সম্প্রতি এই আসরে প্রকাশিত একটি কবিতাকে আমার চোখে অত্যন্ত অশ্লীল মনে হওয়াতে প্রতিবাদ করেছিলাম। বাংলা কবিতা কতৃপক্ষ ঐ কবিতাটিকে ব্যান করার সঙ্গে সঙ্গে আমার প্রতিবাদ ব্যান করলেন। পুরো ব্যাপারটা বিভ্রান্তিকর। কোনটাকে কতৃপক্ষ সমর্থন করলেন? কবির কবিতাটিকে না আমার প্রতিবাদকে? আংশিকভাবে খণ্ডিত, অপূর্ণ ও আধো অভিমত কোনো পেশাদারী লোকের অভিমতি হিসেবে অনুকূল ধারণা হিসেবে বিবেচনা করতে পারলাম না।


যাই হোক,  এবারে আসল কথায় আসি।  কবিতায় শ্লীলতা ও অশ্লীলতার মাপকাঠি কি ? একটা কবিতার ভাষা এমন হওয়া উচিত যাতে কবির ব্যক্তিত্ব, ব্যক্তিচরিত্র ও রুচির প্রতিফলন প্রকাশ পায়। সামাজিক মাপকাঠিতে শ্লীলতা বলে যদি কবিতাকে মনে না হয় তাহলে সেটা অবশ্যই অশ্লীল। আমার সে সচেনতা প্রকাশ পেয়েছে আমার প্রতিবাদের মধ্যে দিয়ে। সভ্যতা মানুষকে শিক্ষা দিয়েছে  শ্লীলতা বিষয়ক জ্ঞান।  পোশাকি নগ্নতার মানুষও মন-মননে পরম শ্লীল হতে পারে আবার বাহারি পরিপাটি পোশাকের ব্যক্তিও মনে-মননে চরম অশ্লীলতা বহন করে। তাই কেবল নগ্নতাই অশ্লীলতা নয়, আবার কেবল পোশাকাচ্ছাদনেই সম্পূর্ণ শ্লীলতা নয়। সাহিত্যের অশ্লীলতা কারও কারও নিকট শ্লীলতাতেও পর্যবসিত হতে পারে


আবার সকল কুশ্রীতাকে ম্লান করে জেগে ওঠে সুন্দর আর স্পর্শ পায় পরশাতীতের  ......


"দুঃখ পেয়েছি, দৈন্য ঘিরেছে ,অশ্লীল দিনে রাতে
দেখেছি কুশ্রীতারে ;
মানুষের প্রাণে বিষ মিশায়েছে মানুষ আপন হাতে ,
ঘটেছে তা বারে বারে"


রবীন্দ্রনাথের কথায়......
"কেন যামিনী না যেতে জাগালে না, বেলা হল মরি লাজে।"
রবীন্দ্রনাথ: এ যে ঘোরতর অশ্লীলতা!
এর মধ্যে অশ্লীলতার কি আছে ? -- প্রশ্ন মৈত্রেয়ী দেবীর
রবীন্দ্রনাথ: ওরে বাবা 'পাখি ডাকি বলে বিভাবরী বধূ চলে জলে লইয়া গাগরী"--এ যে ঘোরতর দুর্নীতি  


রবীন্দ্রনাথের 'শ্রেষ্ঠভিক্ষা' কবিতায় কয়েকটি লাইন ছিল
'ভিখারিনী তার একমাত্র বাস ফেলে দিলো
অরণ্য আড়ালে রহি কোনোমতে
একমাত্র বাস নিল গাত্র হতে
বাহুটি বাড়ায়ে ফেলি দিল পথে , ভূতলে '  


কবিতাটি যখন প্রকাশিত হয়েছিল এক পন্ডিত ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ কে বললেন "রবিবাবু এটা লেখা কি ঠিক হয়েছে ?ছেলেরা পড়বে আপনার কবিতা ,এর মধ্যে এ কথাটা 'একমাত্র বাস নিল গাত্র হতে ' ঠিক হবে কি "?


