রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রেম নলিনী -'ভালোবেসে সখী, নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো-- তোমার মনের মন্দিরে'


প্রেমের কবি রবীন্দ্রনাথ জীবনকালে রচনা করে গিয়েছেন  অসংখ্য প্রেমের কবিতা ও গান।যেসব কবিতার মাঝে লুকিয়ে আছে প্রেম,বিরহ,ব্যাকুলতা আর নিঃসঙ্গের এক মহা উপাখ্যান।ওনার প্রেমের কবিতাগুলোর অনুভূতি আমার,আপনার মনকে নাড়া দিতে বাধ্য।জানালা দিয়ে শূন্য চোখে চেয়ে থেকে যখন শুনি সেই কবিতাগুলো বা গান , সেগুলোর আবেদনে মুগ্ধ হই। প্রতিটি শব্দ যেন আমার-আপনার কথাই বলে, পাওয়া না পাওয়ার গোলমেলে হিসাব স্মৃতি হাতড়ে বেড়ায়। যতই গানে আধুনিকতা আসুক না কেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গানগুলো আজও টিকে আছে স্বমহিমায়।
"ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো-- তোমার
মনের মন্দিরে।
আমার পরানে যে গান বাজিছে
তাহার তালটি শিখো-- তোমার
চরণমঞ্জীরে॥"


আমার আপনার মতো রবীন্দ্রনাথও কিশোর বয়স পার করেছেন। আর দশজন যেমন করে প্রথম প্রেমের হাওয়া গায়ে লাগিয়ে মাতাল হয়ে পড়ে, রবীন্দ্রনাথকেও সেই হাওয়া দোলা দিয়ে গিয়েছিল বোম্বের এক মারাঠি যুবতী। যার প্রভাব তার জীবনে পড়েছিল এবং সেটা খুব ভালো করেই। কিশোর রবীন্দ্রনাথের মনে প্রথম প্রেমের জোয়ার এনে দিয়েছিল বোম্বের এক মারাঠি মেয়ে, নাম তার নলিনী।নলিনী মানে প্রচুর পদ্ম জন্মে যেখানে। যদিও নলিনী তার আসল নাম নয়, সেটা রবীন্দ্রনাথেরই দেয়া। আসল নাম কী তবে? আসল নামটি হলো 'অন্নপূর্ণা তর্খদ'।রবীন্দ্রনাথের সাথে তার দেখাই বা হলো কী করে, যে নারীকে তিনি অমর করে রেখেছেন অনেকগুলো সাহিত্যকর্মে? নলিনীর বাবার নাম 'আত্নারাম তর্খদ', পেশায় একজন ডাক্তার। সমাজের উচ্চশ্রেণীর পরিবারে জন্মেছিলেন তিনি। তার সুবাদে উঁচু শ্রেণীর লোকজনের সাথেই তার মেলামেশা হতো। পরে তিনি 'প্রার্থনা সমাজ' নামে আলাদা একটি শ্রেণী তৈরি করেন। তৎকালীন ভারতবর্ষের বহু অভিজাত পরিবারের লোকজন এই সমাজে যোগ দেয়।


রবীন্দ্রনাথ যখন নলিনীর দেখা পান তখন তিনি সবে সতের বছর বয়সে পা দেয়া এক কিশোর।রবীন্দ্রনাথের বড় ভাই সতীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এই সমাজে যোগ দিয়েছিলেন, যিনি ভারতীয়দের ভেতর সর্বপ্রথম সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন, যার সূত্র ধরে পরবর্তীতে আত্নারামের সাথে তার সখ্য গড়ে ওঠে।অন্নপূর্ণা তর্খদ(নলিনী) কেবল ব্রিটেন থেকে পড়ালেখা শেষ করে দেশে ফিরেছেন। এদিকে কিশোর রবীন্দ্রনাথকেও পড়ালেখার জন্য ব্রিটেনে পাঠানোর কথা ভাবছিল তার পরিবার। সতীন্দ্রনাথ তাই ভাবলেন অন্নপূর্ণার সাথে থাকলে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজিতে দক্ষ হয়ে উঠবেন। ব্রিটেনে গিয়ে সেখানকার ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবেন সহজেই।আত্নারামের সঙ্গে কথা বলার পর তিনিও কিশোর রবীন্দ্রনাথকে রাখতে রাজি হয়ে যান। সতের বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ তাই ১৮৭৮ সালে পরিবার ছেড়ে চলে এলেন বোম্বেতে। অন্নপূর্ণা ছিলেন বয়সে রবীন্দ্রনাথ থেকে তিন বছরের বড়। রবীন্দ্রনাথ অন্নপূর্ণার কাছে ইংরেজি শিখতে শুরু করেন। তিনি প্রায় দু'মাস এখানে ছিলেন। এই স্বল্প সময়ের মেলামেশাতেই তাদের দুজনের ভেতর সখ্য গড়ে ওঠে।


