১৩৪৮ সাল। ২৫ শে বৈশাখ আসন্ন। সমস্ত বাংলা মেতে উঠেছে সেই মহাকবির জন্মোৎসব পালন করবে বলে।
শান্তিদেব ঘোষ, যিনি রবীন্দ্রনাথের সংগীত জগৎ ও সংগীত চিন্তার বেশ কয়েকটি গ্রন্থের প্রণেতা, যিনি মাত্র এক বছর বয়েসে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন আর কাটিয়ে গেলেন সারাটা জীবন রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শে, যিনি রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে সিংহল ও বালি দ্বীপে গিয়েছিলেন নৃত্যকলা শিখে আসতে , যিনি রবীন্দ্রনাথের সমস্ত স্বরলিপি সংরক্ষণের ভার নিয়েছিলেন, এহেন এক রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত কাছের মানুষের কাছে আজ কবিগুরুর জন্মদিনে তাঁকে স্বরণ করার অভিপ্রায়ে তাঁর কাছ থেকে কিছু গল্প শোনার ইচ্ছে হলো। অবশ্যই আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করার বাসনা তো আছেই। আসুন তাহলে তাঁর কাছ থেকে কিছু শোনা যাক তাঁর জীবনের শেষ গান "হে নুতন, দেখা দিক আরবার", যে গান ছাড়া রবিঠাকুরের জন্মদিন সম্পূর্ণ হয়না।


"১৩৪৮ সালের আসন্ন ২৫শে বৈশাখ। গুরুদেবের সঙ্গে দেখা করতে গেছি। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন ২৫ শে বৈশাখ এখানে কি হবে ? কথাবার্তায় বুঝলাম সেই জন্মদিন উপলক্ষ্য করে নৃত্যগীত ইত্যাদির আয়োজন হোক এই তাঁর ইচ্ছা। জন্মদিনের আগে একদিন সন্ধ্যায় প্রশ্ন করি , "উৎসবের সময় এই গানটা গাইবো ?"


কোন গানটা ?
'আবার যদি ইচ্ছা কর আবার আসি ফিরে
দুঃখসুখের-ঢেউ-খেলানো এই সাগরের তীরে ॥'


তাঁর জন্মদিনের গানের কথা তাঁকে জিজ্ঞাসা করাতে আপত্তি করে বললেন,'তুই বেছে নে, আমার জন্মদিনের গান আমি বেছে দেব কেন? একটু পরে উপরের গানটির প্রসঙ্গে অনেক কথা বলে গেলেন। কথার ভাবে বুঝেছিলাম যে, দেশ তাঁকে সম্পূর্ণ চিনলো না,এই অভিমান তখন তাঁর মনে রয়েছে। বলেছিলেন 'আমি যখন চলে যাবো,তখন বুঝবে দেশের জন্যে কি করেছি।' খানিকক্ষণ নীরব হয়ে থেকে গেয়ে উঠলেন 'সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে'। প্রাণের আবেগে গানটি গেয়ে উঠলেন। বুঝলাম দেশ তাঁকে বুঝতে পারেনি এ অভিমান যতই থাকুক না কেন, দেশের প্রতি ভালোবাসা তাঁর কোনোদিন কমতে পারেনা।


পরের দিন সকালে তাঁর কাছে গিয়ে বললাম 'আপনি নিজের জন্মদিন উপলক্ষ্যে কবিতা লিখেছেন,বক্তিতা দিয়েছেন অথচ একটাও গান রচনা করলেন না এটা ঠিক মনে হয় না। এবারের পঁচিশে বৈশাখে সমস্ত দেশ আপনার জন্মোৎসব পালন করবে, এই দিনকে উপলক্ষ্য করে একটা গান রচনা না করলে জন্মদিন অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ হয়না।
শুনে বললেন,' তুই আবার এক অদ্ভুত ফরমাস এনে হাজির করলি। আমি নিজের জন্মদিনের গান নিজে রচনা করবো,লোকে আমাকে বলবে কি? দেশের লোক এতো নির্বোধ নয়, ঠিক ধরে ফেলবে যে, আমি নিজেকে নিজেই প্রচার করছি। তুই চেষ্টা কর এখানে যাঁরা বড়ো বড়ো কবি আছেন, তাঁদের দিয়ে গান লেখাতে।' বলেই তাঁদের নাম বলতে শুরু করলেন। আমি হাসতে লাগলাম। তিনি বললেন 'কেন তাঁরা কি কবিতা লিখতে পারেন না মনে করিস? উত্তরে বললাম, 'আপনি থাকতে অন্যদের কাছে চাইবার কি প্রয়োজন?' যখন জন্মদিনের কবিতা লিখেছিলেন, তখন কি আপনাকে কি কেও দোষী করেছিল?রাজি হয়ে জন্মদিনের কবিতাগুলি সব খুঁজে আনতে বললেন দপ্তর থেকে।
'পঁচিশে বৈশাখ' কবিতাটির কিছু রদবদল করে 'হে নুতন দেখা দিক আরবার' অংশটি তে সুর যোজনা করলেন। সেদিন ২৩ শে বৈশাখ।  পরের দিন সকালে পুনরায় আমার গলায় গানটি শুনে বললেন 'হ্যাঁ এবারে ঠিক হয়েছে'


উপসংহার :-
সেদিন খুনাক্ষরেও মনে হয়নি এই তাঁর জীবনের সর্বশেষ গান।


টিকা :
নিজের জন্মদিন উপলক্ষে তাঁর জীবনের প্রথম রচনা --১৩০৬ সালে, আটত্রিশ বছর বয়েসে --
"ভয় হতে তব অভয় মাঝে নুতন জনম দাও হে.....


আমাদের লহ প্রণাম তুমি আজ তোমার শুভ জন্মদিনে !!!