হাংরি আন্দোলন নিয়ে প্রথম পর্যায়ে কিছু আলোচনা করেছিলাম | এই পর্যায়ে আরো কিছু বিস্তারিত প্রকাশ করলাম |


হাংরি আন্দোলনকারিরা প্রধানত একপৃষ্ঠার বুলেটিন প্রকাশ করতেন । এক পাতার বুলেটিনে তঁরা কবিতা, রাজনীতি, ধর্ম, অশ্লীলতা, জীবন, ছোটগল্প, নাটক, উদ্দেশ্য, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে ইশতাহার লেখা ছাড়াও, কবিতা, গদ্য, অনুগল্প, স্কেচ ইত্যাদি প্রকাশ করেছিলেন । বুলেটিনগুলো হ্যান্ডবিলের মতন কলকাতার কলেজ স্টিট কফি হাউস, পত্রিকা দপতর, কলেজগুলোর বাংলা বিভাগ ও লাইব্রেরি ইত্যাদিতে তাঁরা বিতরন করতেন । হাংরি আন্দোলনের কথা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার এইটি-ই প্রধান কারণ বলে মনে করেন গবেষকরা । কিন্তু হ্যান্ডবিলের মতন প্রকাশ করায় তাঁরা এতি হাসিক ক্ষতি করেছেন নিজেদের, কেন না অধিকাংশ বুলেটিন সংরক্ষণ করা সংগ্রাহকদের পক্ষেও সম্ভব হয়নি । কলকাতার লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণাকেন্দ্র বহু চেষ্টায় গোটা দশেক সংগ্রহ করতে পেরেছেন । ঢাকা বাংলা একাডেমিও কয়েকটি সঙগ্রহ করতে পেরেছেন । ১৯৬৩-৬৫ সালের মাঝে হাংরি আন্দোলনকারীরা কয়েকটি পত্রিকাও প্রকাশ করেছিলেন । সেগুলো হল, সুবিমল বসাক সম্পাদিত প্রতিদ্বন্দ্বী, ত্রিদিব মিত্র সম্পাদিত উন্মার্গ, মলয় রায়চৌধুরী সম্পাদিত জেব্রা, দেবী রায় সম্পাদিত চিহ্ণ, প্রদীপ চৌধুরী সম্পাদিত ফুঃ সতীন্দ্র ভৌমিক সম্পাদিত এষণা, এবং আলো মিত্র সম্পাদিত ইংরেজি দি ওয়েস্ট পেপার । পত্রিকাগুলোর প্রতিটি সংখ্যা সংরক্ষণের প্রয়াস করার প্রয়োকন, মনে হয়, তাঁরা করেননি । কলকাতার লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি মাত্র কয়েকটি সংখ্যা সংগ্রহ করতে পেরেছে । বিট আন্দোলনের কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ কলকাতায় থাকাকালীন ইংরেজি বুলেটিনগুলো সংগ্রহ করে স্ট্যনফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করে গেছেন বলে বিদেশী গবেষকদের সৌজন্যে এগুলোর অবস্হান জানা যায় ।


১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে ১১ জন হাংরি আন্দোলনকারীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হবেছিল । তাঁরা হলেন: সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, দেবী রায় , সুভাষ ঘোষ , শৈলেশ্বর ঘোষ , প্রদীপ চৌধুরী, উৎপলকুমার বসু, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবো আচার্য এবং সুবিমল বসাক । এঁদের মধ্যে প্রথম ছয়জনকে গ্রেপতার করা হয় এবং কলকাতার ব্যাংকশাল কোর্টে তোলা হয় । মলয় রায়চৌধুরীকে হাতে হাতকড়া এবং কোমরে দড়ি বঁধে রাস্তায় হঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হব চোর-ডাকাতদের সঙ্গে । মকদ্দমার ফলে উৎপলকুমার বসু অধ্যাপনার চাকরি থেকে বরখাস্ত হন, প্রদীপ চৌধুরী রাসটিকেট হন বিশ্বভারতী থেকে, সমীর রায়চৌধুরী সরকারি চাকরি থেকে সাসপেন্ড হন, সুবিমল বসাক ও দেবী রায়কে কলকাতার বাইরে বদলি করে দেয়া হয়, সুবো আচার্য ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ফেরার হয়ে যান । অনেকে হাংরি আন্দোলন ভয়ে ত্যাগ করেন । লালবাজারের কনফারেন্স রুমে মলয় রায়চৌধুরী এবং সমীর রায়চৌধুরীকে জেরা করেন একটি ইনভেসটিগেটিং টীম | গ্রেপতারের সময়ে প্রত্যেকের বাড়ি লণ্ড-ভণ্ড করা হয়েছিল ।


হাংরি মোকদ্দমা


হারি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা দায়ের হয় ১৯৬৪ সালে এবং তা চলে ৩৫ মাস, অর্থাৎ ১৯৬৭ পর্যন্ত । চার্যশীট দেয়া হয় মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে তাঁর "প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার"কবিতাটির জন্য ; বাদবাকি সবাইকে রেহাই দেয়া হয় । নিম্ন আদালতে সাজা হলেও, তিনি উচ্চ আদালতে মামলা জিতে যান । কিন্তু মোকদ্দমাটির কারণে তাঁদের খ্যাতি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। সুবিমল বসাকের হিন্দি ভাষায় দখল থাকায় ভারতের অন্যান্য ভাষার সংবাদপত্র ও পত্রিকায় তাঁদের রচনা ও কাজকর্ম নিয়ে প্রচুর বিতর্ক তাঁদের প্রচারের আলোয় নিয়ে আসে। হাংরি আন্দোলনকারীরা তা-ই চাইছিলেন। পশ্চিম বাংলার ট্যাবলয়েডগুলোতে তাঁদের নিয়ে রসালো সংবাদ, এমনকি দৈনিক যুগান্তর, আনন্দবাজার ও স্টেতসম্যান পত্রিকায় দেবী রায় ও মলয় রায়চৌধুরীর কার্টুন প্রকাশিত হয়েছিল । আমেরিকার টাইম পত্রিকায় ( নভেমবর ১৯৬৪) তাঁদের ফোটো এবং সংবাদ প্রকাশিত হবার ফলে ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার পত্রপত্রিকা তাঁদের সংবাদ ও রচনা প্রকাশ করার জন্য কলকাতায় প্রতিনিধি পাঠায় । ভারতবর্ষে তাঁরা সমর্থন পেয়ে যান প্রতিষ্ঠিত লেখকদের। সাময়িক দুর্ভোগ হলেও হাংরি মকদ্দমা তাঁদের সাপে বর হয় । অনিল করনজাই ললিতকলা একাডেমীর পুরস্কার পান। অমেরিকা ও ইউরোপে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন বিশেষ হাংরি আন্দোলন সংখ্যা প্রকাশ করেছিল যা ওই বয়সের কবিলেখকদের জন্য নিঃসন্দেহে আকল্পনীয়। কলকাতায় এই ধরণের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল: "ইহা কি বেহুদা পাগলামি?" , "দেবদূতেরা কি ভয়ংকর" , "সাহিত্যে বিটলেমি কী এবং কেন?" "কাব্যচর্চার নামে বিকৃত যৌনলালসা"