছে যারা অর্ধচেতন'।


নজরুল ইসলাম এটিকে কবিগুরুর আশির্বাদ হিসেবেই মনে করতেন। সে কারণে ধূমকেতু পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই আশীর্বাদের বাণীটি নিয়োমিত প্রকাশিত হতো। নজরুল ইসলাম সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘লাঙল’ পত্রিকার প্রচ্ছদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আশীর্বাদ করে লিখলেন  ......
‘ধর, হাল বলরাম,
আন তব মরু-ভাঙা হল,
বল দাও, ফল দাও,
স্তব্ধ হোক ব্যর্থ কোলাহল।’


নজরুল লিখলেন --- ‘বিশ্বকবিকে আমি শুধু শ্রদ্ধা করে এসেছি সকল হৃদয়-মন দিয়ে, যেমন করে ভক্ত তার ইষ্টদেবতাকে পূজা করে। ছেলেবেলা থেকে তার ছবি সামনে রেখে গন্ধ-ধূপ, ফুল-চন্দন দিয়ে সকাল সন্ধ্যা বন্দনা করেছি। এ নিয়ে কত লোক ঠাট্টা বিদ্রুপ করেছে। নজরুল সঙ্কোচে দূরে গিয়ে বসলেও রবীন্দ্রনাথ সস্নেহে তাকে কাছে ডেকে বসিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে বোলপুরে শান্তিনিকেতনে থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন সৈনিক নজরুল শান্তিনিকেতনের শিক্ষার্থীদের শারীরিক শিক্ষা দেবেন। কিন্তু অস্থির প্রকৃতির বিদ্রোহী নজরুল কোথায়ও এভাবে নিয়মের বেড়াজালে আটকে থাকতে চাননি। নজরুল প্রশ্ন করেছিলেন, 'আপনি তো ইতালি গেছেন সেখানে কবি দ্যনুনজিও’র সঙ্গে দেখা হয়েছিল কি না? রবীন্দ্রনাথ হেসে বলেছিলেন, দেখা হবে কি করে তিনি যে তোমার চেয়েও পাগল।”  নজরুল তাঁর শেষ অভিভাষণে (যদি বাঁশি আর না বাজে) উল্লেখ করেছেন, “কবিগুরু তাকে প্রায় বলতেন – এই উন্মাদ তুই প্রস্তুত হ’। তোর জীবনে বিরাট ট্র্যাজেডি অপেক্ষা করছে শেলীর মত, কিটসের মত। তুই নিজেকে প্রস্তুত কর।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর লেখা ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি কাজী নজরুল ইসলামকে উৎসর্গ করেন। নজরুল তখন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে কারারুদ্ধ। কবি পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের মাধ্যমে জেলখানায় বইখানি পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।জেলার এসে তার হাতে বইটি দিয়ে বলেছিলেন তোমার জন্যে আজ এটা নোবেল পুরস্কার ।  তিনি উৎসর্গপত্রে নজরুলকে ‘কবি’ বলে অভিহিত করে লেখেন, জাতির জীবনের বসন্ত এনেছে নজরুল। তাই আমার সদ্য প্রকাশিত ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যখানি কবি নজরুলকে উৎসর্গ করছি। বইখানি হাতে পেয়ে কবি উল্লাসে ফেটে পড়লেন আর সৃষ্টি হলো সেই বিখ্যাত কবিতা -"আমার সৃষ্টি সুখের উল্লাসে"। সঙ্গে কবিগুরু বার্তা পাঠালেন---  'আমি নিজের হাতে তাকে বইটা দিতে পারলাম না বলে সে যেন দুঃখ না করে। আমি তাকে সমস্ত অন্তর দিয়ে অকুণ্ঠ আশীর্বাদ জানাচ্ছি। আর বলো কবিতা লেখা যেন কোন কারণেই সে বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে, কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা যোগাবার কবিও তো চাই।’ কলকাতার তালতলা লেনের সেই একটা ছোট ঘরে রাতের অন্ধকারে মোমবাতির আলোয় একটি পেন্সিল দিয়ে ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে কবির কলম থেকে বেরিয়ে এলো সেই বিশ্ববিখ্যাত সাড়া জাগানো লোমকূপ খাড়া করা কবিতা "বিদ্রোহী'।আর মাত্র তিন বছর বাদে আমরা পালন করবো 'বিদ্রোহী ' কবিতার শতবার্ষিকী।
নজরুল ইসলামও ১৯২৮ সালে নজরুল তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা সংকলন ‘সঞ্চিতা’ রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেন।
রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘গোরা’ উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি ছায়াছবিতে কবিগুরু  নজরুলকে দিলেন  সঙ্গীত পরিচালকের ভার । বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ এতে বাধ সাধলে রবীন্দ্রনাথ তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং নজরুলকে সঙ্গীত পরিচালনার স্বীকৃতি প্রদান করেন।
হুগলী জেলে কারারুদ্ধ নজরুল জেল কর্মকর্তার অত্যাচারের বিরুদ্ধে অনশন শুরু করেন। একটানা ৩৯ দিন চলে অনশন। সমগ্র দেশবাসী উদ্বিগ্ন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে শুরু হয় মিটিং-মিছিল। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সভাপতিত্বে ১৯২৩ সালের ২১ মে কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে বিশাল জনসভা হয়। উদ্বিগ্ন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুলকে অনশন ভঙ্গ করার জন্য টেলিগ্রাম পাঠান। টেলিগ্রামটি করা হয়েছিল প্রেসিডেন্সি জেলের ঠিকানায়। তিনি লিখেছিলেন, Give up hunger strike, our literature claims you. অবশ্য জেল কর্তৃপক্ষ টেলিগ্রামটি ফেরত পাঠায়। কারণ, নজরুল তখন ছিলেন হুগলি জেলে।নজরুল তাঁর বন্ধু কুমিল্লার বীরেন্দ্রকুমারের মা বিরজা সুন্দরী দেবীর হাতে লেবুর সরবত পান করে অনশন ভঙ্গ করেন।


উপসংহার :---


আর কত লিখবো বলতে পারেন কবিরা ? দুজনের কথা লিখতে গেলে পাতার পর পাতা লিখে যেতে হয়।
এই আসরের কবিদের একটাই খালি অনুরোধ ৭ ই মে আর ২৪ শে মে এই দুই মহাঋষিদ্বয়কে  নিয়ে কবিতার পাতা ভরে তুলুন । আর এটাই বোধয় আমাদের দিক থেকে শ্রেষ্ঠ পন্থা হবে তাঁদের শ্রদ্ধা জানাবার।


সকল পাঠক কে জানাই আমার প্রীতি ,শুভেচ্ছা ও  ধন্যবাদ ।