কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সৃষ্টিশীলতার বিকাশ ঘটিয়ে দুখুমিয়া থেকে তিনি হয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম।  তাঁকে তাঁর ১১৯ তম জন্মদিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। এটা কোনো প্রবন্ধ নয়। কিছু টুকিটাকি ঘটনার মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করা ও মনটাকে ঝালিয়ে নেয়া বিদ্রোহের আগুনে ।নজরুল যুগ যুগ ধরে আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন তার সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে।


১ ) ১৮৯৯ সাল, ১৩০৬ বঙ্গাব্দের এইদিনে বর্ধমান জেলার (পশ্চিমবঙ্গে) আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে কাজী পরিবারে নব জাগরণের কবি কাজী নজরুলের জন্ম।
২ ) ১৯১০ সালে নজরুল লেটো দল ছেড়ে ছাত্র জীবনে ফিরে আসেন। লেটো দলে তার প্রতিভায় সকলেই যে মুগ্ধ হয়েছিল তার প্রমাণ নজরুল লেটো ছেড়ে আসার পর তাকে নিয়ে অন্য শিষ্যদের রচিত গান:
"আমরা এই অধীন, হয়েছি ওস্তাদহীন
ভাবি তাই নিশিদিন, বিষাদ মনে
নামেতে নজরুল ইসলাম,
কি দিব গুণের প্রমাণ",
নতুন ছাত্রজীবনে তার প্রথম স্কুল ছিল রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুল। এরপর ভর্তি হন মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুলে যা পরবর্তীতে নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন নামে পরিচিতি লাভ করে। মাথরুন স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ছিলেন কুমুদরঞ্জন মল্লিক, যিনি সেকালের বিখ্যাত কবি হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তার সান্নিধ্য নজরুলের অনুপ্রেরণার একটি উৎস। কুমুদরঞ্জন স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে নজরুল সম্বন্ধে লিখেছেন,
"ছোট সুন্দর চনমনে ছেলেটি, আমি ক্লাশ পরিদর্শন করিতে গেলে সে আগেই প্রণাম করিত। আমি হাসিয়া তাহাকে আদর করিতাম। সে বড় লাজুক ছিল"
৩ ) কবির বড় নাতনি 'খিল খিল কাজী' র মুখে কিছু কথা শোনা যাক।দুই বাংলার খ্যাতিমান আবৃত্তিকার কবি পুত্র কাজী সব্যসাচী'র বড় মেয়ে এই খিল খিল কাজী। বর্তমানে ঢাকার বনানীতে থাকেন।২৪ মে ২০১৪ এ এই বিবৃতি দিয়েছিলেন তাঁর ১১৫ তম জন্মদিনে কোনো এক অনুষ্ঠানে দাদুকে স্মরণ করে ও শ্রদ্ধা জানিয়ে।
‘দাদুর জন্মদিন। সকাল বেলা বাড়ির সামনে হাজারো মানুষের ভিড়। ফুলের মালায় ভরে উঠছে চারপাশ। দাদু মিটি মিটি হাসছেন। কখনো তাঁর গলা থেকে মালা খুলে পাশে রাখছি। কখনো তিনি নিজেই মালা খুলে আমাদের হাতে দিচ্ছেন-- এই স্মৃতিগুলো খুব মনে পড়ে’।
৪)  নজরুলের প্রেমের গল্প নিয়ে একটু মজা করা যাক জন্মদিনে।
     ঘটনটি ১৯২১ সালের। ১৯২০ সালে বাঙালি পল্টন ভেঙে দেওয়া হলো। চাকরিহারা হাবিলদার নজরুল কলকাতায় প্রথমে ওঠেন  বাল্যবন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের মেসে। কয়েক মাসের মধ্যে মেস ছেড়ে চলে আসেন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিস, ৩২ কলেজ স্ট্রিটে। তারপর হঠাৎ একদিন ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে কী ঘটল? সে ঘটনা আমরা নজরুলের বন্ধু নলিনীকান্ত সরকারের বর্ণনায় শুনি। নলিনীকান্ত বলছেন :
