জন্মলগ্নে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নাম দিয়েছিলেন 'নবনীতা'।
পিতৃকুলের দেব,শুশ্রুকুলের সেন  'নবনীতা দেব সেন।'
জন্মেছিলেন দক্ষিণ কলকাতায় এক গৃহে -- যে গৃহের নাম "ভালোবাসা"।  তারিখটি ছিল ১৩ জানুয়ারি ১৯৩৮।
জন্মেই তো নিঃশ্বাস নিয়েছিলেন কবিতায়।পিতা কবি নরেন্দ্র দেব, আর গর্ভধারিনী কবিমাতা রাধারানী দেবী।একমাত্র সন্তানটির তাই চক্ষুদান হয়েছিল কবিতার আলোয়।কবিতাকে দর্পণ করেই জীবনের সঙ্গে পরিচয়। কবিতাই তাঁর আদি প্রেম। ১৯৫৯ এ একুশ বছর বয়সে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'প্রথম প্রত্যয়' (১৯৫৯)প্রকাশিত হলো । প্রথম উপন্যাস 'আমি অনুপম' (১৯৭৬)। পদ্মশ্রী, সাহিত্য অ্যাকাডেমি-সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারজয়ী নবনীতা দেব সেন সেই একই গৃহে অর্থাৎ "ভালোবাসা' গৃহে গত বৃহস্পতিবার ৭ নভেম্বর সন্ধ্যা সাতটা  নাগাদ মহাপ্রয়াণে  চলে গেলেন।
বারো বছর বয়সে ইউরোপ ভ্রমণ বাবা ও মায়ের সঙ্গে। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে বি এ । যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে এম এ । প্রথম শ্রেণীতে প্রথম । ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
পি এইচ ডি। হার্ভার্ড থেকে ডিস্টিংশন নিয়ে এম এ । নবীনতা দেব সেন সবচেয়ে বহুমুখী বাঙালি মহিলা লেখক।তাঁর স্বতঃস্ফূর্ততা, প্রকাশের অনন্য শৈলী, জীবনের সুবিশাল এবং বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা তাঁর কবিতা, ছোট গল্প, উপন্যাস, বৈশিষ্ট্য এবং প্রবন্ধগুলিতে স্পষ্ট। তার বুদ্ধি ও হাস্যরস, হৃদয় থেকে হৃদয় সংবেদনশীলতা একসঙ্গে বিচ্ছিন্নতা অনুভূতি তার লেখা একটি ব্যক্তিগত স্পর্শ দেয় যা উপেক্ষা করা কঠিন। বাঙালির কাছে নবনীতা দেব সেন একটি বহু পঠিত বই এর মতো। জীবনটা তাঁর কাছে একটা চ্যালেঞ্জ। জীবনের স্তরগুলোকে খুলে খুলে বিভিন্ন সময়ে উপহার দিয়েছেন পাঠককে। পাঠকরাই তাঁর অন্তর বাহিরের পড়শি। সেই হাসিখুশি ছটফটে , উচ্ছলতা, প্রাণশক্তিতে ভরপুর একজন মানুষ কে আমরা হারালাম । মৃত্যু শয্যায় আমাদের তাঁর শেষ নিবন্ধ দিয়ে গেলেন  আমাদের অতিপ্রিয় বাঙালির হৃদয়ের কবি নবনীতা সেন।
মৃত্যকে চ্যালেঞ্জ জানালেন কবি সুকুমার রায়ের সেই 'নারদ নারদ' কবিতা অবলম্বনে 'অলরাইট অলরাইট কামেন ফাইট, কামেন ফাইট ,বলে।
"ঠিক আছে । না হয় ক্যান্সার-ই হয়েছে। ক্যান্সার তো এখন অলক্ষ্মীর ঝাঁপির মতো ঘরে ঘরে গুছিয়ে বসেছে। আমিই -বা বাদ যাই কেন? আমার ছোট্ট ভাইজিটা গিনুমা, ছোট বোনটা মুন্নু,ছোট ভাইটা অভীক,ছোট দেওরটা শিব,প্রিয় দাদা অশোকদা, ছাত্রবেলার বন্ধু শ্যামল,কবিবেলার বন্ধু সুনীল, আর সন্তোষ কুমার ঘোষ,আরো কত আপনজনকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছি।হঠাৎ অশীতিপর নবনীতার জন্যে এতো শোক কিসের? তার তো যাওয়ার সময় এমনিতেই হয়েছে।  কিন্তু বন্ধুবান্ধব দের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, কচি বাচ্চার মহাপ্রয়াণ হতে চলেছে।"


