কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেল থেকে কবিকে হুগলির জেলে আনা হলো কোমরে দড়ি বেঁধে। জেলে ঢুকেই কবির চিৎকার,
” দে গরুর গা ধুইয়ে।’


বিদ্রোহের মন্ত্র নিয়ে ঝড়ো হাওয়ার মত আবির্ভাব হলেন নবজাগরণের নতুন তরুণ কবি কাজী নজরুল ইসলাম।জেলের অন্যান্য কয়েদীদের সাথে সবসময় হেসে-খেলে, আনন্দে-মেতে থাকতেন কবি।জেলের অন্যান্য বন্দিরা মেতে উঠলেন গানে, আবৃত্তিতে কবিকে কাছে পেয়ে।
চির বিদ্রোহীর সুর ভরা ছিল তাঁর প্রতিটি রক্তবিন্দুতে।এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড শুধু একটি কবিতার জন্যে?   কি ছিল সেই কবিতায় যে তাঁকে ভয় পেয়ে বিট্রিশরা তাঁকে জেলে বন্দি করে রাখলেন?
কবিতাটির নাম "আনন্দময়ীর আগমনে" :--

":আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূতি আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।
দেব –শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?
মাদীগুলোর আদি দোষ ঐ অহিংসা বোল নাকি-নাকি
খাঁড়ায় কেটে কর মা বিনাশ নপুংসকের প্রেমের ফাঁকি।
ঢাল তরবার, আন মা সমর, অমর হবার মন্ত্র শেখা,
মাদীগুলোয় কর মা পুরুষ, রক্ত দে মা রক্ত দেখা।"


গাইলেন শিকল পড়ে শিকল ভাঙার গান :-
"শিকল পরা ছল মোদের এ শিকল পরা ছল
এই শিকল পরেই শিকল তোদের করবো রে বিকল"

ধূমকেতু পত্রিকাকে আশীর্বাদ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,


কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু,
আয় চলে আয়রে ধূমকেতু।
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।


পত্রিকার ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২২ সংখ্যায় নজরুলের কবিতা আনন্দময়ীর আগমনে প্রকাশিত হয়। পত্রিকার উক্ত সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। একই বছরের ২৩ নভেম্বর তার যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং একই দিনে তাকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর তাকে কুমিল্লা থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ জানুয়ারি নজরুল বিচারাধীন বন্দী হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে এক জবানবন্দি প্রদান করেন।  
"আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দি এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত।... আমি কবি,আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। সেবাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যাদ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি-মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে...।"


সাহিত্যিক মর্যাদা লাভ করেছে এই জবানবন্দি।


বিচারের পর নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। নজরুলকে আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে যখন বন্দী জীবন কাটাচ্ছিলেন তখন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার "বসন্ত": গীতিনাট্য গ্রন্থটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। এতে নজরুল বিশেষ উল্লসিত হন। এই আনন্দে জেলে বসে লিখলেন
"আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে"