বিশ্বের কবিতা বিশেষজ্ঞরা মোটামুটিভাবে  প্রায় ৫১টি ধরনে ভাগ করেছেন কবিতাকে। তার মধ্যে আমি আজ কয়েকটির উল্লেখ করবো। কবিতায় আছে নানান রকমের শ্রেণিবিন্যাস। নির্মাণের রকমফেরে কবিতার শারীরিক গঠনে আসে বৈচিত্র্য। বেশি কথা না বলে কাজের কথায় আসি এবারে। চেষ্টা করে দেখছি বন্ধুরা। হয়তো ভালো লাগতে পারে আবার নাও লাগতে পারে। ভালো লাগলে দু কলম লিখলে আমার ভালো লাগবে আর ভালো না লাগলে কোনো কথা নেই।


কি দিয়ে শুরু করি ভাবছি। আচ্ছা শুরু করি আমার সবচেয়ে প্রিয় কবিকে দিয়ে । ভাবছেন নিশ্চয় জীবনানন্দ বা রবীগুরু বা নজরুল ইত্যাদি তাইতো ? না একটাও মিললো না। আমার সবচেয়ে প্রিয় কবি হচ্ছে 'মির্জা গালিব' আর তাঁর গজল কবিতা।তাই শুরু করি গজল কবিতা দিয়ে।
গজল:
উর্দুতে লেখা ছোট্ট গীতিকবিতা যাতে পাঁচ থেকে পনেরোটি দ্বিপদী স্তবক থাকে। প্রতি কবিতার আছে নিজস্ব ঘরানা। প্রত্যেক স্তবক সমান লম্বা হয়। সাধারণত প্রেম ও ভালোবাসাই হয় বিষয়বস্তু। শেষ স্তবকে গালিব সবসময় তাঁর নামের উল্লেখ করতেন।
গজল এক সময় একটা বিশেষ মহলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্ত সময়ের পরিক্রমায় গজলের সৌন্দর্য্য আচ্ছন্ন করছে বিপুল শ্রোতার মনকে। আরো একটু বললে বুঝতে সুবিধে হবে। ধরুন একটা শিকারী কুকুর বনের মধ্যে হরিনীকে তাড়া করছে – ভীত হরিন প্রানভয়ে পালাচ্ছে, হঠাৎ তার শিং বুনো ঝোপের মধ্যে আটকে গেল। নিজেকে মুক্ত করার আপ্রান চেষ্টা করেও যখন সে আর বের হতে পারছে না তখন হরিনীর কন্ঠস্বর থেকে আর্তনাদের মত যে আওয়াজ বের হয়ে আসবে সেটাই হল গজলের যথার্থ অভিব্যক্তি। এক তীব্র অসহায় বোধ, তীব্র কষ্টের অনুভূতি থেকে হয় গজল এর  জন্ম।  গজলের আভিধানিক অর্থ হল “প্রেমালাপ”।


রুবাইয়াৎ:-
অনেকে রুবাইয়াতের সঙ্গে গজলকে গুলিয়ে ফেলেন । রুবাই হলো একপ্রকার  কবিতা, যার মাধ্যমে মূলত স্রষ্টার স্তুতি বা জীবনের গভীর দর্শনকে ফুটিয়ে তোলা হয়। রুবাইয়াতের শ্রষ্ঠা ছিলেন ওমর খৈয়াম।  রুবাই হলো চার লাইনের কবিতা।  প্রথম, দ্বিতীয় ও চতুর্থ লাইন ছন্দবদ্ধ ও অন্তমিল থাকতে হবে , আর তৃতীয় লাইনে হয় ব্যতিক্রম। অর্থাৎ তৃতীয় লাইনটি সম্পূর্ণ স্বাধীন।কোনো অন্তমিল থাকবেনা।  উৎকৃষ্ট উদাহরন হতে পারে ওমর খৈয়ামের কালজয়ী গ্রন্থ 'রুবাইয়াত-ই-খৈয়াম' , যা আসলে একগুচ্ছ রুবাই এর সংকলন।আমাদের কাজী নজরুল এর থেকে প্রায় পঞ্চাশের ওপরে রুবাই সরাসরি অনুবাদ করেছেন।ওমর খৈয়ামের একটি অনুবাদ উল্লেখ করলাম ।
যৌবনের আগুন :
হায়, যৌবনের আগুন নিভে গেছে কোন সময়!
এই জীবনের রসদ পৌছে গেলো শেষ সীমায়;
নাহ! কখন যে সবই মুছে হলো ম্লান নীরবে ,
নেই অবশেষ; সবটা জুড়ে আছে স্মৃতি কথায়;


