রবিতাপ যখন উচ্চশিখায় দাও দাও করে জ্বলছে , ১৮৯৯ সালে বাংলার আকাশে জন্ম নিলো এক ধ্রুবতারা। যে মহান ধ্রুবতারা আমাদের মতো পথহারাকে টেনে তুলে আনলেন, আর দিলেন  নতুন  কিরণধারা।


"তব মুখ সদা মনে    জাগিতেছে সংগোপনে,
     তিলেক অন্তর হলে না হেরি কূল-কিনারা।
কখনো বিপথে যদি  ভ্রমিতে চাহে এ হৃদি
     অমনি ও মুখ হেরি শরমে সে হয় সারা।"


সেই মহান ধ্রুবতারা হলেন কাজী নজরুল ইসলাম! আমাকে যদি আপনি জিজ্ঞাসা করেন আচ্ছা এমন কোনো কবি বা কবিতার নাম বলতে পারেন যে বিশ্বে প্রথম দশটি কবিতার মধ্যে স্থান পেতে পারে ? হ্যাঁ এককথায় নির্দ্বিধায় এবং নিঃসংকোচে উচ্চস্বরে বলতে পারি কবির নাম নজরুল আর কবিতার নাম "বিদ্রোহী" । এই কবিতাটির ধরে কাছেও কোনো বাংলা কবিতা জন্ম নেয় নি। জানি আপনি প্রশ্ন কোরবেন  'কেন কবিগুরুর "নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ" ? '
মানলাম কিন্তু সেই শ্বব্দঝংকার?
রবীন্দ্রনাথ :
ওরে উথলি উঠিছে বারি
ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ
রুধিয়া রাখিতে নারি।


নজরুল :
আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি একি উন্মাদ আমি উন্মাদ
আমি সহসা আমারে চিনেছি
আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ।


হৃদয় কে স্পর্শ করলো রবীন্দ্রনাথ,
চেতনাকে স্পর্শ করলো নজরুল ।


কবিগুরু :
থরথর করি কাঁপিছে ভূধর,
শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসে,
ফুলিয়া ফুলিয়া ফেনিল সলিল
গরজি উঠিছে দারুন রোষে।


নজরুল :
আমি প্রভঞ্জনের উল্লাস,
আমি বারিধির মহাকল্লোল,.....
আমি উচ্ছল জল-ছল ছল,
চল-উর্মির হিন্দোল দোল!!


হৃদয় আর চেতনার যুগলবন্দী !!


বিদেশী শব্দের ব্যবহারে,বচনে, চয়নে আর উপস্থাপনায় অসাধারণ এক কবিতা নিবেদন করলেন। যে কবিতা  পড়লে মাঞ্জা দেয়া পাঞ্জাবি ছেড়ে রাস্তার মিছিলে বেরিয়ে পড়া যায়! যে কবিতা পড়লে দুঃখ ভোলা যায়, যে কবিতা পড়লে মানসিক অবসাদ দূর হয়ে যায় আর নবচেতনার সৃষ্টি হয়,  সেই কবিতার নাম নজরুলের "বিদ্রোহী"। একাধারে গ্রিক পুরান আর অন্যদিকে হিন্দু পুরান এর অগাধ জ্ঞান না থাকলে এ কবিতার সৃষ্টি হতে পারে ? বিদেশী শব্দকে পোষ মানিয়ে কোনো লেখক এমনভাবে ভৃত্যের মতো জ্বলন্ত আগুনের ওপর ছন্দের তালে তালে বোররাক আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন করে অতিক্রম করতে পেরেছেন কি ? বাংলা ভাষাকে বিদেশী শব্দ দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন আর বিশ্বের দরবারে আমাদের এই প্রিয় ভাষাকে সুপ্রতিষ্ঠ করেছেন!


উপসংহার :-
রবীন্দ্রনাথ "১৪০০ সাল" কবিতায় লিখলেন
"আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসে আমার কবিতা খানি
কৌতূহলভরে, আজি শতবর্ষ পরে!


নজরুলের উত্তর :
আজি হতে শতবর্ষ আগে
কে কবি, স্মরণ করেছিলে আমাদেরে
শত অনুরাগে,
আজি হতে শতবর্ষ আগে।


"বিদ্রোহী": কবিতা রচনা হয়েছিল ১৯২২ সালে। অর্থাৎ ঠিক পাঁচ বছর বাদে "বিদ্রোহী" কবিতাটির শতবর্ষ পূর্ণ হবে। আমি হলফ করে বলতে পারি রবীন্দ্রনাথ এর "১৪০০ সাল" না পড়লেও অসংখ্য পাঠক পড়তে থাকবেন "বিদ্রোহী"। তাঁর এই কবিতায় কোনো ভনিতা নেই,আছে শুধু  সাহসী উচ্চারণের দ্বারা মানব চেতনাকে জাগ্রত করার প্রয়াস ! আরবি , ফারসি, হিন্দি, তুর্কি শব্দ প্রয়োগে তাঁর দক্ষতা চমৎকার ভাবে কাজে লাগিয়েছেন এই কবিতায় ।


বোররাক আর উচ্চৈঃশ্রবা কে বাহন করে দৃপ্ত তেজে সেই ঘোড়াকে আগুনের ওপর দিয়ে ছন্দকে লাফ দিয়ে পার করতেন পারেনএকমাত্র নজরুল, আর কেউ নয় !


টিকা :
বোররাক : দ্রুতগতির স্বর্গীয় বাহন।
উচ্চৈঃশ্রবা :  ইন্দ্রের বাহন, যা সমুদ্রমন্থনের সময় জন্ম নেয় এবং অশ্বশ্রেষ্ঠ।