"নজরুল ইসলাম এই সময়ে থাকতেন মেডিকেল কলেজের সম্মুখে ৩২নং কলেজ স্ট্রিটে।নজরুলের প্রাত্যহিক গতিবিধি ও কর্মসূচির সন্ধান আগে থেকেই  আমার জানা থাকত। একদিন সারাটা বিকেল নজরুলের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে তার ঠিক পরদিন সকালবেলায় গিয়ে দেখি নজরুল ঘরে নেই। তাঁর এক সহকক্ষবাসী বন্ধু হাসতে  হাসতে বললেন : 'সে তো কাল রাত্তিরে কুমিল্লা চলে গেছে'।"
কুমিল্লা গেলেন  তো গেলেন, আর নজরুলের ফেরার নাম নেই। এদিকে ৩২নং কলেজ স্ট্রিটে তাঁর  রুমমেট কমরেড মুজফফর আহমদ, 'মোসলেম ভারত'-এর কর্ণধার আফজাল-উল-হক, পবিত্র  গঙ্গোপাধ্যায়, 'মোহাম্মদী' পত্রিকার মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী এবং এমন অনেকের  প্রায় ঘুম হারাম। নজরুল যে গেলেন আর ফিরছেন না। তাঁদের পত্রিকায় লেখা নেই,  বন্ধুদের আড্ডা নেই, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির পরিকল্পনা খাবি খাচ্ছে।  আর নজরুল তখন খাবি খাচ্ছেন দূর কুমিল্লার দৌলতপুরে 'এক অচেনা পল্লী  বালিকার' প্রেমে। এক অচেনা পল্লী বালিকার কাছে তিনি তখন 'এত বিব্রত আর  অসাবধান' হয়ে পড়ছেন, যা আর কোনো দিন হননি।
সেই পল্লীবালার নাম নার্গিস।নার্গিস আসার খানম (সৈয়দা খাতুন) বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম স্ত্রী। কবি তার ছায়ানট; পূবের হাওয়া; চক্রবাক কাব্য গ্রন্থের অনেক কবিতা নার্গিসকে কেন্দ্র করে রচনা করেন। ছায়ানটের মোট ৫০ টি কবিতার মধ্যে "বেদনা অভিমান'; "অবেলায়"; "হার মানা হার"; "অনাদৃতা"; "হারামনি"; মানস বধু; বিদায় বেলায়; পাপড়ি খেলা; ও বিধূর পথিক সহ মোট নয়টি কবিতা নার্গিসকে কেন্দ্র করে লেখেন। নার্গিসের মামা আলী আকবর খান নজরুলের সাথে কলকাতায় পাশাপাশি থাকতেন। তিনি নজরুলকে তার বাড়ি কুমিল্লায় নিয়ে যান ১৯২১ সালে, উদ্দেশ্য ছিল তার পরিবারের কোন মেয়ের সাথেই নজরুলের বিয়ের ব্যবস্থা করা। নজরুলও নার্গিসকে পছন্দ করেন এবং বিয়েতে রাজি হন। এই সময় আলী আকবর খান নজরুলকে তার কলকাতার কোন বন্ধুদের চিঠি দিতেন না এমনকি নজরুলের চিঠিও কলকাতায় পোস্ট করার আগেই সরিয়ে ফেলতেন। বিয়ের প্রায় কিছুদিন আগে নজরুল এই ঘটনা গুলো জানতে পারেন। নার্গিসের দ্বিতীয় স্বামী কবি আজিজুল হাকিম পরবর্তিতে সেই চিঠি গুলো জনসম্মুখে প্রকাশ করেন।
১৩২৮ বঙ্গাব্দের ৩ আষাঢ় শুক্রবার কবির সাথে নার্গিসের বিয়ের দিন ধার্য হয়। সেদিন বিয়ের আকদ্‌ সম্পন্ন হলেও (কিছু ঐতিহাসিক দ্বিমত পোষণ করেন)কবিকে ঘর জামাই থাকার শর্ত নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়। নজরুল বাসর সম্পন্ন না করেই নার্গিসকে ছেড়ে দৌলতপুর ত্যাগ করেন। এরপর নজরুলের সাথে নার্গিসের দেখা হয় ১৫ বছর পরে। তখন তাদের আনুষ্ঠানিক বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। কবি আজিজুল হাকিমের সাথে নার্গিসের দ্বিতীয় বিয়ে সম্পন্ন হয়। ১৯২১ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত এই একটি পল্লী কিশোরীর নাম ছিল কলকাতার  সাহিত্যিক সমাজে এক বহুনন্দিত নাম। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় তার বন্ধুসুলভ  মস্করার সঙ্গে লিখলেন_'সে তো দৌলৎপুরের দৌলৎ'। মোহাম্মদী পত্রিকায় এইটুকু  বালিকার বিয়ের খবর ছাপা হলো। মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী সেই বালিকাকে সম্বোধন  করলেন 'দৌলৎপুরের দৌলৎখানার শাহজাদী'। সাংবাদিক আবদুল গফুর জালালী  লিখলেন_'ধন্য দৌলৎপুরের দৌলৎখানা'। এমন হাজারো প্রণাম বাক্য এই বালিকার  চরণ চুমিল।
