হ্যাঁ, পরপর দুজন অতি প্রিয়জনের মৃত্যু সুকান্তকে করে দেয় নিঃসঙ্গ। আর সেই দুজন প্রিয়জন ছিলেন সুকান্তের জীবনে দুই নারী। প্রথম নারী হলেন তাঁর মাতা সুনীতি দেবী আর দ্বিতীয় নারী ছিলেন তাঁর প্রাণের রানুদি।  সুকান্তের সবচেয়ে কাছের নারী ছিলেন এই জেঠতুতো দিদি রানুদি। ছোট্ট সুকান্তকে গল্প-কবিতা শুনিয়ে তাকে সাহিত্যের প্রথম ছোঁয়া টি তিনিই দেন সুকান্তকে। তিনিই দিয়েছিলেন তাঁর নাম "সুকান্ত"। আর এই নামটি তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মণীন্দ্রলাল বসুর ‘সুকান্ত’ গল্পটি পড়ে। সুকান্ত তখন খুবই ছোট, যখন রানুদি মারা গেলেন। এই তাঁর জীবনে প্রথম ধাক্কা। তার কিছুদিন পরেই মাতৃবিয়োগ। হয়ে গেলেন কেমন নিঃসঙ্গ ও নিভৃত।কবিতাকেই  বেছে নিয়েছিলেন তার একাকীত্বের সঙ্গী হিসেবে। পিতার নাম নিবারন ভট্টাচার্য ।পিতার ছিল একটি লাইব্রেরি। সারস্বত লাইব্রেরীর স্বত্বাধিকারী ছিলেন তিনি। লাইব্রেরির সঙ্গে চলতো বইয়ের প্রকাশনা ও বিক্রয়কেন্দ্র। সুকান্ত জন্মেছিলেন ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট, ৪৩, মহিম হালদার স্ট্রীট, কালীঘাট, কলকাতায়।  বিত্তের দিক দিয়ে সচ্ছলতা তাদের গৃহে কখনো আসেনি। সুকান্ত তার ভাইদের মধ্যে ছিলেন দ্বিতীয়।  অন্যরা হলেন মনমোহন, সুশীল, প্রশান্ত, বিভাস, অশোক ও অমিয়। সুকান্ত তার বড় ভাই মনমোহন ভট্টাচার্য ও বৌদি সরযূ দেবীর সঙ্গেও খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
কলকাতার বাগবাজারে কমলা বিদ্যামন্দিরে তাঁর শিক্ষারম্ভ।  প্রথম ছোটগল্প ছাপা হয় বিদ্যালয়েরই একটি পত্রিকা- ‘সঞ্চয়’ এ। সুকান্তের লেখা ছাপা হতো শিখা নামক একটি পত্রিকাতে নিয়মিতভাবে।
চারপাশের নিপীড়িত মানুষকে নিয়ে সুকান্তের যে প্রত্যক্ষ উপলব্ধি ছিলো, তাই তিনি ঢেলে দিতেন উজাড় করে তাঁর কলমের উত্তপ্ত শিখায়।বাঁধাধরা স্কুল শিক্ষায় তিনি কোনোদিনই মন দিতে পারেন নি। জীবনের প্রতিপদে অনিয়মকে তার নিয়ম করে নিয়েছিলেন।পার্টির কাজ,কলমযুদ্ধ, অভাব অনটন।  সব মিলিয়ে অনিয়মের স্রোত শরীরে যক্ষ্মারোগ বাসা বাঁধতে শুরু করে।  নিজেকে রক্ষার জন্য কারো কাছে কোনোদিন হাত পাতেননি। যে নিজেকেই মানবতার, আর্তের রক্ষক নিযুক্ত করেছে তাকে রক্ষা করার ক্ষমতা কারো আছে কি ?  তাই সুকান্ত তার জীবনাঙ্কের সবটুকু আমাদের দিয়ে যেতে পারেননি। কবিতা কী করে গদ্যের চেয়েও বেশি সত্য হয়ে ওঠে, বেশি শক্তিশালী হতে পারে সুকান্ত  তা বারবারই দেখিয়ে দিয়েছেন তার মূর্তমান কবিতায়।
"আমি যেন সেই বাতিওয়ালা,
যে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে,
অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য,
নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার।"


ক্ষুধার অনুভূতি যে কত তীব্র হয়,দারিদ্রের নির্মম কষাঘাত মানুষের মন,হৃদয়, সৌন্দর্যকে, প্রেম ও ভালোবাসার নান্দনিক বোধগুলোকে কিভাবে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে দেয় তা তিনি ফুটিয়ে তুললেন...............
"হে মহাজীবন, আর এ কাব্য নয়
এবার কঠিন, কঠোর গদ্যে আনো,
পদ-লালিত্য-ঝঙ্কার মুছে যাক,
গদ্যের কড়া হাতুড়িকে আজ হানো ।
প্রয়োজন নেই, কবিতার স্নিগ্ধতা,
কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী-গদ্যময়:
পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি ।"


রাত্রির বাঁধা উপেক্ষা করে যারা কোণায় কোণায় ডাক পৌঁছে দিত, সেসব ডাক-হরকরার সংগ্রামী জীবন নিয়ে লেখা সুকান্তের কবিতা 'রানার' ....
রাতের পর রাত ক্লান্তিহীন মানুষের সুখ দুঃখের
খবরের বোঝা বয়ে সে পৌছে দেয় দোরে দোরে
কিন্তু তার খবর কে রাখে?


'রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘন্টা বাজছে রাতে
রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে,
রানার রানার চলেছে,রানার!
রাত্রির পথে পথে চলে কোন নিষেধ জানে না মানার।
দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে রানার, রানার
কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার।'


উপসংহার:--


শেষ করার আগে সুকান্তের দুটো লাইন নবীন কবিদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই .....


"দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে লিখি কথা।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার স্বাধীনতা।"


সুকান্তের ওপরের এই দুটো লাইন নবীন কবিদের কাছে টনিকের মতো কাজ করে। তাই বাংলা কবিতা ডট কম কে মুক্তাঙ্গন ভেবে ভালো ভালো কবিতা লিখুন। যা মনে এলো লিখে স্বাধীনতার অপব্যবহার করবেন না । যা খুশি লিখে ক্লিক না করে মানসম্মত কবিতা লেখার প্রয়াস অব্যাহত রাখুন । দেখবেন নিজেরই কত ভালো লাগবে ।


সবাইকে জানাই প্রীতি,শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।