হ্যাঁ, আমি বলছি সেই নবনীতা দেবসেনের কথা, যিনি জন্মেছিলেন দক্ষিণ কলকাতায় এক গৃহে -- যে গৃহের নাম "ভালোবাসা"।আর 'নবনীতা' নামটি দেয়া স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের। তারিখটি ছিল ১৩ জানুয়ারি ১৯৩৮। জন্মেই তো নিঃশ্বাস নিয়েছিলেন কবিতায়।পিতা কবি নরেন্দ্র দেব-সেন আর গর্ভধারিনী কবিমাতা রাধারানী দেবী।একমাত্র সন্তানটির তাই চক্ষুদান হয়েছিল কবিতার আলোয়।কবিতাকে দর্পণ করেই জীবনের সঙ্গে পরিচয়। কবিতাই তাঁর আদি প্রেম, প্রথম প্রত্যয়।১৯৫৯ এ একুশ বছর বয়সে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'প্রথম প্রত্যয়' প্রকাশিত হলো ।


নবনীতার নোটবই থেকে :----
“মনে মনে সারাদিন দেখা, মনে মনে নিত্য সহবাস
সারাক্ষণ কাছে কাছে থাকি, সারাদিন কথা বলি
"বইখানা কোথায় ফেললে?"
বেরুচ্ছো কি? ফিরবে কখন?'
মনে মনে লাগিয়ে দি'জামার বোতাম
ভুরু থেকে সরিয়ে দি' ঝুঁকে-পড়া কেশ
মনে মনে এগিয়ে দি' কলম, রুমাল।
মনে মনে অহর্নিশি,মনে মনে সারা দিনরাত
খুব ঝগড়া, খুব যত্ন, মনে মনে আদরটাদর
সারাদিন সারারাত, আজীবন নিখিল বিস্তার-
মনে মনে মনের মানুষ।”


নবীনতা দেব সেন আজ ভারতের সবচেয়ে বহুমুখী বাঙালি মহিলা লেখক।তাঁর স্বতঃস্ফূর্ততা, প্রকাশের অনন্য শৈলী, জীবনের সুবিশাল এবং বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা তাঁর কবিতা, ছোট গল্প, উপন্যাস, বৈশিষ্ট্য এবং প্রবন্ধগুলিতে স্পষ্ট। তার বুদ্ধি ও হাস্যরস, হৃদয় থেকে হৃদয় সংবেদনশীলতা একসঙ্গে বিচ্ছিন্নতা অনুভূতি তার লেখা একটি ব্যক্তিগত স্পর্শ দেয় যা উপেক্ষা করা কঠিন। বাম-বৌদ্ধিনী, নতি নবী, স্রষ্টা কবিতা, সিতা চেক সূু তাঁর বিখ্যাত কিছু রচনা।আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত কবি, তিনি একাডেমিতে ব্যাপকভাবে সম্মানিত। তিনি কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন এবং ভারতীয় জাতীয় তুলনামূলক সাহিত্য সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি ছিলেন। দেব সেন বিভিন্ন ক্ষমতা ও কমিটিতে বিভিন্ন ক্ষমতা দিয়েছেন। তিনি ছিলেন সদস্য, বাংলা ভাষার উপদেষ্টা বোর্ড, সাহিত্য একাডেমী 1978-198২ সালে; এবং সদস্য ও আহ্বায়ক, ভারতীয় জ্ঞানপীঠ পুরস্কার ভাষা উপদেষ্টা কমিটি, 1975-1990। গৌরিদেভি মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড সহ তিনি অনেক পুরষ্কার পেয়েছেন; মহাদেবী ভার্মা পুরস্কার, 1992; রকিফেলার ফাউন্ডেশন থেকে সেলি পুরস্কার, 1993; 1994 সালে বিহারের ভাগালপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শরৎ পুরস্কার; প্রসাদ পুরস্কর; সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার, 1999।২০০০ সালে উনি পদ্মশ্রী সন্মানে ভূষিত হন।


বাঙালির কাছে নবনীতা দেব সেন একটি বহু পঠিত বইএর মতো। জীবনটা তাঁর কাছে একটা চ্যালেঞ্জ। জীবনের স্তরগুলোকে খুলে খুলে বিভিন্ন সময়ে উপহার দিয়েছেন পাঠককে। পাঠকরাই তাঁর অন্তর বাহিরের পড়শি। সেই হাসিখুশি ছটফটে আশিতে তাই তিনি উচ্ছলতা, প্রাণশক্তিতে ভরপুর একজন মানুষ। আজও সমানে একনাগাড়ে লিখে চলেছেন আমাদের অতিপ্রিয় বাঙালির হৃদয়ের কবি নবনীতা সেন।অনুভব যখন উপচে পড়ে কথার ধারায়, তখন শুধু কবিতা আর তাকে ধারণ করতে পারে না। তখন পা রাখতে হয় গদ্যের শক্ত মাটিতে। ওঁর জীবনে এটাও ধ্রুব সত্য।


