ভূমিকা :-
'একুশে' একটি ম্যাজিক শব্দ। প্রতিটি বাঙালির মননে ও চেতনাতে যেন নতুন করে শিহরণ জাগিয়ে নতুন করে পথ প্রদর্শকের ভূমিকা নেয়। এই শব্দে জড়িয়ে আছে জাদুর ছোঁয়া। যে একুশে শব্দটির জন্যে এতগুলো প্রাণ অবহেলায় ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে , সেই শব্দ বুকের মধ্যে মোচড় দেয়।সেই বহু আকাঙ্খিত শব্দটি উদাত্ত পবিত্র ধ্বনি তুলে জীবন্ত গুলির শব্দ হয়ে আমাদের চেতনাকে বিদ্ধ করে।এই শঙ্খ-শুভ্র শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেই রক্ত রাঙানো দিনটি, জড়িয়ে আছে লজ্জা, কান্না ও অপমান জড়ানো শেকলপড়ানো কালো শব্দ "মাতৃভাষার পরাধীনতা" । এই শব্দে জড়িয়ে আছে মূর্ত হাহাকার, ধ্বস্ত মনুষ্যত্বের রক্তাক্ত প্রতীক, রক্তাক্ত  হয়ে ছিটিয়ে পড়েছে চৈতন্যের চতুর্দিকে। প্রতিবাদী ভূমিকায় উজ্জ্বল এই দিনটি তাই হয়ে গেলো আন্তর্জাতিক। শুধু সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের অস্ত্র হিসেবে আমরা এই দিনটিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। বাংলাদেশ ও দুনিয়ার তাবদ বাঙালিদের একটি গৌরবোজ্জ্বল ও স্মৃতিবিজড়িত এই একুশে ফেব্রুয়ারি।


পেক্ষাপট :-
একটু পিছনে ফিরে দেখা যাক। ভাষা চেতনার উন্মেষ ঘটে ঢাকায় ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে। ১৯৪৭ সালে করাচিতে জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনে শুধুমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ব্যবহার করার প্রস্তাব আনা হয়। এমনকি পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন অনুমোদিত বিষয় তালিকা থেকে বাংলাকে বাদ দেয়া হয়। মুদ্রার নোট ও স্ট্যাম্প থেকে বাংলা মুছে ফেলা হয়। এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদের একটা বড়ো অংশ ১৯৪৭ সালের ৮ঐ ডিসেম্বর জমায়েত হয়। এইখানে যাত্রা হলো শুরু। প্রথম বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে দাবি তুলে তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্টাতা আব্দুল কাসেম এর নেতৃত্বে মিছিল বার করা হয়।এই আব্দুল কাসেম ছিলেন একজন বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ, লেখক, সমাজসেবক এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ। তাঁকে বলা যেতে পারে বাংলা ভাষা আন্দোলনের স্থপতি।


প্রতিবাদ ও নবজাগরণের শুরু:-


সময় সকল ৯ টা। 1952 সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়াম মাঠের পাশে ছাত্ররা জমায়েত হতে শুরু করেছে । ক্যাম্পাসের ভিতরে সশস্ত্র পুলিশ । তরুণ বাঙালি ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে ।সকাল এগারোটা নাগাদ পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের দিকে মিছিল শুরু হতেই গর্জে ওঠে পুলিশের গুলি। সঙ্গে তুমুল লাঠি চার্জ। লুটিয়ে পরলো এক এক করে তাজা প্রাণগুলো। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারীতে বিনা উসকানিতে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন রফিক উদ্দিন, আবদুল জব্বার, আবুল বরকত।   তবে শহীদদের তালিকায় রফিকের নাম সবসময় আগে থাকে।এছাড়া একুশে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশের গুলিতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কতজন ছাত্র ও জনতা প্রাণ দিয়েছিলেন এটা আমাদের অজানাই থেকে যাবে।


আসুন জেনে নিই কিছু অজানা তথ্য :-----


২১ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৩টায় পুলিশের গুলিবর্ষণের অব্যবহিত পরেই সশস্ত্র পুলিশের দল রাস্তার পাশে পড়ে থাকা গুটিকয়েক লাশ তাদের ভ্যানে করে সরিয়ে নিয়ে যায়। সে সময় রাস্তার প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে সে রূপ জবানবন্দি পাওয়া গেছে। পরবর্তীতে এদের কাছে মতামত নিয়ে জানা গেছে, আহতদের সংখ্যা ন্যূনতম পক্ষে প্রায় ১০০ জন হবে। এ ছাড়াও ২১ ফেব্রুয়ারি দিবাগত গভীর রাতে সেসব সশস্ত্র পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর সদস্যরা একযোগে হামলা চালিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের হাসপাতাল মর্গে থেকে শহীদদের বেশ কয়েকটি লাশ সরিয়ে নিয়েছিল। সে জন্য বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মৃতের সঠিক সংখ্যা বলা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার।এ ছাড়াও গুলিবর্ষণে আহতদের মধ্যে অপারেশন থিয়েটার এবং হাসপাতালে পরবর্তীতে যারা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন তাদেরও সঠিক হিসাব সংগৃহীত হয়নি বলা চলে। বিশেষজ্ঞদের মতে ৮ জন ছাত্র, জনতার মৃত্যুর খবর সন্দেহাতীতভাবে পাওয়া যায়।