'মরিনি, মরবো কিনা তার ঠিকও নেই ।এখন থেকে এতো শোক কিসের?  যেসব মানুষ আমাকে একবারও চোখে দ্যাখেনি, দূর দূর গ্রাম থেকে ছুটে আসতে চাইছে , একবার শেষ দ্যাখা দেখতে ---আরে এটাই শেষ দ্যাখা --তোমায় কে বললো?এরপর তো আমি ইলেকশন এ দাঁড়াবো। তারপর হৈ চৈ পড়ে যাবে । শেষ দেখাটা তখনকার জন্যে তোলা থাক।এতশত জরুরি কাজ ফেলে রেখে আমি কিনা শেষ দর্শন দেব?    এই যে এতো লম্বা জীবনটা কাটালুম, তার একটা যথাযথ সমাপন তো দরকার! পাঁজিপুঁথি দেখে,শুভদিন,শুভ লগ্ন স্থির করে, স্বজন বান্ধবকে নেমন্তন্ন করে খাইয়ে তবে তো শুভ যাত্রা। কিন্তু জীবনে সবকিছু কি পরিকল্পনামাফিক করা যায়? আমার এক কবিরাজ দাদা একটি ভেজষ উদ্যান কিনতে গিয়েছিলেন।ফেরার পথে ঝড়ের মধ্যে ওই বাগানেরই  একটি গাছ ভেঙে ওঁর গাড়িতে পড়ার ফলে দাদার মৃত্যু হয়। জীবন কখন ফুরাবে,তা কি আমরা জানি ? বেচারা ক্যান্সার কে এতো দোষ দিয়ে কি হবে? তাই এই জানা-অজানা, চেনা-অচেনা আত্মীয় বন্ধুর হাহাকারে,শেষ দর্শনের ধাক্কায়,শেষ প্রণামের আবেদনে বেজায় ঘাবড়ে গেলুম। এ কি রে বাবা! এরা তো ভুল বিসর্জনের লাইনে লেগে গিয়েছে? আর তা ছাড়া তালা ভাঙা দরজার অভাব আছে? আমার তো হৃৎকমল থেকে শ্বাসকমল ,সব দরজাই আধখোলা। তো এই কর্কটকমলের এতো মাতব্বরি কিসের? লাঠি  সোঠা একটু বেশি আছে বলে ? দ্যাখো বাপু, এই বিশাল  পৃথিবীতে কতরকম বড় বড় লড়াই যুদ্ধ চলছে, সেখানে তোমার ওই লাঠিসোঁঠার ভয় পাবো ভেবেছো? ওসব তো তুচ্ছু? '
"আই ডোন্ট কেয়ার কানাকড়ি. জানিস আমি স্যান্ডো করি?"    


