"শোনো একটি মুজিবরের কণ্ঠ হতে"


প্রিয় কবি ' মিনু গরেট্টী কোড়াইয়া'র 'মুজিব জন্মশতবর্ষ, আলোচনায় উদবুদ্ধ হয়ে আমার এই আলোচনার জন্ম হলো।  


আমরা সকলেই জানি ১৭ মার্চ, ২০২০ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষ পূরণ হতে যাচ্ছে। সারা দেশ তথা সারা বিশ্বে এই দিবসটি তাৎপর্য সহকারে পালন করবে।


মনে পরে গেলো বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে গীতিকার কবি 'অংশুমান রায়' একটি গান লিখেছিলেন
'শোন একটি মুজিবরের থেকে' । ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস। তারিখটা ১৩ অথবা ১৫। একটি পাগল করা গান গোটা গোটা অক্ষরে নিজের হাতেই গানটা লিখেছিলেন অংশুমান রায়। তারিখটা যাই হোক, সেই দিন আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে রাতে 'সংবাদ পরিক্রমা'য় বাজানো হয়েছিল একটি গান। পুরো গানটা একবারে বাজানো হয় নি অবশ্য। একটি ভাষণের মাঝে মাঝে বেজেছিল গানটি।
ভাষণটা ছিল বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ।
গীতিকার: গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার
সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী: অংশুমান রায়
আর গানটা ছিল ....


শোন একটি মুজিবরের থেকে
লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি
আকাশে বাতাসে ওঠে রণী
বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।।
এই সবুজের বুকে চেরা মেঠো পথে
আবার যে যাব ফিরে, আমার
হারানো বাংলাকে আবার তো ফিরে পাব
শিল্পে-কাব্যে কোথায় আছে
হায়রে এমন সোনার খনি।।
বিশ্ব কবির ‘সোনার বাংলা’,
নজরুলের ‘বাংলাদেশ’,
জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’
রূপের যে তার নেই কো শেষ, বাংলাদেশ।
জয় বাংলা বলতে মন রে আমার
এখনও কেন ভাবো আবার
হারানো বাংলাকে আবার তো ফিরে পাব
অন্ধকারে পূর্বাকাশে, উঠবে আবার দিনমণি।।


"এটাই আমার বাবার সেই সময়কার গানের খাতা," একটা একটা করে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বলছিলেন অংশুমান রায়ের পুত্র  ভাস্কর রায়।
গানটির পেছনের গল্পটি নিয়ে বিবিসির অমিতাভ ভট্টশালীর সাথে কথা বলছিলেন অংশুমান রায়ের বড় ছেলে ভাস্কর রায়, যিনি নিজেও একজন লোকসঙ্গীত শিল্পী।
আন্দোলনের একপর্যায়ে মার্চের প্রথম দিন থেকেই উত্তাল হয়ে উঠেছিল ঢাকার রাজপথ।এর মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উড়ানো হয়েছে।পাঠ করা হয়েছে স্বাধীনতার ইশতেহার এবং নির্বাচন করা হয়েছে জাতীয় সঙ্গীত।
ভাষণ দিতে বাসা থেকে বেরোনোর সময় শেখ মুজিবকে তাঁর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব বলেছিলেন - "তুমি যা বিশ্বাস করো, তাই বলবে। ৭ই মার্চের সেই ভাষণ তিনি নিজের চিন্তা থেকেই দিয়েছিলেন। ভাষণটি লিখিত ছিলো না। ৭ই মার্চ সকাল থেকেই ঢাকায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ছিল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা এবং ছাত্র নেতাদের ভিড়।দুপুর দু‌'টার দিকে আব্দুর রাজ্জাক এবং তোফায়েল আহমেদসহ তরুণ নেতাকমীদের সাথে নিয়ে শেখ মুজিব তাঁর বাড়ি থেকে রওনা হয়েছিলেন জনসভার উদ্দেশ্যে।এদিকে সকাল থেকেই রাজধানী ঢাকা পরিণত হয়েছিল মিছিলের নগরীতে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সে সময় রেসকোর্স ময়দান নামে পরিচিত ছিল।সেই রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষের অপেক্ষার পালা শেষ করে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী এবং হাতাকাটা কালো কোট পড়ে শেখ মুজিব উপস্থিত হয়েছিলেন।
''এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকো - এই বক্তব্যের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু একটা গেরিলা মুক্তিযুদ্ধের দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন।''
জনসভায় ছিলেন এমন অনেকে বলেছেন, লাঠি, ফেস্টুন হাতে লাখ লাখ মানুষ উত্তপ্ত শ্লোগানে মুখরিত থাকলেও শেখ মুজিবের ভাষণের সময় সেখানে ছিল পিনপতন নিরবতা।