৫ )  এই সালটি অর্থাৎ ১৯২১ সালটি আরো একটি কারণে স্মরণীয় হয়ে আছে । 'বিদ্রোহী' কবিতার জন্ম ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে কোনো এক গভীর রাতে। লণ্ঠনের আলোয়  ৩/৪ সি তালতলা লেন, কলকাতার আঁতুরঘরে  'বিদ্রোহী' কবিতার জন্ম হলো একটি কাগজে পেন্সিলে লিখে।
কি অপূর্ব শব্দের ঝংকার!! যেন রবিশঙ্করের আশাবরী রাগে সেতারের সুরের মুর্ছনায় কবিতায় প্রান সঞ্চারিত হলো।
প্রথম শ্রোতা অবিভক্ত ভারতের মাটিতে কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ।
তাঁর প্রধান সঙ্গী ও ৩/৪ সি তালতলা লেনের দোতলা বাড়িতে একতলার সহ ভাড়াটে কাজী নজরুল। সকাল বেলায় ঘুম ভাঙতেই নজরুল তাঁকে এই 'বিদ্রোহী' কবিতাটি পড়ে শোনালেন।
‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রথম ছাপা হয়েছিল ‘বিজলী’ নামক সাপ্তাহিক কাগজে।
নজরুলের মানসিক অবস্থা তখন এমন ছিল যে  শাসকদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ তীব্র হয়ে ওঠে ।বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে নজরুল ইসলাম  কাল বৈশাখীর প্রলয়ংকর ঝড়ের মতো আকস্মিক আবির্ভাব। এ প্রতিভা ক্ষণপ্রভার মতো, এর প্রভাব বজ্রবিদ্যুতের মতো, এর ধ্বনি কখনো মন্দ্র, কখনো নির্ঘোষ।
ভারতের শৃঙ্খলমুক্তি সংগ্রামের তখন চলছে নবপর্যায় অসহযোগ আন্দোলন। ১৯১৯-এ ইংরেজ জালিয়ানওয়ালাবাগে হত্যা করেছে সংখ্যাহীন নর-নারী-শিশু; ইংরেজের সেই বর্বরতার প্রতিবাদে আমাদের মহাকবি (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) ঘৃণাভরে বর্জন করেছেন ইংরেজ দত্ত নাইট হুড্। ঠিক সেই সময়ে বাঙালির হাতে তুলে দিলেন ‘অগ্নি-বীণা’ কাজী নজরুল ইসলাম। রক্তে দোলা জাগানিয়া ‘বল বীর.. চীর উন্নত মম শির।'
‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশিত হবার সাথে সাথেই তিনি বাঙালিকে চমকে দিয়েছিলেন, মাতিয়ে তুলেছিলেন।
বলতে গেলে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশকাল থেকেই বাংলা সাহিত্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন।
‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি নজরুলের ভাবোচ্ছ্বাসের তীব্র অভিব্যক্তি, শাসকদের বিরুদ্ধে কবির রোষাগ্নির দীপ্ত প্রকাশ ছাড়া কিছু নয়।কবিতাটিতে বিশ্বস্রষ্টার বিরুদ্ধে কবির বিদ্রোহী মনোভাবের পরিচয় রয়েছে।লাঞ্ছিত মানুষের প্রতি অপরিসীম দরদ ও সহানুভূতির জন্য এই কবিতায় তাদের পক্ষ নিয়ে সর্বপ্রকার নিপীড়নের অবসানের জন্য বিদ্রোহীরূপে আত্মপ্রকাশ করেছেন কবি নজরুল। কবিতার প্রতিটি পঙক্তি যেন শরীরের রক্ত শুদ্ধ করে আওয়াজ তোলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, বিদ্রোহের দামামা বাজায় প্রতি মুহূর্তে।
"আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণি
আমি পথ-সম্মুখে যাহা পাই; যাই চূর্ণি
আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ
আমি আপনার তালে নেচে যাই আমি মুক্ত জীবনানন্দ"


আর মাত্র তিন বছর পরে আমরা উদযাপন করবো বিদ্রোহী শতবার্ষিকী।


আজ শুভ জন্মদিনে তাই তোমাকে স্মরণ করি শ্রদ্ধাভরে ............


বিদ্রোহের দামামা বেজে উঠে ফুটলো রক্তরাগে;
তোমার আত্মদান সার্থক হলো চেতনার গুলবাগে।    
চিরযৌবনের প্রতীক তুমি কাজী নজরুল ইসলাম,
বাঁধন হারা মনের উচ্ছাসে তোমাকে করি সেলাম।