(মোট তিনটি স্তরে এই বিষয় নিয়ে লেখার বাসনা রইলো।  আজ প্রকাশ করলাম প্রথম স্তর । একসঙ্গে লিখলে পাঠকদের ধৈর্য্য হারাবার সম্ভাবনা থেকে যায় এ ধরণের রচনাতে । অপটু হাতের ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র।)


ঠিক যেন রবিশঙ্করের সেতার বাদন আর তার সঙ্গে তবলায় জবাব আল্লারাখার। সেতারের ঝংকারে প্রথমে আমরা পাই মন জোড়ানো নান্দনিক অনুভূতি, তারপরেই পাই অপূর্ব কলা ও শিল্পের অসাধারণ যুগলবন্দী। ঠিক একইভাবে বিজ্ঞান ও কবিতার মধ্যে আছে এক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। সেটা পাঠকের কাছে তুলে ধরার লক্ষ্যেই এই অপটু হাতে ক্ষুদ্র লেখার প্রয়াস। কবিতা আমার পেশা নয় । কবিতার গবেষণা আমার এই লেখাতে তাই পাবেন না।শুধু বিজ্ঞান,কবিতা ও তার নান্দনিক অনুভূতি গুলোকে সংকলিত করে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করা এই লেখার উদ্দেশ্য ।


কবিতার সংজ্ঞা কি? কবিতাকে কি আদৌ সংজ্ঞায়িত করা যায়? না এটা শুধু অনুভব করার ব্যাপার? কবিতাকে বুঝে ওঠার জন্যে চাই উপলব্ধি আর সেটাই কি কবিতার সংজ্ঞা? না কবিতাকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না এটা একটা অসার কথা? উত্তর পাঠকদের কাছে ছেড়ে দিলাম । তবে কবিতা অবশ্যই কবির শ্রেষ্ঠতম  শব্দসৌধ সৃষ্টিতে আঁকা হৃদয়ের ভাব ও সুগভীর বোধের নান্দনিক ছবি। কিছু আস্বাদের ধ্রুপদী তৃষ্ণা। সুকন্ঠীর সুরে-ছন্দে গেয়ে ওঠা অদৃশ্য আবেগ-আনন্দ-বেদনার স্পর্শ। তাই কবিতা কোনোদিন থামবেনা। বয়ে যাবে নিরন্তর স্রোতের মতো।


একটা ধারণা আছে বিজ্ঞান ও কবিতা পরস্পর বিরোধী। আর এ নিয়ে সংঘাত বিজ্ঞানী ও কবির চিরদিনের। কয়েকটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে বোধহয়।
প্রথমেই উল্লেখ করবো প্রয়াত নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী
ফাইনম্যানকে জড়িয়ে একটা ঘটনার কথা। ফাইনম্যান কে তাঁর এক বন্ধু কবি বললেন 'তুমি একজন বৈজ্ঞানিক হিসেবে ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারোনা, তুমি এটাকে ভেঙেচুরে ফুলের সৌন্দর্য্যটাই নষ্ট করে দাও । উত্তরে তিনি বলেছিলেন 'হে কবি, তুমি ফুলের যে সৌন্দর্য্য দেখতে পাও সেটা খালি ফুলের ওপরের সৌন্দর্য্য। আর আমি উপভোগ করি এর বাইরের আর ভেতরের সৌন্দর্য্য। কি ভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোষ দ্বারা ফুলের পাপড়ি গঠিত হয়, কিভাবে বৈবর্তনিক উপযোজনের কারণে কীটপতঙ্গকে আকর্ষণ করার জন্য ফুলের সুন্দর রঙ্গের সৃষ্টি হয়েছে, সেসব থেকে তুমি বঞ্চিত'।


এরপরে আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই মার্কিন কবি  "ওয়াল্ট" হুইটম্যান" এর সঙ্গে। মানবতাবাদী কবি হিসেবে  প্রভাবশালী মার্কিন কবিদের একজন ছিলেন তিনি। তাঁকে মুক্তছন্দের জনকও বলা হয়। তিনি এক কবিতায় লিখলেন কিভাবে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর এক বক্তৃতা শুনতে শুনতে একঘেমেয়ি বোধ করে কবি বক্তৃতাকক্ষ থেকে বেরিয়ে যান বাইরে রহস্যময় রাতের আঁধারে, যাতে একান্ত নিভৃতে আকাশের তারার পানে চেয়ে থাকতে পারেন:


WHEN I heard the learn’d astronomer;  
When the proofs, the figures, were ranged in columns before me;  
When I was shown the charts and the diagrams, to add, divide, and measure them;  
When I, sitting, heard the astronomer, where he lectured with much applause in the lecture-room,  
How soon, unaccountable, I became tired and sick;        
Till rising and gliding out, I wander’d off by myself,  
In the mystical moist night-air, and from time to time,  
Look’d up in perfect silence at the stars.


হুইটম্যানের এই লাইনগুলোর যথার্থ প্রত্যুত্তর দিয়েছেন বৈজ্ঞানিক ভিক্টর ওয়াইজ্কফ। তাঁর কবিতার মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন  ওয়াল্ট  হুইটম্যানের মতো তিনিও নির্জন রাতে আকাশের তারার দিকে চেয়ে পুলক ও রোমাঞ্চ অনুভব করেন , কিন্তু তাঁর এই রোমান্টিক অনুভূতি কয়েকগুণ বেড়ে যায়, যখন তিনি উপলব্ধি করেন যে ঐ তারার আলো তাঁর চোখে পৌঁছুতে লক্ষ লক্ষ বছর নিয়েছে, এবং যখন এটা উপলব্ধি করেন যে তাঁর দেহ যে উপাদান দ্বারা গঠিত তাও সুদূর অতীতে কোন অতিনবতারার বিস্ফোরণের দরুণ বিক্ষিপ্ত ধ্বংসাবশেষ বৈ কিছু নয়।


সৌন্দর্যের প্রতি আসক্তি মানুষের এক সহজাত প্রবৃত্তি। এই সৌন্দর্য কোন বস্তুর মধ্যে বিধৃত হতে পারে, আবার ঠিক একইভাবে বিধৃত হতে পারে বিজ্ঞানে ও কবিতায়। এই দুইয়ের একটা সাধারণ উৎস হল সৌন্দর্য্য যা উভয় ক্ষেত্রেই এক অন্তর্নিহিত তথ্য বা বিন্যাস যা মানুষের মস্তিষ্কের আনন্দকেন্দ্রে সৌন্দর্যবোধের সৃষ্টি করে।


(ক্রমশ)