মৃত্যু সজ্জায় শুয়ে কি অসম্ভব মনের জোরে কথাগুলো লিখে গেলেন আমার অতি প্রিয় লেখিকা নবনীতা দেব সেন।বাংলা সাহিত্যের দিকপাল, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখিকা নবনীতা দেব সেনের জীবনাবসান হল ৭ নভেম্বর। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।


নবনীতার প্রেম :-
যখন কবিতায় ভাবা, কবিতায় স্বপ্ন দেখছেন , কবিতায় জীবনযাপন করছেন, ঠিক সেইক্ষণে ভালোবাসার হাতটি বাড়িয়ে দিলেন  যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির তরুণ কৃতী অধ্যাপক নোবেল পুরস্কার জয়ী অমর্ত্য সেন। প্রেম আর কবিতা তখন হাত ধরাধরি করে চলছে ।
তাঁর প্রেমের অনুভূতি উপচে পড়লো কবিতায় ...
“যখনই আমাকে তুমি ভালোবাসো
এমন কি কপালের উড়োচুলও প্রণয় কাতর
ফ্রয়েডীয় তালিকার নির্দেশ ছাপিয়ে
যৌনতার তীব্রতায় হয়ে ওঠে কামনা কুলীন ...”।


বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন অমর্ত্য সেনের সঙ্গে।পাড়ি দিলেন স্বামীর সঙ্গে ইংল্যান্ডে ১৯৬০ সালে।ঘরকন্না সামলে বিদূষী মেয়ের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যের  ডিস্টিংকশন সহ মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ।
বার্কলে-তে পোস্ট-ডক্টরাল রিসার্চ ফেলোশিপ করলেন।বিষয়টি ছিল  A Structural Analysis of the Valmiki Ramayana.গর্বের বিষয় এই যে, তাঁর কাজের ওপর নির্ভর করে রাশিয়া ও স্কটল্যান্ডে রামায়ণ বিশেষজ্ঞরা মহাভারত নিয়ে কাজ করেছেন।


অন্তঃসত্ত্বা নবনীতা :-
হলেন নবনীতা একদিন অন্তঃসত্ত্বা।নতুন মাতৃত্বের মধুর অনুভূতি।নবনীতা আনন্দে আত্মহারা।নতুন স্বপ্নে একের পর এক কবিতার জন্ম নিতে থাকলো।সৃষ্টি হলো নবনীতার 'স্বাগত দেবদূত'।
তাদের দুই কন্যা। জ্যেষ্ঠা অন্তরা ও কনিষ্ঠা নন্দনা।
একদিন হটাৎই সুখের ও স্বপ্নের দাম্পত্য জীবনটা যেন দমকা হওয়া এসে ভেঙে তছনছ করে দিলো ।সেই যে  ভয়ঙ্কর শব্দটা?  'ডিভোর্স' শব্দটি বুকে এসে বিধলো।কেও যেন চুরি করে নিয়ে গেলো অতি যত্নে গড়ে তোলা সংসার নামক এক ভাস্কর্য কে।সমাপন হলো একটি সম্পর্কের।
জীবনে এলো আবার একটা নতুন চ্যালেঞ্জ।চিরকালের আদুরে মেয়ে নবনীতা।  মায়ের আদর্শে যিনি গড়ে উঠেছেন, যে মা তাকে বরাবর অনুপ্রেরণা ও সাহস জুগিয়েছেন তাকেই সম্বল করে তিনি জেগে উঠলেন ....
'তোমার মেয়েটাকে তুমি বাড়তে দাওনি, অশেষ কৈশোরে বন্দী করে রেখে দিয়েছ। এই হয়েছে মরণ। জিয়ন কাঠিটি ছিল তোমার হাতে। এবার আমাকেই আমার মা হতে হবে'।
কোনো দুঃখ হতাশাই যে জীবনের চরম এবং শেষকথা নয়, একথা তিনি প্রমান করে দিলেন ইতিবাচক ভাবনাটিকে সঞ্চারিত করে।আজ আবার তার বাসস্থান দক্ষিণ কলকাতার "ভালোবাসা" নামক গৃহটি, যেখানে তিনি জন্ম নিয়েছিলেন,  প্রাণের উচ্ছলতা নিয়ে তিনি এক অজানা দেশে বিদায় নিলেন ।