(১) আবুল বরকত
পরিচয় : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এমএ ক্লাসের ছাত্র।
(২) আবদুল জব্বার
পরিচয় : সাধারণ গ্রামীণ কর্মজীবী মানুষ ছিলেন
(৩) রফিক উদ্দীন আহমদ
পরিচয় : মানিকগঞ্জ জেলার দেবেন্দ্রনাথ কলেজের বাণিজ্য বিভাগের দ্বিতীয়  বর্ষের ছাত্র।
রফিক উদ্দীন আহমদের ছোট ভাইয়ের নাম খোরশেদ আলম, তিনি এখনো জীবিত। শহীদ রফিক উদ্দীন আহমদ ২০০০ সালে মরণোত্তর একুশে পদক পান।
(৪) আবদুস সালাম
গুলিবিদ্ধ হন ২১-২-১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে। হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ৭-৪-১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে বেলা ১১টায় মৃত্যুবরণ করেন।
পরিচয় : ডাইরেক্টর অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি অফিসে রেকর্ড কিপার পদে চাকরি করতেন।
(৫) শফিউর রহমান
পরিচয় : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ক্লাসের প্রাইভেট ছাত্র ও ঢাকা হাইকোর্টের কর্মচারী। বংশাল রোডের মাথায় শহীদ হন (ঢাকা)।
শফিউর রহমানের স্ত্রীর নাম আকিলা খাতুন (বর্তমানে জীবিত বয়স আনুমানিক ৮৩ বছর)। শফিউরের ছেলের নাম শফিকুর রহমান ও মেয়ের নাম আসফিয়া খাতুন। বর্তমানে তারা সবাই উত্তরা মডেল টাউনের বাসিন্দা।
(৬) আবদুল আউয়াল
ঢাকা রেল হাসপাতাল কর্মচারী সংলগ্ন এলাকায় সশস্ত্র বাহিনীর মোটর গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মৃত্যু)।
পরিচয় : রিকশাচালক
(৭) মো. অহিউল্লাহ
। ঢাকার নবাবপুর এলাকার বংশাল রোডের মাথায় সশস্ত্র পুলিশের গুলিতে নিহত হন এবং তার লাশ পুলিশ অপহরণ করে।
পরিচয় : শিশু শ্রমিক,
(৮) অজ্ঞাত বালক
পরিচয় : সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে যে শোক মিছিল বেরিয়েছিল এই অজ্ঞাতনামা বালক ওই মিছিলে অংশ নিয়েছিল। মিছিলটিকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য মিছিলের মধ্যখানে তৎকালীন সশস্ত্র বাহিনী ট্রাক চালানোর সময় চাপা পড়ে তার মৃত্যু ঘটে।


আমাদের মহান বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রতি সম্মান জানিয়ে , ইতিহাসের যুগ সন্ধিক্ষণে তাদের আমরা আজ হৃষ্টচিত্তে আমাদের গভীর ভালোবাসা ও অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা জানাই। সেই জাগ্রত চেতনার পথ ধরেই ১৯৭১ সালে এসেছে আমাদের স্বাধীনতা। একুশে শব্দটি তাই বাঙালির কাছে এক মহিমান্বিত কিংবদন্তি শব্দ।


একুশের গান:---
"আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি"
"দারুণ ক্রোধের আগুনে আবার জ্বালবো ফেব্রুয়ারি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।"


ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গাফফার চৌধুরী ঢাকা মেডিকেলে যান আহত ছাত্রদের দেখতে। ঢাকা মেডিকেলের আউটডোরে তিনি মাথার খুলি উড়ে যাওয়া একটি লাশ দেখতে পান, যেটি ছিল ভাষা সংগ্রামী রফিকের লাশ। লাশটি দেখে তার মনে হয়, এটা যেন তার নিজের ভাইয়েরই রক্তমাখা লাশ। তৎক্ষণাত তার মনে গানের প্রথম দুইটি লাইন জেগে উঠে। পরে কয়েকদিনের মধ্যে ধীরে ধীরে তিনি গানটি লিখেন।
তৎকালীন যুবলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক আব্দুল লতিফ এতে সুরারোপ করেন।  বিবিসি শ্রোতা জরিপে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গানের তালিকায় এটি তৃতীয় স্থান লাভ করেছে

উপসংহার :-


আমরা যদিও গৌরবের সঙ্গে এই একুশে কে স্মরণ করি কিন্তু যে মায়েরা সন্তানহারা হয়েছিলেন , তাঁরা কিন্তু গর্বিত নন তাদের সন্তানদের শহীদ হওয়াতে। তাদের বুকে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল সে শূন্যতা কোনোদিনই পূরণ হবার নয়!!


তথ্যসূত্র :
বিভিন্ন উইকিপিডিয়া থেকে !