রবীন্দ্রনাথ এবং অন্নপূর্ণা দুজনেই একে অপরের প্রতি ভালোবাসা দেখাতে শুরু করেন। কিশোর রবীন্দ্রনাথের মনে এর প্রভাব পড়েছিল বেশ ভালোভাবেই। তিনি সেই সময় অন্নপূর্ণাকে নিয়ে বেশকিছু কবিতা লেখেন।
লিখলেন .....
শুন নলিনী, খোল গো আঁখি,
ঘুম এখনো ভাঙ্গিল না কি!
দেখ, তোমারি দুয়ার-’পরে
সখি এসেছে তোমারি রবি'
কিন্তু তাদের ভেতর চলমান অসম প্রেমের এই গল্প বেশিদূর যেতে পারেনি। তাদের নিয়তি ছিল ভিন্ন, বয়স কম হওয়ার কারণে তাদের কেউই সেটা বুঝতে পারেননি।তাদের মেলামেশার গভীরতার কারণে আত্নারাম এবং সতীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন তাদের বিয়ে দিয়ে দেবেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বাবা এই বিয়েতে মোটেই রাজি ছিলেন না। কারণ, রবীন্দ্রনাথের তখন বয়স কম এবং তিনি পড়াশোনা করবেন আরও।তাছাড়া অন্নপূর্ণা তার থেকে বয়সে বড় হওয়াটাও একটি সমস্যা ছিল রবীন্দ্রনাথের বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। তাই সকল পরিকল্পনার সমাপ্তি ঘটে এখানেই। ব্যথিত রবীন্দ্রনাথ নলিনী আর তার অল্প সময়ের স্মৃতি বিজড়িত বোম্বে ফেলে লন্ডনের উদ্দেশ্যে জাহাজে চড়ে বসেন।
রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ড থাকাকালে ১৮৭৯ সালে আত্নারাম ও অন্নপূর্ণা কলকাতার বিখ্যাত জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে আসেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু তাদের ভেতর কী কথা হয়েছিল, তার বিস্তারিত জানা যায়নি। ধারণা করা হয়, বিয়ের প্রস্তাব নিয়েই এসেছিলেন আত্নারাম এবং দেবেন্দ্রনাথ প্রস্তাবে রাজি হননি।"
রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ড গমনের দুই বছর পর ১১ নভেম্বর ১৮৮০ সালে অন্নপূর্ণার বিয়ে হয়ে যায় হ্যারল্ড লিটলডেল নামের একজন স্কটিশের সঙ্গে। বিয়ের পর অন্নপূর্ণা স্বামীর সঙ্গে ইংল্যান্ড চলে আসেন। এখানে তারা এডিনবার্গে বসবাস শুরু করেন। ১৮৯১ সালে অন্নপূর্ণা মাত্র ৩৩ বছর বয়সে মারা যান।
রবীন্দ্রনাথ আর নলিনীর প্রেমের সম্পর্ক যে শুধু সাময়িক আকর্ষণ ছিল না- সেটা বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথের রচিত বিভিন্ন সাহিত্যকর্মে। তাকে নিয়ে রচিত সবগুলো কবিতাতেই নলিনীকে রূপায়িত করেছেন অত্যন্ত সযত্নে। ফুটিয়ে তুলেছেন তাদের ভালোবাসা আর বিরহের নীরব গল্প। ১৮৮৪ সালে রবীন্দ্রনাথ একটি গদ্য নাটক রচনা করেন যার নাম ছিল 'নলিনী'। কিন্তু নাটকের উৎসর্গ পাতায় তিনি কিছুই লেখেননি। নলীনির প্রতি তার ভালোবাসা অন্তরেই রয়েছে, এটা বোঝাতেই হয়তো তিনি কিছু লেখেননি। নলিনীও এই অসম প্রেমকে স্মরণীয় করে রাখতে চেয়েছিলেন, যার কারণে নলিনীর অনুরোধে তার ভাইপোর নাম রাখা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ।
নলিনীর কাছে ইংরেজির দীক্ষা ঠিক কতটুকু নিতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেটা নিয়ে সবার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে! কিন্তু দুজনের মনের লেনাদেনার হিসাব ঠিকই করে নিয়েছিলেন তারা। পড়ার টেবিলে যতটুকু না পড়ালেখা হয়েছে, তার চেয়ে ঢের বেশি প্রেমের বিনিময় হয়েছিল! নলিনীকে নিয়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের গান শুনে নলিনী বলেছিলেন.............


"রবীন্দ্রনাথ; তোমার গান শুনে মনে হচ্ছে, আমার মৃত্যুশয্যার পাশে এই গান শোনানো হলে আমি আবার জীবন ফিরে পাব।"


প্রেমের বেলায় নলিনী রবীন্দ্রনাথের চেয়ে একটু এগিয়েই ছিলেন। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ আকারে-ইঙ্গিতে ভালোবাসার কথা বললেও, মূলত তিনি বেশিরভাগ সময় লজ্জার কারণেই কিছু বলতে পারেননি। নলিনী যখন কিশোর রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এলেন, তখনই তিনি হালে পানি পেলেন!


লীলাময়ী নলিনী,
চপলিনী নলিনী,
শুধালে আদর করে
ভালো সে কি বাসে মোরে,
কচি দুটি হাত দিয়ে
ধরে গলা জড়াইয়ে,
হেসে হেসে একেবারে
ঢলে পড়ে পাগলিনী!


উপসংহার:
ঠিক একই ভাবে রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'শেষের কবিতা' উপন্যাসে লাবণ্য(বন্যা) অমিত(মিতা) র প্রেমকে অমর করে গেলেন।তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে যতগুলো প্রেম এসেছিলো সব কিছু আমরা পেয়ে যাবো তাঁর সাহিত্য কর্মের মধ্যে দিয়ে।  
টিকা :
মানুষের জীবনে এমন কিছু প্রেম আসে যে প্রেম বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হলেও সে প্রেম অমর থেকে যায়।এভাবেই রবীন্দ্রনাথ ও নলিনীর প্রেম রবীন্দ্র সাহিত্যে অমর থেকে গেছে।


বিঃদ্রঃ:
আলোচনাটি পড়ে আসরের কবি বন্ধুদের যদি ভালো লেগে থাকে দুকলম লিখে জানালে জানবো আসরকে অন্তত কিছু দিতে পারলাম ।
আসরের সবাইকার প্রতি ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা জানিয়ে আমার কথাগুলোর ইতি টানলাম।