লক্ষ করে দেখুন প্রথম,দ্বিতীয় ও চতুর্থ লাইনে অন্তমিল আছে কিন্তু তৃতীয় লাইনে মিল নেই।


মুক্তগদ্য’ বা ‘ফ্রি-ভার্স’:-
১) এর কোনো প্যাটার্ন বা রূপকল্প থাকবে না, অর্থাৎ এটি হবে মুক্তকল্প।
২) এতে কোনো অন্তমিল থাকবে না, অর্থাৎ এটি হবে মুক্ত মিল।
৩) এতে কোনো ছন্দ থাকবে না, অর্থাৎ এটি হবে মুক্ত ছন্দ।


চমৎকার গদ্যে আপনি একটি অনবদ্য কবিতা লিখে ফেলতে পারেন; কবিতার ভাষায়ও একটা উৎকৃষ্ট গদ্য লিখে ফেলা সম্ভব।”


তাহলে গদ্য আর কবিতার মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
উত্তর ......
হয়ত পার্থক্য তেমন কিছু নেই । আবার আছেও। গদ্য একটা যুক্তিকাঠামো চায়, তা হয়ে উঠতে চায় পরিণতিময়। সুনির্দিষ্ট অর্থ আরোপ করতে চায় সে।
যেমন ধরুন নিদ্রা আর তন্দ্রায় যে পার্থক্য। শব্দ চয়নে আর ভাবের গভীরতায় পার্থক্য।


এপিথালামিয়াম :
শুভবিবাহ উপলক্ষ্যে বর ও কনের সম্মানে লেখা কবিতা।


এপিটাফ  :
কোনও মৃত ব্যক্তির স্মৃতিতে স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ কবিতায় শ্রদ্ধা নিবেদন। এপিটাফ কাগজেও মুদ্রিত হয়।


হোরাশিয়ান ওড :
ছোটো গীতি কবিতা। প্রতিটি স্তবকে দুই বা চার পংক্তি থাকে। পংক্তিগুলি একই মাত্রাবৃত্তে লেখা। কোনও বন্ধু, বন্ধুত্ব অথবা প্রেম বিষয়বস্তু হয়।


ইতালিয়ান সনেট :
চতুর্দশপদী কবিতা। প্রথম আটটি পংক্তি এক নির্দিষ্ট ছন্দে অস্ত্যমিল দিয়ে লেখা। পরবর্তী ছটি পংক্তির ছন্দ অন্যরকম।


হাইকু  :
জাপানি ভাষায় লেখা ছোট্ট কবিতা। অন্তমিল ছাড়া মাত্র তিনটি পংক্তি থাকে।


এলিজি :
দুঃখের ভাবাবেগের কবিতা। একজন প্রিয় মানুষের লোকাস্তর হলে লেখা হয়।


লিমেরিক  :
ছোট কবিতার এ ফর্মটি সাধারণত ৫ টি বিশিষ্ট চরণে গঠিত। ৩য় ও ৪র্থ পঙ্‌ক্তি ১ম, ২য় ও ৫ম এর চেয়ে মাপে ছোট হয়।  লিমেরিকের বক্তব্য অর্থবোধক হয় না। বাংলা লিমেরিকের উদাহরন –


তাতীর বাড়ি ব্যাঙের বাসা
কোলা ব্যাঙের ছা।
খায় দায়,
গান গায়,
তাইরে নাইরে না।


কবিতার কত রকমের শ্রেণিবিন্যাস।এতো কিছুই নয়।আরো কত আছে। যেমন অ্যাক্রোস্টিক, ব্যালাডে ,বারলেস্ক, সিনকোয়াইন,ড্রামাটিক মনোলগ ইত্যাদি।
  কবিতার এই যে বিভিন্ন ধরন বা রকমফের, তা নিয়ে আসরের কবিদের কাছ থেকে আরও তথ্য জানতে পারলে, ভালো লাগবে।


প্রীতি ও শুভেচ্ছান্তে .........................