ভাষণ শেষে আবার স্বাধীনতার পক্ষে শ্লোগান মুখর হয়ে উঠেছিল ঢাকার রাস্তাগুলো।
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে কারাগারে নিঃসঙ্গ। ফাঁসির মঞ্চ তৈরি। কবরও খোঁড়া হয়েছে। বিচারের নামে প্রহসনপর্বও চলছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তখন সাড়ে সাত কোটি বাঙালিসহ বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের কাছে এক অনুপ্রেরণার নাম। বঙ্গবন্ধুর নামে বাঙালি যুদ্ধজয়ের মনোরথের ধ্বজা উড়িয়ে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু সেই মার্চেই পথ দেখিয়েছিলেন। তাই সেস্নাগান উঠেছিল, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ রণাঙ্গন থেকে রণাঙ্গনে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুর বিরুদ্ধে তুমুল তুখোড় যুদ্ধ চালিয়েছে।
বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা ও সহায়তার জন্য তখন এগিয়ে এসেছিলো পশ্চিমবঙ্গের গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানিগুলো। এইচএমভি, হিন্দুস্তান রেকর্ডস্, টুইন রেকর্ড, কলম্বিয়া,পলিডর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গান, কবিতা, নাটক ও যাত্রাপালার রেকর্ড প্রকাশ করেছিল। একাত্তর সালের জুন মাসে গ্রামোফোন কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর গান তৈরির জন্য গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীদের অনুরোধ জানায়। বাংলা গানের নামীদামী শিল্পী, সুরকার, গীতিকাররাও এগিয়ে এসেছিলেন।
একাত্তরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রেও বেজেছে কোলকাতার শিল্পী অংশুমান রায়ের গাওয়া, ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’। গানটি ছিল বঙ্গবন্ধু’র স্বাধীনতার ঘোষণার উপর। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে যেসব গ্রামোফোন রেকর্ড বাজানো হয়েছে, তা ঢাকায় উৎপাদিত ছিল।তবে কেবল বাপি লাহিড়ীর সুরে, শ্যামল গুপ্তের লেখা এবং আবদুল জব্বারের গাওয়া ‘হাজার বছর পরে’ এবং ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের আরেকটি নাম’ গান দুটি বাজানো হয়েছিল। যার প্রকাশক ছিলো এইচএমভি।


একাত্তরের এপ্রিল মাসে এইচএমভি থেকে গান রেকর্ড করার অনুমতি পেয়ে শিল্পী অংশুমান রায় শরণাপন্ন হলেন খ্যাতনামা গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের। অংশুমানের অনুরোধে গৌরীপ্রসন্ন লিখলেন বাঙালির সেই বিখ্যাত চিরসবুজ চিরঞ্জয়ী গান ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে উঠে রণি।’ মুক্তিযুদ্ধ তখন সবে শুরু হয়েছে। এপ্রিলের ৪ তারিখ। ভারতের কলকাতার গড়িয়ায় একটি চায়ের দোকানে আড্ডা বসেছে। আলোচনার মূল বিষয় ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’। এই আড্ডাতেই জন্ম কালজয়ী একটি গানের: ‘শোনো, একটি মুজিবরের থেকে/ লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি/ আকাশে-বাতাসে ওঠে রণী।’ মুক্তিযুদ্ধের সময় গানটি শোনেননি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া যাবে কি? যুদ্ধের সেই দিনগুলোয় যে কটি গান মুক্তিকামী মানুষদের কঠোর সংগ্রামের পথে সাহস জোগাত, প্রেরণা দিত—এই গান সেগুলোর একটি। খ্যাতিমান গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন লোকসংগীতশিল্পী অংশুমান রায়। গৌরীপ্রসন্নর বাড়ি ছিল পাবনায়, আর অংশুমানের জন্ম ভারতের মালদহে হলেও পূর্বপুরুষ ছিলেন রাজশাহীর বাসিন্দা। তাঁদের দুজনেরই বাংলাদেশ নিয়ে অন্য রকম আবেগ কাজ করত।
চায়ের দোকানে বসে গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন চেইন স্মোকার অংশুমানের কাছ থেকে চারমিনার সিগারেট প্যাকেট  নিয়ে তার উপর লিখলেন গানের  প্রথম চারটি লাইন। তৎক্ষণাৎই অংশুমান রায় গান নিয়ে সুরকার ও সংগীত পরিচালক দীনেন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে বসে চারটি লাইনে সুর । যে গান চলি্লশ বছর পর আজও প্রাণে তুফান তোলে। উদ্দীপনা জাগায়। মনে আনে যুদ্ধদিনের দৃশ্য।


প্রথম আড্ডার কদিন পর ১৩ এপ্রিল আবার আড্ডা জমে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের পূর্ণদাস রোডের বাড়িতে। দেবদুলাল ছিলেন ‘সংবাদ পরিক্রমা’র উপস্থাপক। তাঁর বাড়িতে শিল্পী কামরুল হাসানের সাক্ষাৎকার নিতে এসেছেন ‘সংবাদ পরিক্রমা’র প্রযোজক উপেন তরফদার। এসেছেন অংশুমানও। অংশুমান রায় কামরুল হাসানকে বাংলাদেশ নিয়ে গৌরীদার লেখা একটা গান শোনাতে চাইলেন। কিন্তু গান গাওয়ার জন্য হারমোনিয়াম-তবলা নেই। সেই বাড়ির নিচতলায় থাকতেন রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর ঘর থেকে হারমোনিয়াম আনা হলো। কিন্তু তবলা? একটা বাঁধানো মোটা খাতার ওপর আঙুল ঠুকে দিব্যি সেটাকে তবলা বানিয়ে ফেললেন দিনেন্দ্র চৌধুরী। অংশুমান গেয়ে উঠলেন, ‘শোনো,একটি মুজিবরের থেকে…’। সঙ্গে সঙ্গে উপেনের টেপরেকর্ডারও চালু হলো, রেকর্ডও করা হলো।


একটি সংবাদ পরিক্রমা’য় ও সংবাদ বিচিত্রায় গানটি ব্যবহৃত হলো। পরের দিন তুমুল হইচই পড়ে গেল। কুষ্টিয়া অঞ্চলের একদল মুক্তিসংগ্রামী এসে গানটির জন্য কৃতজ্ঞতা জানান। বলেন, তাঁদের যখন হতাশায় ভেঙে পড়ার উপক্রম, তখন এই গানটি মৃতসঞ্জীবনীর কাজ করেছে।’


পরে হিন্দুস্তান রেকর্ড এই গানটি এলপি আকারে বের করার সিদ্ধান্ত নেয়। ঠিক হয়, রেকর্ডের এক পিঠে থাকবে অংশুমানের গানটি। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয়, অন্য পিঠে কী থাকবে?উদ্ধার করলেন আবারো গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। সুর কথা ঠিক রেখে গানটির ইংরেজি ভার্সন তৈরি করলেন। এইচএমভি ইংরেজি ভার্সনে নারীকণ্ঠ সংযোজনের পরামর্শ দেয়। করবীনাথ নামে একজন শিল্পী তখন মঞ্চে ইংরেজি গান গাইতেন। দীনেন্দ্র চৌধুরী তাকেই বেছে নেন। তারপর তৈরি হলো গানটির ইংরেজি ভার্সন ‘মিলিয়ন মুজিবরস সিংগিং’।


টিকা:


টিকা:
অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে বন্ধুদের জানাচ্ছি সেই বিখ্যাত রেকর্ড টি আজ ও আমার কাছে সুরক্ষিত আছে ।