বাংলা সাহিত্যে স্হিতাবস্হা ভাঙার আওআজ তুলে, ইশতাহার প্রকাশের মাধ্যমে, শিল্প ও সাহিত্যের যে একমাত্র আন্দোলন হয়েছে, তার নাম হাংরি আন্দোলন |হাংরি আন্দোলনকারীরা হাংরি শব্দটি আহরণ করেছিলেন ইংরেজি ভাষার কবি জিওফ্রে চসারের ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম বাক্যটি থেকে , অর্থাৎ দেশভাগোত্তর বাঙালির কালখণ্ডটিকে তাঁরা হাংরিরূপে চিহ্ণিত করতে চাইলেন । তাত্তিক ভিত্তি সংগ্রহ করা হয়েছিল সমাজতাত্ত্বিক অসওয়াল্ড স্পেংলারের দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েস্ট গ্রন্হটির দর্শন থেকে । স্পেংলার বলেছিলেন, একটি সংস্কৃতি কেবল সরলরেখা বরাবর যায় না; তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয় । ১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা শহর থেকে একটি ইশতাহার প্রকাশের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন সমীর রায়চৌধুরী(মলয় রায়চৌধুরীর বড় ভাই ), মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং হারাধন ধাড়া ওরফে দেবী রায় | আন্দোলনের প্রভাবটি ব্যাপক ও গভীর হলেও, ১৯৬৫ সালে প্রকৃত অর্থে হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে যায় ।


প্রথম পর্বে আমি এই আন্দোলনের প্রথম ইশতাহার টি প্রকাশ করলাম | এই ইশতাহার টি অবশ্য ইংরাজি তে ছাপা হয়েছিল |
কারণ সমীরবাবু এবং মলয়বাবু  তখন থাকতেন পাটনা তে | ওখানে তখন বাংলা ছাপাখানা পাওয়া যায়নি | এটি তার বাংলা অনুবাদ |


কবিতা বিষয়ক প্রথম বাংলা ইশতাহার (নভেমবর ১৯৬১)' ।


কবিতা এখন জীবনের বৈপরীত্যে আত্মস্হ । সে আর জীবনের সামঞ্জস্যকারক নয় , অতিপ্রজ অন্ধবল্মীক নয়, নিরলস যুক্তিগ্রন্হন নয় । এখন, এই সময়ে, অনিবার্য গভীরতার সন্ত্রস্তদৃক ক্ষুধায় মানবিক প্রয়োজন এমনভাবে আবির্ভূত যে, জীবনের কোনো অর্থ বের প্রয়োজন শেষ । এখন প্রয়োজন অনর্থ বের করা, প্রয়োজন মেরুবিপর্যয়, প্রয়োজন নৈরাত্মসিদ্ধি । প্রগুক্ত ক্ষুধা কেবল পৃথিবী বিরোধিতার নয়, তা মানবিক, দৈহিক এবং শারীরিক । এ ক্ষুধার একমাত্র লালনকর্তা কবিতা, কারণ কবিতা ব্যতীত কী আছে আর জীবনে । মানুষ, ঈশ্বর, গণতন্ত্র এবং বিজ্ঞান পরাজিত হয়ে গেছে । কবিতা এখন একমাত্র আশ্রয় ।


কবিতা থাকা সত্ত্বেও, অসহ্য মানবজীবনের সমস্তপ্রকার অসম্বদ্ধতা । অন্তর জগতের নিষ্ঠুর বিদ্রোহে, অন্তরাত্মার নিদারুণ বিরক্তিতে, রক্তের প্রতিটি বিন্দুতে রচিত হয় কবিতা । উঃ, তবধ মানবজীবন কেনএমন নিষ্প্রভ । হয়তো, কবিতা এবং জীবনকে ভিন্নভাবে দেখতে যাঁরা অভ্যস্ত তাঁদের অপ্রয়োজনীয় অস্তিত্ব এই সঙ্কটের নিয়ন্ত্রক ।


কবিতা বলে যাকে আমরা মনে করি, জীবনের থেকে মৌহমুক্তির প্রতি ভয়ংকর আকর্ষণের ফলাফল তা কেবল নয় । ফর্মের খঙাচায় বিশ্বপ্রকৃতির ফাঁদ পেতে রাখাকে আর কবিতা বলা হয় না । এমনকি প্রত্যাখ্যাত পৃথিবী থেকে পরিত্রাণের পথরূপেও কবিতার ব্যবহার এখন হাস্যকর । ইচ্ছে করে, সচেতনতায়, সম্পুর্ণরূপে আরণ্যকতারবর্বরতার মথ্যে মুক্ত কাব্যিক প্রজ্ঞার নিষ্ঠুরতার দাবির কাছে আত্মসমর্পণই কবিতা । সমস্ত প্রকার নিষিদ্ধতার মথ্যে তাই পাওয়া যাবে অন্তরজগতের গুপ্তধন । কেবল, কেবল কবিতা থাকবে আত্মায় ।


ছন্দে গদ্য লেখার খেলাকে কবিতা নাম দিয়ে চালাবার খেলা এবার শেষ হওয়া প্রয়োজন । টেবলল্যাম্প ও সিগারেট জ্বালিয়ে, সেরিব্রাল কর্টেক্সে কলম ডুবিয়ে, কবিতা বানাবার কাল শেষ হয়ে গেছে । এখন কবিতা রচিত হয় অরগ্যাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্তিতে । সেহেতু ত্রশ্নূ বলাৎকারের পরমুহূর্তে কিংবা বিষ খেয়ে অথবা জলে ডুবে 'সচেতনভাবে বিহ্বল' হলেই, এখন কবিতা সৃষ্টি সম্ভব । শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কবিতা সৃষ্টির প্রথম শর্ত । শখ করে, ভেবে-ভেবে, ছন্দে গদ্য লেখা হয়তো সম্ভব, কিন্তূ কবিতা রচনা তেমন করে কোনো দিনই সম্ভব নয় । অর্থব্যঞ্জনাঘন হোক অথবা ধ্বনিপারম্পর্ষে শ্রুতিমধুর, বিক্ষুব্ধ প্রবল চঞ্চল অন্তরাত্মার ও বহিরাত্মার ক্ষুধা নিবৃত্তিরশক্তি না থাকলে, কবিতা সতীর মতো চরিত্রহীনা, প্রিয়তমার মতো যোনিহীনা, ঈশ্বরীর মতৌ অনুন্মেষিণী হয়ে যেতে পারে ।