তখন এটা অশ্লীল মনে হলেও ধীরে ধীরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে মানসিকতা । আজ এই কবিতাটি কি অশ্লীল মনে হয় ? সামাজিক ন্যায়বোধ পরিবর্তনশীল। মানসিকতার প্রতিফলনে প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যায়বোধ।কবিতায় শ্লীল আর অশ্লীলের সীমা নির্ধারণ করাটা আমার মনে হয়না খুব একটা কঠিন ব্যাপার। তাছাড়া শ্লীল ও অশ্লীলের আপেক্ষিক অবস্থান নির্ণয় করার ক্ষেত্রেও রয়েছে বিস্তর মতানৈক্য।  আমরা পাঠকের নিজস্ব বিবেচনাবোধকেই আপাত মাপকাঠি ধরে সাহিত্যক্রিয়ায় রত থাকি। কবিতায় শ্লীলতা-অশ্লীলতার বিষয়টি কিঞ্চিৎ জটিল।  অশ্লীলতা হয়তোবা সাহিত্যে কোনো শিল্পমূল্য যোগ করতে পারে। আবার সাহিত্যের অশ্লীলতা কারও কারও নিকট শ্লীলতাতেও পর্যবসিত হতে পারে। কবিতায় অশ্লীলতার মধ্যেও শিল্প হয়ে ফুটতে পারে কুদরতী,কার্যক্ষম,কার্যকুশল শব্দের ব্যবহারে।


মহাকাব্য 'মেঘদূত' -এ বিরহী যক্ষ মেঘদূতের নিকট তার বিরহিনী প্রিয়ার দেহের বর্ণনা দিতে গিয়ে শারীরিক বর্ণনা দিয়েছেন খোলামেলা। কিন্তু যক্ষের এই বর্ণনায় যৌনতা কোথাও এতটুকু শ্লীলতা হারায়নি। বরং তার এই বর্ণনা যাত্রাপথের শিল্পরূপের সাথে বিরহিনী যক্ষপ্রিয়ার দেহরূপের অপূর্ব শিল্পমিলন রূপেই পরিস্ফুটিত হয়েছে।
আরব্য রজনীর গল্পে বর্ণিত কাহিনীগুলোতে যৌনতা উঠে এসেছে প্রাধান্য পেয়ে। কিন্তু কোনো যৌনতাই শেষমেষ অশ্লীলতায় রূপায়িত হয়নি। নজরুলের প্রবন্ধ 'তুর্ক মহিলার ঘোমটা খোলা'-এ তুর্কী রমণীদের রূপ-সৌন্দর্য তিনি বর্ণনা করেছেন শিল্প-সুষমা দিয়ে। কিন্তু কোনো বাক্যেই অশ্লীলতা ফুটে উঠেনি। বরং যৌনতা শিল্পের বাণী হয়ে ভাষাময় হয়ে উঠেছে।


উপসংহার :-
কবিতা জীবনের কথা বলে, বাস্তবের কথা বলে। তাই জীবনের সমুদয় বাস্তবতা কবিতায় ফুটে উঠে শিল্পিত হয়ে, নান্দনিক হয়ে। শিল্প আর নান্দনিকতার বাইরে যা কিছু আনীত হয় তা অশ্লীলতার নামান্তর।


টিকা:
আমার একটি কবিতা প্রকাশিত করলাম এখানে আপনাদের বিবেচনার জন্যে
অশ্লীল নয়
- প্রবীর চ্যাটার্জী(ভোরের পাখি)
ক্ষুদ্র মালা গেঁথে গেঁথে একজোড়া দুল,
কাঁধ অব্দি ঝোলানো।  
অনামিকায় ম্যাচ করা মুক্তো বসানো আংটি ;
পরিধানে সাদা ধবধবে শিফনের মহার্ঘ শাড়ি,
প্রায় কাচের মতো স্বচ্ছ।
সুস্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হালকা রঙের অন্তর্বাস;
ঘটি-হাতা ব্লাউজের মধ্য থেকে লম্বমান বিশীর্ণ বাহুদ্বয়;
গলায় মুক্তোর মালা।
'ভি' গলার সম্মুখভাগে মর্মান্তিকরূপে
উদ্ঘাটিত গ্রীবার দুই পার্শ্ববর্তি উদ্ধত দুটি কন্ঠা।  
আপন বেশভূষায় সম্পূর্ণ বিশিষ্টা।
যেন মরসুমি ফুলের বাগানে রজনীগন্ধার উদ্ধত বৃন্ত।


(কি মনে হচ্ছে কবিতাটি অশ্লীল না শ্লীল ?)-- প্রশ্নটা তোলা রইলো পাঠকদের কাছে !!