নবনীতার প্রেম :-
যখন কবিতায় ভাবা, কবিতায় স্বপ্ন দেখছেন , কবিতায় জীবনযাপন করছেন, ঠিক সেইক্ষণে ভালোবাসার হাতটি বাড়িয়ে দিলেন  যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির তরুণ কৃতী অধ্যাপক নোবেল পুরস্কার জয়ী অমর্ত্য সেন। প্রেম আর কবিতা তখন হাত ধরাধরি করে চলছে ।
তাঁর প্রেমের অনুভূতি উপচে পড়লো কবিতায় ...
“যখনই আমাকে তুমি ভালোবাসো
এমন কি কপালের উড়োচুলও প্রণয় কাতর
ফ্রয়েডীয় তালিকার নির্দেশ ছাপিয়ে
যৌনতার তীব্রতায় হয়ে ওঠে কামনা কুলীন ...”।


প্রেমের পরিণতি-- বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন অমর্ত্য সেনের সঙ্গে।পাড়ি দিলেন স্বামীর সঙ্গে ইংল্যান্ডে ১৯৬০ সালে।ঘরকন্না সামলে বিদূষী মেয়ের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যের  ডিস্টিংকশন সহ মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ।
বার্কলে-তে পোস্ট-ডক্টরাল রিসার্চ ফেলোশিপ করলেন।বিষয়টি ছিল  A Structural Analysis of the Valmiki Ramayana.গর্বের বিষয় এই যে, তাঁর কাজের ওপর নির্ভর করে রাশিয়া ও স্কটল্যান্ডে রামায়ণ বিশেষজ্ঞরা মহাভারত নিয়ে কাজ করেছেন।


অন্তঃসত্ত্বা নবনীতা :-
হলেন নবনীতা একদিন অন্তঃসত্ত্বা।নতুন মাতৃত্বের মধুর অনুভূতি।নবনীতা আনন্দে আত্মহারা।নতুন স্বপ্নে একের পর এক কবিতার জন্ম নিতে থাকলো।সৃষ্টি হলো নবনীতার 'স্বাগত দেবদূত'।
তাদের দুই কন্যা। জ্যেষ্ঠা অন্তরা ও কনিষ্ঠা নন্দনা।
একদিন হটাৎই সুখের ও স্বপ্নের দাম্পত্য জীবনটা যেন দমকা হওয়া এসে ভেঙে তছনছ করে দিলো ।সেই যে  ভয়ঙ্কর শব্দটা?  'ডিভোর্স' শব্দটি বুকে এসে বিধলো।কেও যেন চুরি করে নিয়ে গেলো অতি যত্নে গড়ে তোলা সংসার নামক এক ভাস্কর্য কে।সমাপন হলো একটি সম্পর্কের।
জীবনে এলো আবার একটা নতুন চ্যালেঞ্জ।চিরকালের আদুরে মেয়ে নবনীতা।  মায়ের আদর্শে যিনি গড়ে উঠেছেন, যে মা তাকে বরাবর অনুপ্রেরণা ও সাহস জুগিয়েছেন তাকেই সম্বল করে তিনি জেগে উঠলেন ....
'তোমার মেয়েটাকে তুমি বাড়তে দাওনি, অশেষ কৈশোরে বন্দী করে রেখে দিয়েছ। এই হয়েছে মরণ। জিয়ন কাঠিটি ছিল তোমার হাতে। এবার আমাকেই আমার মা হতে হবে'।
কোনো দুঃখ হতাশাই যে জীবনের চরম এবং শেষকথা নয়, একথা তিনি প্রমান করে দিলেন ইতিবাচক ভাবনাটিকে সঞ্চারিত করে।আজ আবার তার বাসস্থান দক্ষিণ কলকাতার "ভালোবাসা" নামক গৃহটি, যেখানে তিনি জন্ম নিয়েছিলেন, আর আজও সেখান থেকে তিনি একনাগাড়ে লিখে চলেছেন প্রাণের উচ্ছলতা নিয়ে আশি বছর বয়সেও।


তাই নবনীতা তোমাকে জিজ্ঞাসা করি ....
কবিতার জন্যে বুঝি তুমি
বারবার দুঃখ খুঁজে নাও?
কবিতার জন্যে ভাঙো ঘর?


উপসংহার :-
দেখতে দেখতে বছর কেটে গেলো।জীবন থেকে আরো একটি বছর চলে যাবার সময় হলো।মহাকালের স্রোত পেরিয়ে নতুন বছর আসতে চলেছে ২০১৯ ।নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে ঘন্টা ধ্বনি শুরু হয়ে গেছে।
কবিগুরুর ভাষায় বলি -----
"জগৎ জুড়ে উদার সূরে
আনন্দ গান বাজে "
সেই আনন্দ গান বেজে উঠুক আপনার মনে আমার মনে, আসরের সব কবিদের মনে। বেজে উঠুক তা সবার চেতনার মাঝে এই শুভকামনা নিয়ে আমার এই ক্ষুদ্র নিবেদনের ইতি টানলাম।


টিকা :-
হটাৎ নবনীতা সেনকে নিয়ে লেখার প্রেরণা পেলাম ,কারণ এই মুহূর্তে আমার সামনে খোলা আছে নবনীতা সেনের "শব্দ পড়ে টাপুর টুপুর" গ্রন্থটি । যত পড়ছি ততই অভিভূত হচ্ছি।শব্দ নিয়ে ওঁর এই হৃদয় আলোড়িত করা ব্যঞ্জনা আমাকে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে।খুজলাম কিছু তথ্যসূত্র উইকিপিডিয়া ও আমার সংগৃহিত তাঁর কিছু নিবন্ধ থেকে।আর লিখে ফেললাম মনের খুশিতে।
"বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর"