স্মরণ করিয়ে দিই যে সেই মহান কবির মহান কবিতা "বিদ্রোহী"র আজ শততম জন্মবার্ষিকী।রবিতাপ যখন উচ্চশিখায় দাও দাও করে জ্বলছে , ১৮৯৯ সালে বাংলার আকাশে জন্ম নিলো এক ধ্রুবতারা। যে মহান ধ্রুবতারা আমাদের মতো পথহারাকে টেনে তুলে আনলেন, আর দিলেন  নতুন  কিরণধারা।
"তব মুখ সদা মনে    জাগিতেছে সংগোপনে,
     তিলেক অন্তর হলে না হেরি কূল-কিনারা।
কখনো বিপথে যদি  ভ্রমিতে চাহে এ হৃদি
     অমনি ও মুখ হেরি শরমে সে হয় সারা।"


সেই মহান ধ্রুবতারা হলেন কাজী নজরুল ইসলাম! বিদেশী শব্দের ব্যবহারে,বচনে, চয়নে আর উপস্থাপনায় অসাধারণ এক কবিতা নিবেদন করলেন।যে কবিতা পড়লে দুঃখ ভোলা যায়, যে কবিতা পড়লে মানসিক অবসাদ দূর হয়ে যায় আর নবচেতনার সৃষ্টি হয়,  সেই কবিতার নাম নজরুলের "বিদ্রোহী"। একাধারে গ্রিক পুরান আর অন্যদিকে হিন্দু পুরান এর অগাধ জ্ঞান না থাকলে এ কবিতার সৃষ্টি হতে পারে ? বিদেশী শব্দকে পোষ মানিয়ে কোনো লেখক এমনভাবে ভৃত্যের মতো জ্বলন্ত আগুনের ওপর ছন্দের তালে তালে বোররাক আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন করে অতিক্রম করতে পেরেছেন কি ? বাংলা ভাষাকে বিদেশী শব্দ দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন আর বিশ্বের দরবারে আমাদের এই প্রিয় ভাষাকে সুপ্রতিষ্ঠ করেছেন! প্রথম শ্রোতা অবিভক্ত ভারতের মাটিতে কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ।
তাঁর প্রধান সঙ্গী ও ৩/৪ সি তালতলা লেনের দোতলা বাড়িতে একতলার সহ ভাড়াটে কাজী নজরুল। সকাল বেলায় ঘুম ভাঙতেই নজরুল তাঁকে এই 'বিদ্রোহী' কবিতাটি পড়ে শোনালেন।
আজি হতে শতবর্ষ আগে
হে মহান নজরুল  
স্মরণ করেছিলে আমাদেরে
শত অনুরাগে,
আজি হতে শতবর্ষ আগে।


"বিদ্রোহী": কবিতা রচনা হয়েছিল ১৯২২ সালে ২৩সে ডিসেম্বরে।  তাঁর এই কবিতায় কোনো ভনিতা নেই,আছে শুধু  সাহসী উচ্চারণের দ্বারা মানব চেতনাকে জাগ্রত করার প্রয়াস ! আরবি , ফারসি, হিন্দি, তুর্কি শব্দ প্রয়োগে তাঁর দক্ষতা চমৎকার ভাবে কাজে লাগিয়েছেন এই কবিতায় ।কলকাতার তালতলা লেনের ৩/৪সি লেনের বাড়িটির কোন এক অন্ধকার ঘরে লন্ঠন জ্বালিয়ে কবি তাঁর চিন্তার ভ্রূণ কলমের কালির মধ্য দিয়ে সাদা পৃষ্ঠায় ঢেলে গিয়েছিলেন, বর্ণমালায় একে একে গেঁথে গিয়েছিলেন সাড়া-জাগানো এই কবিতা।‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশিত হবার সাথে সাথেই তিনি বাঙালিকে চমকে দিয়েছিলেন, মাতিয়ে তুলেছিলেন। বলতে গেলে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশকাল থেকেই বাংলা সাহিত্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি নজরুলের ভাবোচ্ছ্বাসের তীব্র অভিব্যক্তি, শাসকদের বিরুদ্ধে কবির রোষাগ্নির দীপ্ত প্রকাশ ছাড়া কিছু নয়।কবিতাটিতে বিশ্বস্রষ্টার বিরুদ্ধে কবির বিদ্রোহী মনোভাবের পরিচয় রয়েছে।লাঞ্ছিত মানুষের প্রতি অপরিসীম দরদ ও সহানুভূতির জন্য এই কবিতায় তাদের পক্ষ নিয়ে সর্বপ্রকার নিপীড়নের অবসানের জন্য বিদ্রোহীরূপে আত্মপ্রকাশ করেছেন কবি নজরুল। কবিতার প্রতিটি পঙক্তি যেন শরীরের রক্ত শুদ্ধ করে আওয়াজ তোলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, বিদ্রোহের দামামা বাজায় প্রতি মুহূর্তে।‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রথম ছাপা হয়েছিল ‘বিজলী’ নামক সাপ্তাহিক কাগজে।
নজরুলের মানসিক অবস্থা তখন এমন ছিল যে  শাসকদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ তীব্র হয়ে ওঠে ।বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে নজরুল ইসলাম  কাল বৈশাখীর প্রলয়ংকর ঝড়ের মতো আকস্মিক আবির্ভাব। এ প্রতিভা ক্ষণপ্রভার মতো, এর প্রভাব বজ্রবিদ্যুতের মতো, এর ধ্বনি কখনো মন্দ্র, কখনো নির্ঘোষ।
ভারতের শৃঙ্খলমুক্তি সংগ্রামের তখন চলছে নবপর্যায় অসহযোগ আন্দোলন। ১৯১৯-এ ইংরেজ জালিয়ানওয়ালাবাগে হত্যা করেছে সংখ্যাহীন নর-নারী-শিশু; ইংরেজের সেই বর্বরতার প্রতিবাদে আমাদের মহাকবি (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) ঘৃণাভরে বর্জন করেছেন ইংরেজ দত্ত নাইট হুড্। ঠিক সেই সময়ে বাঙালির হাতে তুলে দিলেন ‘অগ্নি-বীণা’ কাজী নজরুল ইসলাম। রক্তে দোলা জাগানিয়া ‘বল বীর.. চীর উন্নত মম শির।'
এই কবিতাটির ধারে কাছেও কোনো বাংলা কবিতা জন্ম নেয় নি। আপনি হয়ত প্রশ্ন কোরবেন  'কেন কবিগুরুর "নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ" কিসে কম ?
মানলাম কিন্তু সেই শ্বব্দঝংকার?
রবীন্দ্রনাথ :
ওরে উথলি উঠিছে বারি
ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ
রুধিয়া রাখিতে নারি।
নজরুল :
আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি একি উন্মাদ আমি উন্মাদ
আমি সহসা আমারে চিনেছি
আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ।


হৃদয় কে স্পর্শ করলো রবীন্দ্রনাথ,
চেতনাকে স্পর্শ করলো নজরুল ।


কবিগুরু :
থরথর করি কাঁপিছে ভূধর,
শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসে,
ফুলিয়া ফুলিয়া ফেনিল সলিল
গরজি উঠিছে দারুন রোষে।
নজরুল :
আমি প্রভঞ্জনের উল্লাস,
আমি বারিধির মহাকল্লোল,.....
আমি উচ্ছল জল-ছল ছল,
চল-উর্মির হিন্দোল দোল!!


হৃদয় আর চেতনার যুগলবন্দী !!


আসুন এই মহান কবির এই মহান কবিতার জন্মশতবার্ষিকী শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি!!